বুধবার, ১৭ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু

তোয়াব খান

মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু

বিশ্বে স্বাধীনতার জন্য যত সংগ্রাম হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে অনন্য হয়ে আছে। স্বতন্ত্র ধারায় সমুজ্জ্বল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মূলত একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মূল ধারাটি প্রোথিত ভোটাধিকারের দাবিতে। আমরা আমাদের ভোটাধিকার চাই, আমরা ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জিতেছি, কিন্তু ৯২(ক) ধারা জারি করে আমাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার তথা ভোটাধিকার থেকে বারবার বঞ্চিত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ দুই জায়গাতেই পরিষ্কার বলা আছে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এটা নিয়ে বিতর্ক ছিল। আবুল মনসুর আহমদ ইত্তেহাদ পত্রিকায় লিখেছেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আজাদে লিখেছেন বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, বাংলাই হবে রাষ্ট্রভাষা।

জিন্নাহ ও অন্য পাকিস্তানি নেতাদের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বক্তব্যের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ঘোরতর আপত্তি ছিল। ইসলামিয়া কলেজে বেকার হোস্টেলের রুমে বসে কথাবার্তা, ’৪৬-এ ভোটের প্রচারে অংশগ্রহণ এবং আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই তখনকার ছাত্রলীগ শাহ আজিজ আর বঙ্গবন্ধু দুই গ্র“প হয়ে যায়। পরবর্তীকালের অল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এভাবেই দুই গ্র“পের সৃষ্টি। বঙ্গবন্ধু যখন এ দেশে এলেন তখন মোগলটুলীতে তাঁদের ক্যাম্প অফিস। এটাই হলো ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অফিস এবং পরবর্তীকালে বৃহত্তর আন্দোলনের সূতিকাগার। এ সময়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা মূল বিষয় হিসেবে দেখা দেয়। একে একে আসতে থাকে অন্যান্য বিষয়। সামনে আসে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম। আসে আমাদের ধর্মীয় চেতনার কথা। অর্থাৎ এ দেশে আমার কথা বলার অধিকার ধর্মের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে কি না? ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হলো, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর লেখায়ও আছে তখনো অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা ছিল। পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের ভিত্তিই হচ্ছে মাতৃভাষা। দ্বিতীয় উপাদান কথা বলার অধিকার, তৃতীয়ত এসে যাচ্ছে পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পূর্বের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পেক্ষাপটে সব মানুষ তথা সর্বধর্মের মানুষের সম্মিলনের বিষয়টি। এসবের পরিণতিতে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে ধীরে ধীরে মুসলিম শব্দ ওঠে গেল। ১৯৫৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলো, সোহরাওয়ার্দী সাহেব প্রধানমন্ত্রী। তখন ধর্মের ভিত্তিতে ভোটাধিকার বাতিল করে তার পরিবর্তে হিন্দু-মুসলমান-শিখ-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাইকে সমান মর্যাদা দেওয়া হলো। অর্থাৎ এক ব্যক্তির এক ভোট। সোহরাওয়ার্দী সাহেব পার্লামেন্টে জোরালো একটা বক্তৃতা দিয়ে এটা পাস করলেন। এভাবেই আমাদের জাতীয়তাবাদের তিনটি ভিত্তি গড়ে উঠেছে-ভাষা, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের কথা বলার অধিকার এবং গণতন্ত্র। এর ভিত্তিতেই পূর্ববঙ্গে বাঙালির আন্দোলন-জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এর ভিত্তিতেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ২১ দফার ঐতিহাসিক বিজয়, ১৯৫৬ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে রাজনীতিতে মোড় পরিবর্তনের প্রচেষ্টা।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে টিকতে দেওয়া হয়নি। ১৯৫৮ সালে প্রথম এ দেশে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়। যখন ভোটার তালিকা তৈরি করা হচ্ছিল এবং সমগ্র পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন সমাগত তখনই এলো মার্শাল ল। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের জাঁতাকলে শাসনতন্ত্র এবং নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়। সেই সময় স্বাধীনতার একটি প্রচ্ছন্ন চেতনা দেশের মানুষের মধ্যে দেখা দেয়, যা বঙ্গবন্ধু সর্বাগ্রে বুঝতে পেরেছিলেন, এভাবে হবে না। আমাদের আলাদা হতে হবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাঙালির স্বতন্ত্র জাতিসত্তার দাবি শাণিত হতে থাকে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ধারাটি ১৯৬৬ সালে এসে স্বাধিকার সংগ্রামে রূপ নিতে দেখা যায়। এর আগেও রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উপলক্ষ করেই একটা আন্দোলনের সূচনা ঘটে। তখন এ দেশের কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপকভাবে গ্রেফতার করা হয়। আন্দোলনটা স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা চলে। দেখা যাচ্ছে এভাবে আস্তে আস্তে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের একটা ভিত্তি গড়ে উঠছে। ১৯৬২ সালের জুন মাসে যখন আইয়ুবি শাসনতন্ত্র চালু হলো তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে, তখন বঙ্গবন্ধু কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মণি সিংহ ও খোকা রায়ের সঙ্গে মিটিং করেন। মিটিংয়ে বলেন, এ দেশে এভাবে চলবে না। স্বাধীন বাংলাদেশের পথেই এগোতে হবে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটা জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন। জাতীয়তাবাদী অর্থে জাতীয় আন্দোলন। এ সময়ে বিশ্বে দিকে দিকে শোষিত নির্যাতিত মানুষের আন্দোলনও চলছিল। এটা বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রথম জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ছিল ছয় দফার। তিনি বুঝেছিলেন, এখানকার মানুষ মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষে সবাই বাঙালি। সবার ভাষা বাংলা। বঙ্গবন্ধু চীনে গিয়েছিলেন। দেখেছেন সেখানে কীভাবে মানুষ মুক্তির সংগ্রাম করেছে। কীভাবে মানুষ রাতারাতি পাল্টে গেছে। এর প্রভাব তাঁর মধ্যে পড়েছে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের আগে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝোলানোর চেষ্টা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু একসময় ছিলেন আওয়ামী লীগের তরুণ প্রজন্মের নেতা, পরে তিনি আওয়ামী লীগের নেতা হলেন। ধীরে ধীরে তিনি সমগ্র বাঙালির জাতীয় নেতা হয়ে উঠলেন। জাতীয় নেতা যখন হয়েছেন তখন তাঁর চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। জাতিকে মুক্ত করতে হলে কী করতে হবে সে বিষয়ে ভেবেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সমাজতন্ত্রের কথা এসেছে। তবে ছয় দফা মুক্তির সনদ এ ভিত্তিতেই নির্বাচনে লড়েছেন। পরে মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়েছে তখন সমাজতন্ত্র এসেছে প্রবলভাবে। আওয়ামী লীগ তথা বাঙালি যখন ভোটে বেশির ভাগ আসন জিতেছে, তখন বঙ্গবন্ধু ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কথা ঘোষণা করেন। ছয় দফার পুরোটায় জাতির বিকাশ, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।

