শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিশ্ব কাঁপানো ফরাসি বিপ্লব

ফরাসি বিপ্লব পুরো বিশ্বের রাষ্ট্রব্যবস্থায় অভুতপূর্ব প্রভাব ফেলেছিল। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার কৃষক ও শ্রমজীবীদের আন্দোলনের পথিকৃৎ এই বিপ্লব। ফরাসি বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। এই আন্দোলন সংঘটিত হওয়ার পেছনে ফরাসি দার্শনিক ও সাহিত্যিকদের অসামান্য অবদান রয়েছে। পুরো অষ্টাদশ শতাব্দী ধরে ইউরোপে এক বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। তারই ফলাফলে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে, গণতন্ত্র শব্দটি পায় নতুন মাত্রা।

তানভীর আহমেদ

বিশ্ব কাঁপানো ফরাসি বিপ্লব

 

শতাব্দীজুড়ে চিন্তার দ্বন্দ্ব

 

মানুষের মনকে বেঁধে রাখা যায় না। চিন্তার জগৎ যত প্রসারিত হয় মানুষের জানার আকাক্সক্ষা তত তীব্র হয়। রেনেসাঁ থেকে এনলাইটেনমেন্ট পর্যন্ত যাত্রা মানব সভ্যতার অন্যতম একটি মাইলফলক। বিশেষত যখন মধ্যযুগের ইউরোপে ছিল ধর্মের প্রতাপ। মানব চিন্তার কেন্দ্রে বার বার গুরুত্ব পেয়েছিল ঈশ্বর এবং ধর্মবিশ্বাস। ইতালিতে গোড়াপত্তন করেছিল রেনেসাঁ। মানুষের ভাবনার জগৎ আলোড়িত করেছিল সেটি। রেনেসাঁ গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। মানুষের চিন্তা কেন্দ্র বিশ্বাসভিত্তিক অপেক্ষা শিল্প সাহিত্যের দিকে আকৃষ্ট করেছিল। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, বতিচেলি­, মিকেলেঞ্জেলো, রাফায়েলসহ বহু উলে­খযোগ্য চিত্রশিল্পী ও ভাস্করদের সৃষ্টিকর্মগুলো সে সময়কার। মানুষের চিন্তার জগতেও নতুন ধারার স্রোত এসে মিলিত হয়েছিল। পিকো দেলা মিরানদোলা, ম্যাকিয়েভেলি, টমাস মুরের নাম শুরুতেই আসে। ফরাসি বিপ্লবের আগে প্রায় এক শতাব্দী ধরে ফ্রান্স আলোড়িত হয়েছে পুরনো আর নতুন চিন্তার দ্বন্দ্বে। ফ্রান্সকেন্দ্রিক সংস্কারপন্থি অভিজাত চিন্তাবিদ বস্যুয়ে, মঁতেস্কু, ভলতেয়ার, রুশো, কন্ডসেটের মতো দার্শনিক-চিন্তাবিদ। এসেছেন প্যাসকেল, বু্যঁফ, ল্যাভয়সিয়ের মতো বিজ্ঞানসাধক। আছেন দেনিশ দিদেরো, দালেমব্যার, দোলবাশ, এলভেতিয়াস। অর্থবিজ্ঞানীর তালিকায় আছেন ভ্যাঁসা দ্য গুরনে, মার্কিস দ্য মিরাবোঁ তুর্গো, নেমুর। এ ছাড়া ১৭৭৬ সালে আমেরিকা ব্রিটেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা করলে বহু ফরাসি এ সময় আমেরিকানদের পক্ষে লড়েছিল। তারা যখন দেশে ফিরল তখন জানল, স্বাধীনতার স্বাদ কেমন।

