শহর থেকে গ্রাম, দেশ থেকে বিদেশে- সবখানে এখন একটাই সুর, দেবীদুর্গার আগমনিবার্তা। আশ্বিনের স্নিগ্ধ নীল আকাশ, শিউলি ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ আর কাশবনের ঢেউ যেন জানান দিচ্ছে মায়ের আসার দিন খুব কাছে। দুর্গাপূজা শুধু একটি উৎসব নয়, এটি বাঙালির হৃদয়ের স্পন্দন, আত্মিক মিলন আর সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। এই উৎসবে নারীর চিরন্তন সাজ সম্পূর্ণ হয় শাড়িতে। ষষ্ঠীর বোধন থেকে বিজয়া দশমীর সিঁদুর খেলা পর্যন্ত প্রতিটি দিনই যেন এক একটি নতুন গল্প, যা লেখা হয় নতুন সাজ আর নতুন পোশাকে। অনেক নারীই এই উৎসবে নতুন শাড়ির সম্ভারে নিজেদের সাজিয়ে তোলেন, যা ঐতিহ্য আর আধুনিকতার এক দারুণ মিশেল।
পূজা মানেই লাল আর সাদার রাজত্ব। লাল হলো উৎসব, আনন্দ ও শক্তির প্রতীক, আর সাদা হলো পবিত্রতা ও স্নিগ্ধতার। মহালয়া দিয়ে পূজার শুরু হলেও আসল আমেজ শুরু হয় ষষ্ঠী থেকে। ষষ্ঠীর সকালে হালকা সাজের সঙ্গে তাঁত, কটন বা জামদানি শাড়ি পরা যেতে পারে। চোখে হালকা আইশ্যাডো আর চিকন লাইনারে সেদিনের সাজটা হয় খুব স্নিগ্ধ। তবে উৎসবের প্রাণবন্ত রূপ দেখা যায় সপ্তমী থেকে। লাল, সাদা, কমলা- এই রংগুলো সপ্তমী আর অষ্টমীর জন্য একদম উপযুক্ত। সপ্তমীর দিনে সুতি বা হাফ সিল্ক শাড়ি এবং রাতে সিল্কের শাড়ি- সঙ্গে সোনা, রুপা বা ইমিটেশনের ভারী গয়না আর হাতভর্তি চুড়ি সাজকে পূর্ণতা দেয়।
অষ্টমীর সাজটা হয় সবচেয়ে জমকালো, কারণ এদিন মনের সব শখ মিটিয়ে সাজা হয়। সাদা, লাল, কাঁচা হলুদ বা গোলাপি রঙের শাড়িতে মেয়েরা হয়ে ওঠে পুরোদস্তুর বাঙালি। শাড়ির সঙ্গে আলতা, ভারী চুড়ি আর একগুচ্ছ তাজা ফুল চুলের বেণিতে বা খোলা চুলে পূজার সাজকে সম্পূর্ণ করে তোলে। আজকাল তরুণীরা শাড়ির পাশাপাশি সালোয়ার-কামিজ বা কুর্তার সঙ্গে জিন্স পরেও ফ্যাশন ট্রেন্ড ধরে রাখে। নবমী মানে ভরপুর আড্ডা ও খাওয়াদাওয়া। এদিন জারদৌসি, পুঁতি বা জরির কাজ করা জর্জেট, কাতান বা সিল্কের শাড়ি পরা যেতে পারে। এই সাজে শরতের নীল আকাশ, কাশফুলের সাদা আর গাছপালার সবুজ রং পোশাকে ব্যবহার করা যায়। গহনায় থাকতে পারে লাল-সাদার ছোঁয়া, যা সাজে এনে দেবে নতুন মাত্রা।
পূজার প্রধান আকর্ষণ বিজয়া দশমী। এদিন লাল-সাদা শাড়ি পরে দেবীকে বিদায় জানানো হয়। গরদের শাড়ি দশমীর সাজে ঐতিহ্যবাহী রূপ যোগ করে। রাতে বেনারসি বা কাতান শাড়ি পরে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া বা নানা আয়োজনে অংশ নেওয়া যায়। শাড়ির সঙ্গে মানানসই ব্লাউজ, জুতো আর গয়না ছাড়া সাজ সম্পূর্ণ হয় না। ঐতিহ্যবাহী সাজে ঝুমকা, টিকলি বা নথের মতো গয়না যোগ করলে পূজার সাজে আসে নতুনত্ব।
তবে নতুন পোশাকের পাশাপাশি পূজার সাজে আজকাল ফিরে এসেছে পুরোনো শাড়ির চল। এটা শুধুই একটি ফ্যাশন ট্রেন্ড নয়, বরং এটি নস্টালজিয়া, আবেগ এবং ঐতিহ্যের প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রতিফলন। পূজা মানেই যখন নিজেকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা, তখন মায়ের, দাদির বা নানির আলমারির এক কোণে যত্নে রাখা শাড়িটি হতে পারে সেই বিশেষ উপকরণ। ফ্যাশন বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেন যে, যখন কেউ এই শাড়ি পরে, তখন সে কেবল একটি স্টাইল স্টেটমেন্টই তৈরি করে না, বরং পূর্বপুরুষদের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে তোলে।
পুরোনো দিনের শাড়িগুলোতে যে নিখুঁত হাতের কাজ দেখা যায়, তা বর্তমান সময়ে দুর্লভ। সেই অলংকরণ, ডিজাইন আজও নজরকাড়া এবং আধুনিক ফ্যাশন ট্রেন্ডের সঙ্গে চমৎকারভাবে মানানসই। এই শাড়িগুলো পরলে এক ধরনের বিশেষ অনুভূতি হয়, যা অন্য কোনো দামি পোশাকে পাওয়া যায় না। ব্যস্ত জীবনে পুরোনো পোশাকগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা কে, কোথা থেকে এসেছি। এটি একটি সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে এবং হৃদয়ে এক ধরনের আবেগিক বন্ধন তৈরি করে। তাই ফ্যাশন যখন কেবল পোশাক নয়, বরং স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হয়ে ওঠে, তখন তার আবেদন হয় গভীর ও অর্থপূর্ণ।