এরপর দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু যে আন্দোলন করেছেন তাতে ভোটে তাঁকে ৯০ শতাংশ মানুষ সমর্থন করেছে। এ প্রেক্ষাপটে আসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চারটি মূলনীতি। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধ করতে করতেই আমরা শিখেছি। এটা বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের মধ্যে ঘুরেফিরে আছে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির পরে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পরে যখন বক্তব্য দিতেন তখন এলো বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা। এটাই আসলে বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র। মার্কসবাদী ধারায় যে চিন্তা, সারা দুনিয়াতে সমাজতন্ত্র বলতে যা বোঝায়, এটা সে রকম নয়। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রের সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বাংলার গরিব মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। যেহেতু এ দেশে মিল-কারখানা ছিল না, আর সেটা করতে হলে রাষ্ট্রীয় টাকায় করতে হবে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার তখন প্রায় শূন্য। সে জন্য বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের কথা যখন বলেন, তখন কিন্তু এভাবেই বলেন।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পরে এ দেশে সব কলকারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মাত্র দুটি ব্যাংক বাঙালিরা করেছিল। কিছু মিল-কারখানা (জুটমিল) সবে বাঙালিরা করতে শুরু করেছিল। এ দেশের বেশির ভাগ শিল্প-কারখানা ছিল আদমজী, বাওয়ানী তথা অবাঙালিদের। তারা এ দেশ ছেড়ে চলে গেছে। পাকিস্তানিদের মালিকানায় অন্য যেসব শিল্পকারখানা ছিল তারাও পালিয়ে গেছে। সেগুলোর কোনো ব্যবস্থাপনা ছিল না। অন্যদিকে এগুলোকে বাঙালির হাতে ছেড়ে দিলে লুটপাটের আশঙ্কা ছিল। অতএব ২৬ মার্চ এগুলো জাতীয়করণের আওতায় আনা হয়। সমাজতন্ত্রের ভিত্তিটা এভাবে গড়ে ওঠল। এ সমাজতন্ত্রে শোষণের হাতিয়ার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিমালিকানায় কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় প্রশ্ন ওঠেনি। বঙ্গবন্ধুর নীতি হলো- এ দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, তাদের আয় বাড়ানো, জীবনমানের উন্নয়ন করা। এটাই বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রের ধ্যান-ধারণা।

বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতাও তেমনই। সেক্যুলারিজম নিয়ে সারা দুনিয়ায় প্রচলিত যে ধ্যান-ধারণা, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় সরকারের মধ্যে যে চিন্তা ছিল, বঙ্গবন্ধু আসার পর তার একটা বিবর্তন ঘটে। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার মূলে আছে সব ধর্মের স্বাধীনতা। সবাই সমানভাবে তা পালন করতে পারবে। এখানে কোনো বিভেদ থাকবে না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুরু হতো কোরআন তিলাওয়াতের মধ্যমে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ বেতারে কোরআন তিলাওয়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু এটা সমর্থন করেননি। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, কোরআন তিলাওয়াত হবে। কোরআনের পরে গীতা, ত্রিপিটক, বাইবেল থেকে পাঠ হবে। আমার ধর্মনিরপেক্ষতায় ধর্মহীনতা নেই। বঙ্গবন্ধু কখনো বলেননি যে আমি ধর্মহীন। এ মানুষটিই ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, হিন্দুদের অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। আবার একই সঙ্গে কেউ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে সেটা কঠোরভাবে দমন করেছেন। ১৯৭২ সালে রাতেরবেলা ঢাকার বিভিন্ন শিল্প এবং বস্তি এলাকায় মৌলবিরা ওয়াজ করতেন। আমি নিজে দুবার বলেছি মৌলবাদী জামায়াতপন্থিদের উসকানিমূলক বক্তৃতার বিষয়ে। তৃতীয়বার যখন বলেছি, তখন বঙ্গবন্ধু বলেছেন, কাল থেকে আর শোনবা না। ওসব চলবে না। প্রকাশ্যে মিটিংয়ে ওয়াজ কর। কিন্তু রাত ১২টার পরে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কথাবার্তা বলবে- এটা চলবে না। আবার বঙ্গবন্ধুই সুস্থ ইসলামী ধ্যান-ধারণার চর্চা ও বিকাশের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এটাতে তাঁর অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা ও ধ্যান-ধারণা বিন্দুমাত্র ক্ষুণ হয়নি।

আলজিয়ার্স সামিটে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হলো ফিদেল কাস্ত্রোর। কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে হুঁশিয়ার করেছেন-দ্যাখো, আলেন্দেকে মেরে ফেলছে, ইউ উইল বি দ্য নেক্সট টার্গেট। কাস্ত্রোর সঙ্গে আলাপে বঙ্গবন্ধু সত্যিকার অর্থে মুগ্ধ হয়েছিলেন। অন্যদিকে বাদশাহ ফয়সাল মনে করতেন ইসলামী দুনিয়ায় তিনিই একমাত্র মুতাওয়াল্লি। তিনি যা বলবেন, তা-ই হবে। আমরা দেখেছি, বাদশাহর ওখানে বঙ্গবন্ধু যাওয়ার পরে ছবি তুলতে আমাদের গার্ডরা বাধা দিয়েছে, তারপর তিনি তাকিয়েছেন দেখে গার্ডরা চলে গেছে। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বারবারই বলেছেন-দেখুন, আমি কৃতজ্ঞ যে ‘ডিপ্লোম্যাটিক রিকগনিশন না থাকলেও আপনি বাংলাদেশের মানুষকে হজ করতে দিয়েছেন।’

