এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটে চলছে তারুণ্যের জয়গান। তরুণ ক্রিকেটারদের ধারাবাহিক পারফরম্যান্সেই একের পর এক সাফল্যের সিঁড়ি পেরিয়ে স্বপ্নের পথে হাঁটছে দেশের ক্রিকেট। তারুণ্যে উড়ছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ক্রিকেট।
সৌম্য-মুস্তাফিজ-তাসকিনদের কিছু দিন আগে কে-ইবা চিনত। অথচ এখন তারা শুধু দেশে নন, ক্রিকেটবিশ্বে রীতিমতো বড় তারকা! এখন অভিষেক ম্যাচ থেকেই বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটার খেলছেন ভয়ডরহীনভাবে। তরুণদের বিস্ফোরক পারফরম্যান্সে ফলটাও আসছে হাতেনাতে। দেশের ক্রিকেট যে এখন সাফল্যের ট্রেনে চড়ে ছুটে চলেছে, এর মূল কারিগর কিন্তু তরুণরা।
সৌম্য সরকার; আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আগমনের এখনো বছর পূরণ হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে বিশ্বসেরা বোলারদের ত্রাসে পরিণত হয়েছেন। কে বোলিং করছেন, বোলিংয়ের গতি কেমন, সুইং কেমন- থোরাই কেয়ার। বোলারকে নাকানি-চুবানি খাওয়ানোই সৌম্যর একমাত্র কাজ। নামে তিনি 'সৌম্য' হলেও ব্যাটিংয়ে ভয়াবহ রকমের আগ্রাসী। এরই মধ্যে তিনটি টেস্ট খেলেছেন। তবে 'ভয়ঙ্কর' সৌম্যকে দেখা গেছে ওয়ানডেতে। ১৬ ওয়ানডেতে গড় পঞ্চাশের (৪৯.৪২) কাছাকাছি, বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ। এক সেঞ্চুরি ও চার হাফসেঞ্চুরিতে ৬৯২ রান করেছেন বাংলাদেশের এই বিস্ফোরক ব্যাটসম্যান।
মুস্তাফিজুর রহমান; সাতক্ষীরার সুপারম্যান, কাটার মাস্টার-উপাধিগুলো এর মধ্যেই পেয়ে গেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রেখেই যেন মহানায়ক! বয়স এখনো কুড়ি পূরণ হয়নি, এরই মধ্যে কাঁপিয়ে দিয়েছেন রেকর্ডবুক। প্রথম তিন ওয়ানডেতেই তিন-তিনটি বিশ্বরেকর্ডের মালিক। প্রথম দুই ওয়ানডেতে ম্যাচসেরা এবং অভিষেক সিরিজে 'সেরা ক্রিকেটার'। ছয় ওয়ানডেতে নিয়েছেন ১৮ উইকেট। টেস্টেও অভিষেকে প্রথম ইনিংসে নিয়েছেন চার উইকেট। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখতে না রাখতেই ব্যাটসম্যানদের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন। দুর্বোধ্য মুস্তাফিজের কাটার- শুধু ব্যাটসম্যানরা নন, আম্পায়াররাও বিভ্রান্ত (এলবিডব্লিউ সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত)।
তাসকিন আহমেদ; দ্য স্পিড স্টার। বাংলাদেশ স্পিননির্ভর দল- তাসকিনের অভিষেকের পর পাল্টে গেছে সেই দৃষ্টিভঙ্গি। ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচ থেকেই ২২ গজে ঝড় তুলছেন। নিয়মিত ১৪০ কিমির ওপরে বল করেন। বাংলাদেশি পেসারের এমন গতি- অবাক ক্রিকেটবিশ্ব! অভিষেক ম্যাচেই ভারতের বিরুদ্ধে নিয়েছেন পাঁচ উইকেট।
সাব্বির রহমান; বিস্ফোরক এক ব্যাটসম্যান। প্রথম দিন থেকেই তিনি প্রতিপক্ষের বোলারদের ওপর চড়াও হয়ে খেলেন। তার ব্যাটেই চলছে 'ভয়ডরহীন ক্রিকেট' এর বিজ্ঞাপন! ওপরের দিকে ব্যাটিং করার সুযোগ পান না। তাতে কী? সাত কিংবা আট নম্বরে ব্যাট করতে নেমেই দেখাচ্ছেন ক্যারিশমা। স্ট্রাইকরেটও একশর ওপরে। ২০ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ব্যাটিং গড় ৩৩-র কাছাকাছি। তবে সাব্বিরের পরিচিতি দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ে। যেন বাংলাদেশের জন্টি রোডস!
তাইজুল ইসলাম; ক্যারিয়ার শুরুই করেছেন বিশ্বরেকর্ড দিয়ে। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ওয়ানডে অভিষেকে হ্যাটট্রিকসহ চার উইকেট নিয়েছিলেন। তবে ওয়ানডেতে তিনি নিয়মিত নন। তাকে টেস্ট স্পেশালিস্ট বোলার হিসেবেই দেখা হয়। ৮ টেস্টে নিয়েছেন ৩৫ উইকেট।
আরাফাত সানি; বাঁহাতি স্পিনার। বোলিংয়ে দুর্দান্ত বৈচিত্র্য। এখনো টেস্ট অভিষেক হয়নি। ১৩ ওয়ানডেতে নিয়েছেন ২২ উইকেট। ব্যাটসম্যানদের চাপে রাখতে তার বোলিং ভীষণ কার্যকর।
জুবায়ের হোসেন লিখন; বাংলাদেশের একমাত্র বিশেষজ্ঞ লেগ-স্পিনার। ওয়ানডেতে তার বোলিংয়ে তেমন চমক দেখা না গেলেও চার টেস্টে নিয়েছেন ১৩ উইকেট। কিন্তু কোচ চন্ডিকা হাতুরাসিংহের বিশ্বাস, ঠিকমতো পরিচর্যা করলে হয়তো এই জুবায়েরই একদিন হয়ে যাবেন 'বাংলাদেশের শেন ওয়ার্ন'!
এ ছাড়া তরুণদের মধ্যে মোহাম্মদ শহীদ, লিটন কুমার দাস কিংবা রনি তালুকদারই বা কম কিসে! দীর্ঘ সময় সঠিক লাইনলেন্থ বজায় রেখে বোলিং করতে সমস্যা হয় না পেসার শহীদের। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে চলতি টেস্টে টানা ছয় ওভার মেডেন করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তিনি। আর ব্যাটিংয়ে দ্যুতি ছড়িয়েছেন লিটন দাস। দ্বিতীয় টেস্টেই তুলে নিয়েছেন হাফসেঞ্চুরি। তবে লিটন দাস প্রশংসায় ভাসছেন তার স্টাইলিস্ট ব্যাটিংয়ের জন্য।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশের সাফল্য-রহস্য কিন্তু এই তরুণ ক্রিকেটারদের আগুনে পারফরম্যান্সই। সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ- সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে যোগ হয়েছে তরুণদের দাপুটে পারফরম্যান্স। আর ধারাবাহিক সাফল্যের নেপথ্যে কারিগর একজনই, যার অনুপ্রেরণায় প্রথম দিন থেকেই তরুণরা নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন, তিনি আর কেউ নন, মাশরাফি বিন মর্তুজা- দ্য অলটাইম এভার ক্যাপ্টেন অব বাংলাদেশ! মাস্টারমাইন্ড- অবশ্যই কোচ চন্ডিকা হাতুরাসিংহে।