মৃত্যু তো আর দিনক্ষণ গুনে বা হিসাব-নিকাশ করে আসে না। তা বয়সে আমার চেয়ে ১০-১৫ বছরের ছোট সাব্বীর ইউসুফকে আমার আগেই মৃত্যু ছিনিয়ে নিয়ে গেল। ২০১৪ সালের ৩ জুলাইয়ে তার মৃত্যুর খবর আমাকে হতবাক করে দিয়েছিল। তাদের বড় দুই ভাই কামাল ইউসুফ (সাবেক মন্ত্রী) ও খালেদ ইউসুফ (বাচ্চু) ক্রিকেট খেলার সূত্রে পরিচিত হওয়ায় আকমাল ইউসুফ ও সাব্বীর ইউসুফকে তাদের তিন-চার বা পাঁচ বছর বয়স থেকেই চিনি। তাই তার মৃত্যু আমার কাছে বেশ শোকাবহ। জমিদার, রাজনীতিক ও মন্ত্রী ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) ফরিদপুর থেকে তার পরিবার নিয়ে ঢাকায় বকশীবাজারের বাড়িতে পঞ্চাশের দশকের শুরুতে এসে ওঠেন। তখন থেকেই এ পরিবারের সঙ্গে আমার সখ্য। কামাল ইউসুফ ও খালেদ ইউসুফ তখন পাড়ার টিমের (বিবিসি) নিয়মিত খেলোয়াড় আর আমি সে টিমের গেস্ট ক্রিকেটার। কামাল ইউসুফ ছিলেন টু ডাউন ব্যাটসম্যান ও ঝানু স্লিপ ফিল্ডার। তার ছোট ভাই খালেদ ইউসুফ (বাচ্চু) ছিল মিডল অর্ডার এন্টারপ্রাইজিং ব্যাটসম্যান ও ডান হাতি মিডিয়াম পেস সুইং ও কাটার বোলার। খালেদ সে সময় ঢাকা প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগের অন্যতম প্রতিশ্রুতিবান অলরাউন্ডারদের একজন। আমি পুরান ঢাকার ন্যাশনাল স্পোর্টিং ক্লাবের ক্রিকেটার হলেও লিগের বাইরে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে আমি তাদের গেস্ট খেলোয়াড় হিসেবে নিয়মিত খেলতাম।
বড় দুই ভাইয়ের মতো সাব্বীরও কিছু দিন ক্রিকেটে হাত পাকানো শুরু করেছিল। কিন্তু বাড়ি বদলে বকশীবাজার থেকে হকপাড়া হিসেবে খ্যাত মাহুতটুলীতে আসার পরে সবকিছু পাল্টে গেল। তাদের মাহুতটুলীর বাড়ির ৫০ গজের মধ্যে আরমানিটোলা স্কুলমাঠ। আর এ স্কুল দেশের হকির সেরা পীঠস্থান। হকি খেলার সুবিধা ও সুযোগ পেয়ে দুই ক্রিকেটার ভাই বাদে বাকি পাঁচ ভাই আকমাল, সাব্বীর, ফয়সাল, ফুয়াদ ও সবার ছোট সাউদ ইউসুফও ঝুঁকে পড়ে প্রথম বিভাগ হকি লিগে। কেননা কোনো টিমের হয়ে নিয়মিত খেলা ছিল এক স্মরণীয় ঘটনা। সব ভাই বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে খেলে তাদের খেলোয়াড়ি জীবন উপভোগ করেছে।
হকিতে ফুল ব্যাকের সুদেহী ও সুদর্শন সাব্বীর ইউসুফ একমাত্র প্রাদেশিক পূর্ব পাকিস্তান পরে ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলার গৌরব পায়। তার ঠাণ্ডা মাথার নৈপুণ্য ও শৌর্য প্রদীপ্ত খেলা তাকে সব সময় অন্যসব খেলোয়াড়ের মধ্য থেকে পৃথক করে দিয়েছে। যখন তিনি কম্বাইন্ড স্পোর্টিং, ইস্পাহানি স্পোর্টিং বা আবাহনী কেসির হয়ে খেলেছে তাদের হয়ে শিরোপা জেতা ছাড়াও তার বলিষ্ঠ ও পজিটিভ খেলা দ্বারা তার আলাদা বৈশিষ্ট্য বা স্বকীয়তা বজায় রাখতে পিছপা হয়নি।
তার দীর্ঘ খেলোয়াড়ি জীবনে সাব্বীর ইউসুফ সব সময় তিন তুখোড় খেলোয়াড় আবদুস সাদেক, ইব্রাহিম সাবের ও মোহসিনের অপার সাহচর্যে তার খেলোয়াড়ি জীবনকে সফল ও বর্ণময় করে তোলার জন্য তাদের কাছে সদা ঋণাবদ্ধ। ক্লাব, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাদেশিক বা জাতীয় দলে তাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন খেলার অভিজ্ঞতা ছিল পরম উপভোগের অংশ। এ তিনজনের সঙ্গে দীর্ঘদিন খেলা তাদের সবাইকে পরমাত্দীয়তার বাঁধনে বেঁধেছে বলে স্বীকার করতে সাব্বীরকে কখনো কুণ্ঠিত হতে দেখা যায়নি। দীর্ঘ হকি খেলোয়াড়ি জীবনে সাব্বীর