বঙ্গবন্ধু আমাদের দেশের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। বাদশাহ ফয়সাল বললেন-দেখুন, আমাদের সাহায্যটাহায্য করার মতো অবস্থা নেই। আমাদের অবস্থা ভালো নয়। বঙ্গবন্ধু একটু চুপ থেকে পরে বললেন-‘দেখুন, আমি আপনার কাছে সাহায্য চাইতে আসিনি। আপনি আমাদের দুটি পবিত্র মসজিদের মুতাওয়াল্লি। আপনাকে শ্রদ্ধা জানানো আমাদের কর্তব্য। এ জন্য আপনার এখানে এসেছি।’ আমাদের মনে হলো, বাদশাহ ফয়সালের মুখটা একটু ম্লান হয়ে গেল।

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অন্য দেশের রাষ্ট্রনায়ক বা নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা, নিজের নীতি থেকে একচুল না সরে অন্যকে কোনোরকম আঘাত না দিয়ে নিজের বক্তব্য বলা-এটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আরেকটা দিক হচ্ছে, নারীঘটিত ব্যাপারে কারও চরিত্রের স্খলন দেখা দিলে শেখ মুজিবুর রহমান সেটা একদমই সহ্য করতেন না। মদ খেয়ে মাতলামি করলে শেখ মুজিবুরের কাছে মাফ নেই।

১৯৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। লোকজন মারা গেছে। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘কতজন মারা গেছে একদম সঠিক হিসাব দিয়ে দিবা।’ তখন মোমেন সাহেব ছিলেন ফুড মিনিস্টার। তিনি সংসদে বললেন, ‘৩৩ হাজার লোক মারা গেছে।’ বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের নেতা সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে বড় সাহায্য পাওয়া যাবে। উল্টো তারা আমাদের কাছ থেকে ৩০ হাজার টন গম ফেরত চাইল।

সেখান থেকে ফিরে এসে গেলেন জাতিসংঘে বক্তৃতা দিতে। ওই সময় আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধু মনের দিকে থেকে ওপেন ছিলেন আমেরিকানদের সঙ্গে সম্পর্ক করার জন্য। নিউ ইয়র্কে হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। বললেন, আমি তো তোমাদের প্রাইম মিনিস্টারকে বলেছি আরও এক লাখ টন গম দিয়ে আরেকটা জাহাজ পাঠানো হবে। জাহাজটা অবশ্য মাঝপথে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবর্তনটা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ হয়েছিল। এটা এখন ইতিহাস! সোভিয়েত ইউনিয়ন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈপরীত্যের কিছুই ঘটেনি। দুর্ভিক্ষ ও চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখেও বঙ্গবন্ধু একচুলও নীতি বিসর্জন দেননি।

আমার ধারণা, বাকশাল না করে বঙ্গবন্ধুর উপায় ছিল না। উপায় ছিল না মানে দেশের মধ্যে নিজের দলের অবস্থান, দলের নেতাদের অবস্থান, তাঁদের পারফরম্যান্স এবং দলটা ঠিক রাখা, জাতীয় ঐক্য গঠনে অন্যান্য দলের লোকজন নিয়ে আসা এসবের জন্যই দরকার ছিল। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন, এটা টেম্পোরারি ফেইজ।

