ঘরোয়া ফুটবলে বিদেশি কোচ নিয়োগ নতুন কোনো ঘটনা নয়। সত্তর দশক থেকে কোনো না কোনো দলে বিদেশি কোচের দেখা মিলছে। তবে সাম্প্রতিককালে বিদেশি খেলোয়াড়দের পাশাপাশি কোচও আসছে ঢালাওভাবে। চলতি পেশাদার লিগে ১০ দলের সাতটিতেই প্রশিক্ষকের দায়িত্বে রয়েছেন বিদেশিরা। শেখ জামাল, আবাহনী, মোহামেডান ও ব্রাদার্সে শুরু থেকে বিদেশিরা ছিলেন। এরপর ফেনী সকারের মতো দুর্বল দলও গাম্বিয়া থেকে কোচ উড়িয়ে আনে। সর্বশেষ বিস্ময় সৃষ্টি করল শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র। ২০০৪ সালে প্রিমিয়ার লিগে আত্দপ্রকাশ ঘটে দলটির। বিগ বাজেটে নামিদামি খেলোয়াড়দের নিয়ে দল গড়লেও সাফল্য বলতে রানার্সআপেই সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৩ সালে খুলে যায় তাদের ভাগ্য। যেখানে তাদের শিরোপা জেতা স্বপ্নে পরিণত হয়েছিল সেখানে কিনা এক মৌসুমে ফেডারেশন কাপ, লিগ ও স্বাধীনতা কাপ জিতে ঢাকা মোহামেডানের রেকর্ড স্পর্শ করে। কেননা এর আগে ঐতিহ্যবাহী দলটিই এক মৌসুমে তিন ট্রফি জিতেছিল। অনেকে বলেন, শক্তিশালী দল গড়ার কারণে শেখ রাসেল সাফল্যের খাতায় নাম লিখিয়েছিল। এটা ঠিক গত মৌসুমে এ দলে তারকা খেলোয়াড়ের অভাব ছিল না। কিন্তু সাফল্যের মূল কারিগর ছিলেন কোচ মারুফুল হক। তার দক্ষ প্রশিক্ষণে শেখ রাসেল সবাইকে টপকিয়ে একের পর এক বিজয়ের হাসি হেসেছে। ক্লাব সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী থেকে শুরু করে দলের প্রতিটি খেলোয়াড় কোচ মারুফের অবদানের কথা স্বীকার করেন। অধিনায়ক বিপ্লব ভট্টচার্য বলেছিলেন আমরা ভাগ্যবান মারুফ ভাইয়ের মতো দক্ষ কোচ পেয়েছি।
সেই কোচই এবার ক্লাব ছাড়া হলেন। সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকে শেখ রাসেল এবারও মারুফকে কোচ হিসেবে বেছে নিয়েছিল। পুরো মৌসুমের জন্য তার সঙ্গে চুক্তি ছিল। অথচ তিন রাউন্ডে পেশাদার লিগে প্রথম পর্ব শেষের পরই তাকে বরখাস্ত করা হলো। নতুনভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মান্টিয়াগ্রার বিদেশি কোচকে। ক্লাব সভাপতি বলেন, মারুফ ভাই যোগ্যতা নিয়ে আমি কোনো প্রশ্ন তুলব না। কিন্তু মৌসুমটা কেন জানি আমাদের ভালো যাচ্ছে না। ফেডারেশন কাপ ও স্বাধীনতা কাপে দুই টুর্নামেন্টে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। লিগের অবস্থাও ভালো নয়, তাই ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে আমরা মারুফ ভাইকে অব্যহতি দিয়েছি। আলম বলেন, অনেকে বলছেন কোচকে বরখাস্তের কথা। বাস্তবে কিন্তু তা ঘটেনি। অনেক কোচকে লজ্জাকরভাবে বিদায় নিতে হয়। কিন্তু আমি মারুফ ভাইয়ের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ নিয়ে তার যেমন কোনো অভিমান থাকার কথা না তেমনিভাবে বিতর্কিত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি।' আলম এ ধরনের কথা বললেও মারুফ বলেছেন, কি কারণে আমাকে সরানো হয়েছে তা আমিও জানি না। গত দুই বছর এ ক্লাব থেকে অনেক সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছি অথচ বিদায়টা এমন হবে ভাবতেই পারছি না। জাতীয় দলের প্রথম অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু বলেন, 'নতুন নতুন খেলোয়াড় সৃষ্টি না হওয়ার পেছনে বড় কারণ দেশে তেমন যোগ্য কোচ নেই। আর যারা যোগ্য তাদের মধ্যে মারুফ অন্যতম। গত মৌসুমে যার প্রশিক্ষণে শেখ রাসেল তিন ট্রফি জিতল আর এবার ভালো হচ্ছে না বলে হুট করে বাদ দেওয়া হলো তা সত্যিই দুঃখজনক। মুক্তিযোদ্ধা কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক বলেন, শেখ রাসেল গতবার মারুফকে মাথায় তুলে নেচেছিল। এবার রেজাল্ট ভালো হচ্ছে না বলে এভাবে বিদায় জানাবে তা মেনে নিতে পারছি না। তিনি বলেন, রাসেলের পারফরম্যান্স ভালো যাচ্ছে না এটাও আমি মানছি। কিন্তু তারা কি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো দল গড়েছে? তা ছাড়া লিগ এখনো শেষ হয়নি। সুপার কাপ ও প্রেসিডেন্ট কাপ পড়ে আছে। সবকিছুতে ব্যর্থ হলে মারুফকে যদি আগামী মৌসুমে বাদ দিত তাহলে বিতর্ক উঠত না। যাক এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। আলী ইমাম ভাইয়ের মতো বিখ্যাত কোচকেও সাফল্য এনে দেওয়ার পর আবাহনী ও মোহামেডান থেকে দুঃখজনকভাবে বিদায় নিতে হয়েছিল। বাংলাদেশে কোচরা বরাবরই বঞ্চনার শিকার। ব্যক্তিগত কারণে মুক্তিযোদ্ধা ও মোহামেডান আমাকে অব্যাহতি দিয়েছিল। টিটুকেও শেখ জামাল। এতে বিস্ময় হওয়ার কিছু নেই। এতে কী সামনে অন্যরা কোচ হতে আগ্রহী হবেন? মানিক বলেন, অনেকের ধারণা দেশে ফুটবল কোচের অভাব। আমি বলব, না। অনেক নামজাদা খেলোয়াড়ই এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান। কিন্তু ক্লাব ফেডারেশন গুরুত্ব না দেওয়াতে তাদের দেখা মিলছে না। আসলে ফুটবল উন্নয়নে কোচদের গুরুত্ব না দিলে নতুন নতুন খেলোয়াড় বের হবে না। এটা দেশের ফুটবলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। মানিক আক্ষেপ করে বলেন, কোনো খেলোয়াড়ের পারিশ্রমিক বাকি পড়লে হৈ চৈ পড়ে যায়। কিন্তু কোচরা এক্ষেত্রে কতটা যে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের শিকার তা নিয়ে কেউ কখনো ভাববার প্রয়োজন মনে করেননি।