অনেক স্মরণীয় ও বরণীয় ম্যাচ খেললেও ১৯৭০ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে মেক্সিকাে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান দলের বিরুদ্ধে কথা সাব্বীরের স্মৃতিজুড়ে থাকবে। বিশ্বের সেরা ও দোর্দণ্ড প্রতাপশালী দলের বিরুদ্ধে অজানা অখ্যাত পূর্ব পাকিস্তান দলের অসম একতরফা ম্যাচ খেলার শ্রী নষ্ট করে দেবে বলে সবার ধারণা ছিল। কিন্তু ঢাকা স্টেডিয়ামের ২০ হাজার দর্শক অসম এ ম্যাচে সম প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগুনে ঝাঁপ দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানের কুশলী, ধূর্ত ও গোল ক্ষুধার্ত ফরোয়ার্ডদের বিষদাঁত ভেঙে দিয়ে সাদেক, সাব্বীর, সাবের ও মোহসিনের হিমালয়সম দৃঢ়তার সামনে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। বাংলার দামাল ছেলেদের এ অভাবনীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখে ভাগ্যলক্ষ্মী অলক্ষ্যে ক্রূর হাসি হেসেছিল। হিমালয়সম প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়েও পূর্ব পাকিস্তানকেও হারতে হয়েছিল তানভির দারের বিতর্কিত পেনাল্টি কর্নারের গোলে। ভাগ্যের এ নির্মম প্রহসন মেনে নিয়েই শেষ পর্যন্ত দুই দলকে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল।
ম্যাচ জিতেও বিজয়ী পাকিস্তান দলকে এক অজানা লজ্জায় অধোবদন হয়ে মাথা নিচু করে ড্রেসিংরুমে ফিরে যাওয়ার সময় দর্শকরা যেন হাততালি দিতে ভুলে গিয়েছিল। আর ম্যাচ হেরেও স্বাগতিক খেলোয়াড়রা মাথা উঁচু করে যখন বিজয়ীর বেশে সাজঘরে ফিরছিল দর্শকের বিরামহীন হাততালিতে ঢাকা স্টেডিয়াম ও তার চারদিক প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসে সেই অত্যাশ্চর্য মুখর মুহূর্তের কালসাক্ষী হিসেবে একমাত্র সাংবাদিক আমিই বেঁচে রয়েছি।
বড় দুই ভাই দক্ষ ক্রিকেটার হলেও বাকি পাঁচ ভাইয়ের হকি খেলোয়াড় হওয়ার পেছনে একটা যোগসূত্র রয়েছে। হকি তারা পেয়েছিল বংশানুক্রমে। বেশ কয়েকবার আমার ঢাকার অদূরে ফরিদপুরে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়। ১৯৬০ সালে ঢাকা জেলা দলের হয়ে ফরিদপুরে আন্তঃজেলা ফুটবল খেলতে যাই। সেবার আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন শক্তিশালী ময়মনসিংহ জেলাকে ৫-০ গোলে হারিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করি। আমি ম্যাচের প্রথম গোল করার পর ইসিজি প্রেসের জালাল খোন্দকার হ্যাটট্রিকসহ বাকি ৪টি গোল করে। ১৯৭০ সালে ন্যাশনাল স্পোর্টিংয়ের হয়ে সেখানে দুটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলি। সে ম্যাচের উদ্যোক্তা হলেন আমার প্রয়াত আন্তঃ ফুটবলার/ক্রিকেটার/ভাষ্যকার বন্ধু মঞ্জুর হাসান মিন্টু। ১৯৭৭-৭৮ সালে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল ফরিদপুরে গেলে একটি আন্তঃক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। সে ম্যাচের রিপোর্ট কাভারের জন্য আমাকে সেখানে যেতে হয়। আমি ফরিদপুরে গিয়ে একটি হোটেলে ওঠার কিছু পর সেখানের জমিদারবাড়ি ময়েজ মঞ্জিলে আমি আতিথ্য গ্রহণে বাধ্য হই। সে সময়ই ফরিদপুর টাউন ক্লাবে গেলে জানতে পারি সেখানের ইউসুফ আলী পরিবারের বংশানুক্রমিক হকিপ্রীতির কথা। ক্লাবের দেয়ালে টাঙানো সম্ভবত ১৯২৮ সালে কলকাতার বাইটন কাপ হকিতে অংশগ্রহণকারী ফরিদপুর টাউন ক্লাবের গ্রুপ ছবিতে