তিনি গণতান্ত্রিকব্যবস্থায় বিশ্বাসী। গণতন্ত্র ফিরে আসবে। বাকশাল হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু তিন দিন মওলানা ভাসানীর বাড়ি গেছেন। প্রথম রাতে গিয়েছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম আর মনসুর আলী সাহেবকে নিয়ে। দ্বিতীয় দিনে মনসুর আলী ছিলেন আর তৃতীয় দিন কেউ ছিলেন না। মহিউদ্দীন গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রতিটা সময় চাদর মুড়ি দিয়ে যেতেন। এরপর গঠনতন্ত্র যখন অনুমোদন হয় উত্তরা গণভবনের বৈঠকে বসে আমাকে বলেছেন, এখানে থাকো তুমি। মিটিংয়ে গঠনতন্ত্র প্রণেতা হিসেবে বিভিন্ন প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিতে দেখেছি মনোরঞ্জন ধরকে। তিনি পড়ে পড়ে ব্যাখ্যা করছেন। এর মধ্যে একটা জায়গায় ছিল, বাকশালের অর্থনীতি হবে অধনতান্ত্রিক পথে। এটা হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নের তখনকার স্লোগান-অধনতান্ত্রিক পথ। অর্থাৎ দুনিয়ায় যেখানে সমাজতন্ত্র করা সম্ভব নয় আবার ক্যাপিটালিজম থাকছে না, সেখানে হবে অধনতান্ত্রিক পথ। আমি বললাম, স্যার, এটা যদি দেওয়া হয় তাহলে কালকেই আমেরিকানরা এবং যারা আপনার শত্র“ তারা বলবে রাশিয়ানদের কথায় এটা হয়েছে। এই তার প্রমাণ। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, এটা তো ঠিক কথা। অধনতান্ত্রিক পথ দরকার কী আমার, আমার পথ আমার। বাদ গেল এটা। বাকশালের স্লোগানগুলো ছিল- ১. দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ, ২. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, ৩. জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি, ৪. জাতীয় ঐক্য। পরেও দেখা গেছে, আমাদের মূল সমস্যা এ চারটি। জিয়া বা এরশাদ এ চারটি মূল স্লোগানের বাইরে যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবে দেশের প্রশাসনব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের কর্মসূচি দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ আমলের ঔপনিবেশিক প্রশাসন কাঠামো ঢেলে সাজাচ্ছিলেন। মহকুমাগুলোকে জেলা করে নির্বাচিত গভর্নরদের মাধ্যমে দেশ শাসনেরব্যবস্থা করতে যাচ্ছিলেন, যাতে সরকার প্রদত্ত সব সুযোগ-সুবিধা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া যায়। জিয়া, এরশাদ বা অন্যরা কিন্তু এসবের ধারে-কাছেও যাননি। বাকশাল করার পরে সারা দেশে বঙ্গবন্ধু ক্যাম্পেইন করতেন, যেখানে জমি আছে সেখানে ফসল ফলাও। তখন দেখা যেত ঢাকার মোহাম্মদপুরে রাস্তার দুই ধারে ধানের আবাদ। যারা বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছে তারা বুঝতে পেরেছিল অর্থনীতির নতুন মোড় নিচ্ছে। অতএব আগেই শেষ কর।

আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অনন্য বৈশিষ্ট্য একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অভ্যুদয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে বাংলাদেশের প্রশাসন, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, শিল্প-কারখানা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই চলেছে। আবার ২৫ মার্চ কালরাতে গণহত্যা শুরুর পর বাঙালির প্রতিরোধ সংগ্রামে শামিল হয়েছে সর্বস্তরের ও সব শ্রেণির মানুষ। গণহত্যার শিকারও হয়েছে সব শ্রেণির ও পেশার মানুষ। প্রতিরোধযুদ্ধে তথা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে সর্বস্তরের মানুষ। সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর অফিসার, সৈনিক, বেসামরিক প্রশাসনের সচিব থেকে শুরু করে সাধারণ কেরানি পর্যন্ত-সবাই যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে চলে গেছে মুজিবনগরে। একটি জাতির গোটা বিকল্প প্রশাসন গড়ে তুলতে যেসব উপাদান প্রয়োজন তার সবই প্রায় এককথায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। এক কোটি লোকের দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া বিশ্ব ইতিহাসেও বিরল ঘটনা। শরণার্থী বা পাকিস্তান অধিকৃত অঞ্চল অবরুদ্ধ ৯০ শতাংশ মানুষের তথা সবার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্যান্য দেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের স্বাতন্ত্র্য এখানেই। আর এই মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যদিও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। তবুও তাঁর, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ’-এই রণধ্বনি প্রতিদিন স্বাধীন বাংলা বেতারে সহস্রবার অনুরণিত। ‘শোন একটি মুজিবের কণ্ঠে’ এ গান অনুপ্রাণিত করেছে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আর অবরুদ্ধ মানুষকে। এমনকি পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিরাও দিন-রাত প্রতীক্ষায় থেকেছে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর শোনার জন্য।

এখানেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য। সমন্বয়ের ধারায় জাতির গরিষ্ঠ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা আর বিশ্বমানবতার মুক্তির ধ্যান-ধারণার মূর্তপ্রতীক হয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর কর্মে ও চিন্তায়।

 

লেখক : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক জনকণ্ঠ।

সর্বশেষ খবর