অসাধারণ স্কিল, ক্ষীপ্রগতি, চমৎকার বল নিয়ন্ত্রণ এবং ভারসাম্য, দুরন্ত শট - সব মিলে সর্বকালের সেরা ফুটবলারের তালিকার উপরের দিকেই থাকবে ইউসেবিওর নাম। অনন্য মেধাবী এই পর্তুগিজ তারকাকে সতীর্থরা 'কালো চিতা' বলে ডাকতেন। ইউসেবিওর ফুটবল প্রতিভা ও দক্ষতা পর্তুগালকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। ক্লাব বেনফিকাকেও বিরল সম্মান এনে দিয়েছেন 'কালো চিতা'।
ইউসেবিওকে বলা হয়ে 'পর্তুগালের পেলে'। গোল হতে পারে না - এমন বল থেকেও অনায়াসে গোল আদায় করে নিতেন 'কালো চিতা'। ইউসেবিওর বড় গুণ ছিল, তিনি যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিকে অনুকূলে নিয়ে আসার ক্ষমতা রাখতেন। ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে তার পায়ের জাদু দেখে ফুটবলবোদ্ধারা দাবি করেছিলেন ব্রাজিলের পেলের চেয়েও বেশি কৌশলী ইউসেবিও! ওই আসরে ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হলেও ৯ গোল করে সেরা ফুটবলার হয়েছিলেন পর্তুগালের এই কিংবদন্তি। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত পর্তুগালের সেরা গোলদাতা ছিলেন 'কালো চিতা'। তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৬৬'র বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১-০ গোলে পরাজয়ের কথা ভুলতে পারেননি। সেই ম্যাচে ইউসেবিওকে খেলতেই দেননি ইংলিশ ফুটবলাররা। নোবি স্টাইলসের আঘাতে বেশ কয়েকবার মাঠেই জ্ঞান হারান তিনি। হেরে যাওয়ায় ম্যাচ শেষে কাঁদতে কাঁদতে স্টেডিয়াম থেকে বের হন ইউসেবিও। পরবর্তীতে ওই বিশ্বকাপের জন্য বার বার আফসোস করেছেন। ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপটি পর্তুগিজদের কাছে ''কালো চিতার 'ইংলিশ' দুঃখ" নামে পরিচিত।
কৈশোরে ইউসেবিও ছিলেন সেরা স্প্রিন্টার। ফুটবল মাঠে হরহামেশায় তা দেখা গেছে। ইউসেবিওর দুরন্ত গতির কাছে পাত্তাই পেতেন না প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা। ৬৬'র বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে পর্তুগালের ম্যাচটি এখন বিশ্বকাপের ইতিহাসে স্মরণী হয়ে রয়েছে। ক্ষীপ্রগতির সঙ্গে ফুটবলীয় মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে কী অবিশ্বাস্যভাবেই না পর্তুগালকে জয় এনে দিয়েছিলেন কালো চিতা!
নবাগত উত্তর কোরিয়া গ্রুপ পর্বে ইতালিকে হারিয়ে চিলির সঙ্গে ড্র করে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। শেষ আটের লড়াইয়ে পর্তুগালের বিরুদ্ধে মাত্র ২৫ মিনিটেই ৩-০ গোলে এগিয়ে যায়। 'পুচকে' কোরিয়ার কাছে দ্রুত ৩ গোল হজম করায় চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি ঝরছিল ইউসেবিওর। শোককে শক্তিতে পরিণত বেশি সময় নেননি তিনি। কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই বদলে যান ইউসেবিও, সতীর্থদেরও উদ্দীপ্ত করেন। তারপর যা ঘটল তা এক কথায় 'অলৌকিক'! কোনো বিশেষণেই বিশেষায়িত করা সম্ভব নয়। ফুটবলের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় এক ঘটনা। পর পর চার চারটি গোল করেন ইউসেবিও। পর্তুগিজদের বেদানাশ্রু মুহূর্তেই পরিণত হয়ে যায় আনন্দাশ্রুতে। অবিস্মরণীয় সেই ম্যাচে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে ৫-৩ গোলে জয় পেয়েছিল পর্তুগাল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইউসেবিও নিজে চার গোল তো করেছেনই, শেষের গোলটির নেপথ্য নায়ক তিনি।
উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচটি স্টেডিয়ামে বসেই উপভোগ করেন কিংবদন্তি বঙ্ার মোহাম্মদ আলী। ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইউসেবিওকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, 'এতো সুন্দর ম্যাচ আমি এর আগে কখনো দেখিনি। হয়তো ফুটবলও দেখেনি। ভবিষ্যতেও এমন সুন্দর ম্যাচ দেখা যাবে কিনা! ইউসেবিও, আপনি সত্যিকারের বীর।'
ইউসেবিওর পর লুইস ফিগোর মতো কিংবদন্তি তারকাও পর্তুগালের জার্সিতে খেলেছেন। কিংবা বর্তমানের ক্রিস্টিয়ানোর রোনালদোর কথাই বলুন। 'কালো চিতা' সবার থেকে এগিয়ে। রোনালদো নিজেই স্বীকার করেছেন, 'কালো চিতার মতো দ্বিতীয় ফুটবলার আর জন্ম নিবে না। ফুটবলের ইতিহাসে ইউসেবিও একজনই। এবারের বিশ্বকাপে খেলা শুরুর পূর্বে আমরা তাকে স্মরণ করেই মাঠে নামব।'
পর্তুগালের জাতীয় দল এবং বেনফিকার একাদশে সুযোগ পেতে খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি ইউসেবিওকে। যত দিন খেলেছেন ছিল তার এককাধিপত্য। ৬৬'র বিশ্বকাপের বিশ্বের সেরা সেরা ক্লাব কালো চিতাকে দলে নেওয়ার জন্য হুমড়ি খায়। কিন্তু ইউসেবিওর এক কথা, বেনফিকাতেই ভালো আছি। আমার খুব বেশি অর্থের দরকার নেই। ক্লাব ফুটবলে তার যত অর্জন সব বেনফিকার হয়েই। ১৯৭২-৭৩ মৌসুমে ৪০ গোল করে তিনি ইউরোপিয়ান 'গোল্ডেন সু' জেতেন।
বিনয়ী স্বভাবের জন্য বিখ্যাত ইউসেবিও। প্রতিপক্ষের ফুটবলারদের কাছ থেকে বার বার আঘাত পেলেও কখনো প্রতিবাদ করেননি। তার মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহাও কাজ করেনি। ফুটবলে অদম্য প্রতিভা এবং মহানুভবতার জন্যই হয়তো বিশ্বকাপ না জিতেও ফুটবলপ্রেমীদের মণিকোঠায় স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন 'কালো চিতা'।