হকিস্টিক হাতে সাব্বীরদের পিতা ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া)-এর ছবি। রাজনীতিক, মন্ত্রী ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) থেকে তার সন্তানদের হকিপ্রীতির কথা সেই প্রথম জানতে পারি। দেয়ালে টাঙানো আরেকটি গ্রুপ ছবিতে বোম্বাইয়ের খ্যাতনামা অভিনেতা পৃথ্বীরাজ কাপুর ও অন্যান্য সিনেমা ব্যক্তিত্বের ফরিদপুরের সম্মেলনে যোগদানের কথা জানতে পারি। ফরিদপুর টাউন ক্লাবের এ দুটি গ্রুপ ছবিতেই সে সময়ের ফরিদপুরের হকি ও সিনেমা প্রীতির ঐতিহ্য আজ সারা দেশের গর্বের কারণ। মাত্র কিছু দিন আগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় হকির ফাইনালে নৌবাহিনীকে হারিয়ে ফরিদপুর জেলা হকি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব পেয়েছে। জাতীয় হকিতে ফরিদপুর জেলা টানা তিনবার ফাইনালে খেললেও এবারই তারা শিরোপা পায়। ফরিদপুর টানা তিনবার ফাইনালে খেলাকে হকির রেনেসাঁ বলে অভিহিত করতে পারেন। ১৯৭৬ সালে ফরিদপুর জেলা যখন জাতীয় হকিতে তাদের প্রথম শিরোপা জেতে প্রয়াত সাব্বীর ইউসুফ ছিলেন সে দলের অধিনায়ক, বিজয়ের প্রধান কর্ণধার। সাব্বীরের অধিনায়কত্বের সূচনা থেকে আজ সেখানে হকির রেনেসাঁ সম্ভব হয়েছে বলে হকি চিন্তাবিদ ও বিদগ্ধজনের অভিমত।
খেলার মাঠে নৈপুণ্যের ঝলকানি ও রক্ষণদৃঢ়তার শৌর্যের সঙ্গে খেলোয়াড়দের ঠাণ্ডা মাথায় সবকিছু মোকাবিলায় মেজাজ যদি ঠিক না থাকে তবে আনন্দের খেলা কখনো কখনো নিরানন্দের হাট হয়ে ওঠে, খেলা তখন নরক হয়ে ওঠে। সাব্বীরও ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকায় তার খেলোয়াড়ি ঔদার্য্য ও আচরণ প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে দর্শকদের কুণ্ঠাহীন প্রশংসা কেড়েছে। তার পারিবারিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা সাব্বীর ইউসুফকে খেলা ছেড়ে দেওয়ার অনেক পরেও সম্ভ্রম ও ভালোবাসার পরম এক ব্যক্তি হিসেবে আখ্যা পাওয়া তার নশ্বর জীবনক গৌরবময় করে গড়ে তুলেছিল। দীর্ঘদিন উঁচুমানের হকি খেলেও কোনো অপ্রিয় বা অবাঞ্ছিত ঘটনার সঙ্গে না জড়ানোর জন্য পরম করুণাময়ের কাছে তার শোকরানা জানানোর অন্ত ছিল না।
মানুষ সাব্বীর ইউসুফ তার খেলোয়াড়ি ব্যক্তিত্বকে ছাপিয়ে অভিজাত ঘরের সন্তান সাব্বীর দয়ালু, পরোপকারী, মার্জিত রুচি ও বিবেকবান থাকায় সম্মান ও সম্ভ্রমের মাঝে সব সময় তাকে মাথা উঁচু করে চলতে অসুবিধা হয়নি।
সাব্বীরের এক বোনজামাই মোসলেহউদ্দিন ফরহাদ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে আমার সতীর্থ ছিল এবং পঞ্চাশ ও ষাট দশকে ব্রাদার্স ইউনিয়নের দুরন্ত ফাস্ট বোলার হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিল। তার আরেক বোনজামাই কাম্বার আলী বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের সুবর্ণলগ্নে নানাভাবে অবদান রেখে দাবা ব্যক্তিত্ব হিসেবে সম্মানিত। তার বড় বোনজামাই ব্যারিস্টার বদরুল আমিনের ভাই ইকরামুল আমিন (আসাদ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৪৯ সালে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগ চ্যাম্পিয়ন ইপি জিমখানা ক্লাবের গৌরবদীপ্ত অধিনায়ক ছিলেন।
মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন সাব্বীর ইউসুফকে বেহেশত নসিব করেন।
লেখক : প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক