ব্রাজিলে বিশ্বকাপ শুরু হতে আর মাত্র ২৮ দিন বাকি। অথচ দুনিয়া কাঁপানো এ আসরকে ঘিরে উন্মাদনা শুরু হয়ে গেছে অনেক আগে থেকেই। পৃথিবীতে সব খেলারই বিশ্বকাপ হয়ে থাকে। কিন্তু বিশ্বকাপ বলতে যা বুঝায় সেটা কিন্তু ফুটবলকে ঘিরেই। চূড়ান্ত পর্বে ৩২টি দেশ অংশ নিচ্ছে। কিন্তু প্রাক ও বাছাইপর্বে মিলে মোটামুটিভাবে পৃথিবীর সব দেশই খেলছে। এতগুলো দেশ নিয়ে অন্য কোনো বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় না। বাংলাদেশের দৌড় প্রাক লড়াই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। চূড়ান্ত পর্বতো বাদই ফুটবল বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে খেলাটা এখন স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। তাই বলে বিশ্বকাপ ঘিরে বাংলাদেশে উত্তেজনা কি কম আছে? বাস্তবতা হচ্ছে অনেক বিশ্বকাপ খেলা দেশের চেয়ে বাংলাদেশের উত্তেজনা চোখে পড়ার মতো। ক্রিকেটে নিজ দেশ ছাড়া অন্য দেশকে সমর্থন জানাতে বাংলাদেশের দর্শকরা পতাকা নিয়ে গ্যালারিতে হাজির হয়। কিন্তু ফুটবল বিশ্বকাপে খেলাটা স্বপ্নে পরিণত হলেও অন্যদেশের পতাকাগুলো বাসা বা অফিস-আদালতে পতপত করে উড়তে থাকে। ব্রাজিল বিশ্বকাপের পর্দা উঠতে এখনো ২৮ দিন বাকি। কিন্তু কে হবে চ্যাম্পিয়ন এ নিয়ে বাংলাদেশে উত্তেজনা এখনই শুরু হয়ে গেছে। পেলে ও ম্যারাডোনার কারণে এদেশের ক্রীড়াপ্রেমীরা ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাকে সাপোর্ট দিয়ে থাকেন। অন্য দেশেরও সাপোর্টার রয়েছে কিন্তু আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের খেলা হলে যে উত্তেজনা দেখা যায় তা অন্যদের বেলায় হয় না। এখনই অনেক জায়গায় ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার পতাকা উড়ানো শুরু হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে এবারে বিশ্বকাপে ব্রাজিলে বলে বাংলাদেশে উন্মাদনাটা আরও বেশি থাকবে।
কথা হচ্ছে এভাবে আর কত দিন। বাংলাদেশ কি শুধু বিশ্বকাপে পরের দেশ নিয়ে নাচানাচি করবে? নিজেরা কি কখনো চূড়ান্ত পর্বে খেলার সুযোগ পাবে না। অনেকে বলেন, জীবনেও বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলতে পারবে না। কিন্তু বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন এমন হতাশার মাঝেও আশার আলো জাগিয়েছেন। বছর দুয়েক আগেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন ২০২২ সালে বিশ্বকাপ খেলার টার্গেট নিয়ে ফুটবলকে এগুতে হবে। অর্থাৎ সালাউদ্দিন টার্গেট কুয়েতে অনুষ্ঠিতব্য ২০২২ সালে বিশ্বকাপ খেলা। ব্রাজিলে শেষ হওয়ার পর ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপের আয়োজন করবে। এরপরের বিশ্বকাপেই বাংলাদেশ খেলবে। কিন্তু কীভাবে সম্ভব? সালাউদ্দিন বাংলাদেশের ফুটবলে উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার মতো জনপ্রিয় ফুটবলার বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। ফুটবলে তার মতো জ্ঞানী লোক বাংলাদেশে আর আসবেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। সুতরাং তার কথায় আলাদা একটা গুরুত্ব রয়েছে। অনেকে বলেন, তিনি যা বলেন তা করেও ছাড়েন। বাস্তবতা হচ্ছে ছয় বছর ধরে সালাউদ্দিন দেশের ফুটবলে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করলেও এ খেলা তেমনভাবে জেগে উঠেনি বরং তুলনা করলে দেখা যাবে আগের চেয়ে অনেক পিছিয়ে গেছে। মান যে আগেও আহামরি ছিল তাও বলা যাবে না। কিন্তু এখন না আছে মান না আছে জনপ্রিয়তা। এটাও ঠিক বাংলাদেশে ক্রিকেট ঘুরে দাঁড়ানোর পরই ফুটবলের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। এখন তা ভয়াবহ হয়ে দেখা দিচ্ছে। অন্য খেলার কথা বাদই দিলাম। পেশাদার ফুটবল লিগে মোহামেডান-আবাহনী লড়াইয়েও গ্যালারি থাকছে ফাঁকা। সালাউদ্দিনরা যখন খেলতেন তখনকার মতো দর্শক হবে তা এখন আশা করাটাও বেকামি। এখন গ্যালারির দর্শক হাতে গোনা যায় তা মানা যায় না। ফুটবলে প্রশংসা করার মতো মান আগেও ছিল না ঠিকই। তবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আশি দশকে মোহামেডান ও আবাহনীর কাছে এশিয়ার অনেক বিখ্যাত দলই ধরাশায়ী হয়েছে। একবারতো ইরানের আটজন জাতীয় খেলোয়াড় নিয়ে গড়া পিরুজী ক্লাবকে হারিয়েও মোহামেডান এশিয়ান ক্লাব কাপে চূড়ান্ত পর্বেও খেলেছিল। অথচ ইরান এবার নিয়ে তিনবার বিশ্বকাপ খেলছে। আর বাংলাদেশের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। সালাউদ্দিন কিন্তু কখনো বলছেন না ২০২২ সালে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলবেই। তিনি লক্ষ্য হিসেবে তা চিহ্নিত করেছেন। আসলে লক্ষ্য না থাকলে কোনো কাজের অগ্রগতি হয় না। কিন্তু বাফুফের সভাপতি ভালোমতোই জানেন দেশের ফুটবলের কি হাল। ২০২২ সাল আসতে এখনো আট বছর বাকি রয়েছে। এ সময়ে বিশ্বকাপ খেলা মানে বাংলাদেশ এশিয়া অঞ্চলে শক্তিশালী জায়গা দখল করবে। কেননা এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে প্রাক ও বাছাই পর্বে লড়ে বাংলাদেশকে ২০২২ সালে চূড়ান্ত পর্বে উঠতে হবে। সালাউদ্দিনই বলুন বাংলাদেশ যেখানে প্রাক-বাছাই পর্ব, চ্যালেঞ্জ কাপ এমনকি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দাঁড়াতে পারছে না। সেখানে আট বছরের মধ্যে এত দ্রুত উন্নতি ঘটিয়ে বিশ্বকাপে চূড়ান্ত পর্বে খেলা সম্ভব কিনা। তারপর আবার প্রশ্ন উঠেছে কাতার বিশ্বকাপে যেতে বাংলাদেশ কাদের নিয়ে লড়াই করবে। বর্তমানে যারা জাতীয় দলে খেলছেন তারা যে এত দিন টিকবেন না তা অনেকটা নিশ্চিত। এরপর কারা জাতীয় দলের হাল ধরবেন সেটাই চিন্তার বিষয়। কারণ দেশে এখন নতুন খেলোয়াড়ের সন্ধানই মিলছে না। আর হবেই বা কিভাবে? অধিকাংশ জেলাগুলোতে ফুটবল মাঠেই নামে না। সুতরাং ২০২২ সালের ভিশন বাস্তবায়িত করতে হলে সালাউদ্দিনকে অনেক সিঁড়ি অতিক্রম করতে হবে।
এটা ঠিক সালাউদ্দিন কিন্তু বসে নেই ফুটবল উন্নয়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আশার কথা ফুটবলে এখনো যে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব তা তিনি টেরও পেয়েছেন। কলকাতা আইএফএ শিল্ডে রানার্সআপ হলেও শেখ জামাল ভারত কাঁপিয়ে এসেছিল।
কিছুদিন আগে এএফসি প্রেসিডেন্ট কাপে বাছাই পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেখ রাসেলও তার প্রমাণ দিল। ফিফা বা এএফসির র্যাঙ্কিংয়ে দুটো টুর্নামেন্টেই কোনো গুরুত্ব নেই। কিন্তু সংকটাপণ্ন্ন ফুটবলে এই সাফল্যই বা কম কিসের। বাস্তবতার কারণে ধরে নিলাম ২০২২ সালে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলা সম্ভব নয়। কিন্তু ভিশনকে সামনে রেখে সালাউদ্দিন যদি পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে থাকেন তাহলে হয়তোবা এশিয়ান পর্যায়ে শক্তিশালী অবস্থানে যাওয়া সম্ভব। এটাই বা কম কিসের। এক্ষেত্রে অর্থ বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু ফুটবলে যদি জোয়ার সৃষ্টি হয় তাহলে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসবেই। ক্রিকেটে আগে কি ফান্ড পাওয়া যেত, ঘুরে দাঁড়ানোর পর এ খেলার এখন অর্থ কোনো ফ্যাক্টর নয়। কাজের ওপরই নির্ভর করবে ফান্ড আসবে কিনা। সালাউদ্দিন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেলেন আগামীতে যদি আরও উন্নয়ন ঘটে তাহলেতো আর বিশ্বকাপ খেলা স্বপ্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কথা নয়। কিন্তু দেশটাতো আবার বাংলাদেশে। যেখানে সব অসম্ভবই সম্ভবে রূপান্তরিত করা যায়। উন্নয়নের কথা বলছি হয়তো বা দেখা যাবে আগামী ছয় বছরে বাংলাদেশ ভুটানের কাছেই নাকানি-চোবানি খাচ্ছে।