যে কারণে বিপ্লব

বিপ্লব। মানব সভ্যতার পরতে পরতে যুদ্ধ আর বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে আছে। উত্থান আর পতনের গল্প কখনো রোমাঞ্চময় হয়েছে, কখনো হয়েছে বিষাদময়। ফরাসি বিপ্লব শুধু ফ্রান্স নয়, গোটা ইউরোপের চিত্র বদলে দিয়েছিল। মানুষের চিন্তার জগৎ আলোড়িত হয়েছিল। রাজতন্ত্রের পতন হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লব গোটা মানব সভ্যতাকে নতুনভাবে লিখতে ভুমিকা রেখেছে। ফরাসি বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। উনিশ শতকে ফ্রান্স ছাড়িয়ে সারা ইউরোপে নতুন ভাবধারার সূচনা করেছিল এই বিপ্লব। ইতিহাসের দিকে তাকালে ফিরে যেতে হবে ১৪ জুলাই ১৭৮৯ সালে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস সেদিন উত্তপ্ত শ্রমিক, কারিগর, গ্রাম ও শহরের গরিব মানুষের খাদ্যের দাবিতে। এ শুধু নিছকই দাঙ্গা-হাঙ্গামা নয়। প্যারিসের সর্বত্র চলছিল বিক্ষোভ মিছিল। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য রাজার নির্দেশে মিছিলের ওপর অশ্বারোহী বাহিনী চালিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু প্যারিসের সামরিক অধিনায়ক সসৈন্যে সরে দাঁড়ালে রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ জনতার হাতে চলে যায়। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হয়। লুট করা হয় আগ্নেয়াস্ত্রের দোকান। উত্তেজিত জনতা আরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল কারাদুর্গে আক্রমণ করে। উন্মত্ত জনতা কারাগারের বন্দীদের মুক্ত করে এবং কারাগারের অধিকর্তা দ্যলুনেকে হত্যা করে।

ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই এ খবর পেয়ে এক সহচরের কাছে এমন অভিমত প্রকাশ করেন, দ্যাট ইজ এ রিভোল্ট।’ সহচরটি প্রত্যুত্তরে বলেন, স্যার, ইট ইজ নট এ রিভোল্ট, ইট ইজ এ রেভল্যুশন।

প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন আপামর খেটেখাওয়া মানুষগুলো রাজার বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছিল।

ফরাসি রাজতন্ত্র ছিল নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী। রাজার ক্ষমতা বেশি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে এবং তা দিন দিন বাড়তে থাকে। রাজা নিজেকে ঈশ্বর প্রদত্ত ডিভাইন রাইট অব মনারকির প্রতিভু বলে মনে করতেন। রাজা ষোড়শ লুই বলতেন, সার্বভৌম ক্ষমতা আমার ওপর ন্যস্ত, সব আইন প্রণয়নের ক্ষমতাও আমার। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাজার সমালোচনা করলে তাকে গোপন পরোয়ানার আইনে গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। তবে রাজা চতুর্দশ লুই-এর শাসনামলের শেষ ভাগে রাজতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতা চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। এরপর রাজা পঞ্চদশ লুই রাজকার্য পরিচালনার পরিবর্তে বিলাস-ব্যসনেই ব্যস্ত ছিলেন। পঞ্চদশ লুই-এর পরে রাজা  ষোড়শ লুই সিংহাসনে বসে প্রশাসনকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদৌ তিনি পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক ছাড়তে পারেননি। বিশ্বাসভিত্তিক চিন্তাধারার জগৎ থেকে প্রগতির পথে কোনো ফরাসি রাজশাসকই আগ্রহ দেখাননি। পাশাপাশি ছিল রাজপ্রাসাদে রাজাদের উচ্ছৃঙ্খলতা, অমিতব্যয়িতা এবং অভিজাত শ্রেণির প্রাধান্য ও দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। সব মিলিয়ে ফরাসি জনগণকে বিপ্লবমুখী করে তুলেছিলেন ষোড়শ লুই। এ ছাড়া ছিল শাসন বিভাগের বিশৃঙ্খলা ও রাজকর্মচারীদের অত্যাচার। দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল  শাসন ও বিচারব্যবস্থা। তা ছাড়া অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি রাজশক্তি হ্রাস পেয়েছিল। বিশেষ করে সাত বছরব্যাপী যুদ্ধে ইউরোপ, আমেরিকা, ভারত ও ইংরেজদের কাছে ফ্রান্সের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। ফরাসিদের ব্যবসা বাণিজ্য অবনতির ফলে রাজকোষও শূন্য হয়ে পড়েছিল। তবে এসবকেই ইন্ধন জুগিয়েছিল ফ্রান্সের সমাজে শ্রেণি ব্যবধান। অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায় প্রথম শ্রেণিভুক্ত ছিল। মধ্যবিত্ত ও জনসাধারণ ছিল সুবিধাবঞ্চিত ও অধিকারবঞ্চিত শ্রেণি। যাজক সম্প্রদায়ের বিশেষ রাজনৈতিক, বিচার এবং রাজস্ব সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা ছিল। যাজকদের নিজস্ব প্রাসাদ, দুর্গ ও গির্জা ছিল। ফরাসি সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণি ছিল অভিজাতরা। তারা সংখ্যায় নগণ্য হলেও সমাজে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন। তারা রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একচেটিয়া অধিকার ভোগ করতেন। অভিজাতদের শ্রেণিগত সুযোগ-সুবিধা, ভোগ-বিলাস এবং কৃষকদের ওপর শোষণ ও নিষ্পেষণ প্রকৃতপক্ষে শ্রেণি-সংঘাতের ক্ষেত্র গড়ে তুলেছিল। বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত ছিল তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত। রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণ বুর্জোয়া শ্রেণিকে প্রবল প্রতিদ্ব›দ্বী ও বিরোধী করে তোলে। কৃষক ও শ্রমিকরা ছিল সমাজের সর্বনিম্ন স্তরের। রাজস্বের ব্যয়ভার কৃষককেই বহন করতে হতো। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সমানুপতিক হারে আয় বৃদ্ধি না হওয়ায় তাদের আর্থিক সংকট প্রবল আকার ধারণ করে। ফলে কৃষক ও শ্রমিকরা ক্রমেই বিপ্লবমুখী হয়ে ওঠে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচণ্ড বৈষম্য ছিল। এই বৈষম্যের কারণে শ্রেণিগত বিদ্বেষের সূচনা। ত্রুটিপূর্ণ করনীতি ছাড়াও মুদ্রাস্ফীতির পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। সর্বশেষ আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ ফ্রান্সের আর্থিক কাঠামোর ওপর উলে­খযোগ্য আঘাত হানে। তবে শুধু মানুষের ইচ্ছানুযায়ী কখনো বিপ্লব ঘটে না। পুরো অষ্টাদশ শতাব্দী ধরে ইউরোপে এক বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটে। এই চেতনা রোমান ক্যাথলিক চার্চের চিরাচরিত ক্ষমতা, রাজার স্বৈরাচারী ক্ষমতা এবং অভিজাতদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদির বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী সমালোচনার প্রসার।

 

বিলাসিতায় ডুবে ছিল ভার্সাই রাজপ্রাসাদ

স্বেচ্ছাচারিতা আকাশ ছুঁয়েছিল। ফরাসি রাজতন্ত্র জনমানুষের জীবনকে দুরূহ করে তুলেছিল। বেঁচে থাকাই ছিল তাদের সংগ্রাম। পেটে ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে সামান্য আয়ে যখন মিলছিল না খাবার তখন রাজপথে নেমে এসেছিল তারা। উল্টো দৃশ্য তখন রাজপ্রাসাদে। রাজপরিবার যেন ছিল গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। সাধারণ মানুষের হাহাকার আর ক্ষুধার যন্ত্রণা তাদের স্পর্শও করতে পারেনি। বিলাস ব্যসন ও রাজপরিবারের অমিতব্যয়িতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা ফরাসি জনগণকে বিপ্লবের দিকে ধাবিত করেছিল। ভার্সাই রাজপ্রাসাদ তখন যেন ঐশ্বর্যের ইন্দ্রপুরী। ১৮ হাজার কর্মচারী রাজপরিবারের সেবায় সর্বদা নিযুক্ত থাকত। সভাসদদের মধ্যে কোটি কোটি মুদ্রা পুরস্কার হিসেবে বিতরণ করা হতো। কয়েকটি হিসাব পাওয়া যায় যেখানে দাবি করা হয়, ১৭৮৯ সালে ভার্সাই রাজপ্রাসাদে বিলাসী কর্মকাণ্ডে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। রাজা, রানী ও তাদের সন্তান-সন্ততি এবং অগণিত আত্মীয়স্বজন সবার জন্য পৃথক পৃথক সুরম্য অট্টালিকা ছিল। এক হিসাবে বলা হয়, রানী মেরি অ্যান্টয়নেটের নিজস্ব সহচরীর সংখ্যা ছিল ৫০০। রাজা, রানী, রাজকুমার ও রাজকুমারীদের প্রমোদভ্রমণের জন্য রাজদরবারে প্রায় দুই হাজার ঘোড়া ও ২০০ অশ্বশকট সব সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকত। এসব বিষয় ফরাসি জনগণের মধ্যে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, ৫ অক্টোবর প্যারিস থেকে মহিলাদের ভুখামিছিল বা হাঙ্গার মার্চ অব দ্য ওমেন ভার্সাই রাজপ্রাসাদের কাছে পৌঁছে রুটির দাম কমানোর দাবি জানায়। তখন রানী মেরি অ্যান্টয়নেট অবাক হয়ে মিছিলের দিকে তাকিয়ে জানতে চান, এরা কী চায়? তার সহচরী উত্তর দেন, এরা রুটির দাম কমাতে বলছে, রুটি চায়। রানী অবাক হয়ে বললেন, রুটি কেন? এরা কেক খেতে পারে না! প্রকৃতপক্ষে রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে বিলাস ব্যসনে জীবনযাপন করে রানী অ্যান্টয়নেট নিজ দেশের সাধারণ মানুষের জীবন সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেননি।

বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ

 

১৭৮৯ সালের হিসাবে ফ্রান্সের ৮৫ শতাংশ মানুষ গ্রামাঞ্চলে থাকত। তার মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ ছিল কৃষক। অথচ চাষযোগ্য জমির অধিকাংশ ছিল গির্জা ও সামন্তপ্রভুদের হাতে- প্রায় ৩০ শতাংশ। যদিও তারা ছিল জনসংখ্যার মাত্র ২ ভাগ। এ ছাড়া বিপ্লবের সময়টাতে ফ্রান্সে প্রায় ১০ লাখের মতো ভুমিদাস ছিল। মাঝেই মাঝেই দেখা দিত অজন্মা। একজন ইতিহাসবিদ লিখেছিলেন, ফ্রান্সে ৯ দশমাংশ লোক অনাহারে মারা যায়, আর এক দশমাংশ মরে অতি ভোজনের ফলে। এ ছাড়া ছিল কর বা খাজনার জন্য নির্যাতন। সাধারণ মানুষকে রাজার আরোপ করা কর, গির্জা কর্তৃক আরোপ করা কর, ভুস্বামী বা জমিদারদের আরোপ করা কর দিতে হতো। আইনও ছিল গরিবের বিপক্ষে। তাদের বিচার করার সময় সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে ততটা মাথা ঘামানো হতো না। সব মিলিয়ে জ্বলে ওঠে বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

ভার্সাইয়ে নারী সম্মেলন

 

ফরাসি বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ভার্সালিসে নারী সম্মেলন। ১৭৮৯ সালের ১ থেকে ৫ অক্টোবরের মধ্যবর্তী সময়ে প্রায় ৭ হাজার নারী ভার্সালিসে বিভিন্ন দাবিতে সম্মেলন করেন। এ সম্মেলনের মাধ্যমে তারা বিদ্রোহীদের আন্দোলনের সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেন। এতে বিপ্লবের গতি অনেক বেগবান হয়। রাতারাতি এ আন্দোলন রাজপরিবারকে কোণঠাসা করে ফেলে। যে কারণে ৬ অক্টোবর রাজা ও রাজপরিবার ভার্সালিস থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে প্যারিসে প্রস্থান করেন।

 

 

বাস্তিল দুর্গের পতন

 

‘নাগরিক গার্ড’ রাজতন্ত্রের অহংকার বাস্তিল দুর্গ পতনে কার্যকরী ভুমিকা রেখেছিল।  বিশেষ করে ১৭৮৯ সালের ১১ জুলাই জনপ্রিয় মন্ত্রী নেকারকে পদচ্যুত করা হলে তৃতীয় সম্প্রদায় ‘নাগরিক গার্ড’ নামক একটি সামরিক বাহিনী গঠন করে। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বিদ্রোহীরা অস্ত্রাগার লুটের সময় বাস্তিল দুর্গের দিকে নজর দেয়। এ দুর্গটি ছিল ঐতিহ্যগতভাবে ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের প্রতীক। এ দুর্গে রাজবন্দী এবং বিপুলসংখ্যক রাজকীয় সৈন্য অবস্থান করত। কয়েক ঘণ্টা সংঘর্ষের পর বিকালে বিদ্রোহীরা এ দুর্গ ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। এ যেন পুরো রাজতন্ত্রের পতনের সাক্ষী। এ সময় দুই পক্ষের সংঘর্ষে ৯৮ জন বিদ্রোহী এবং ৮ জন রাজকীয় সিপাহি নিহত হন। আধুনিক ফ্রান্সের জনগণ এ দিনটিকে প্রতি বছর জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করে।

 

রাজার মৃত্যুদণ্ড

ষোড়শ লুই ও তার স্ত্রী মারি অ্যান্তনে। ফরাসি বিপ্লবের ট্র্যাজেডি তাদের ঘিরেই। রাজা ও রানীর স্বৈরাচারিতা, বিলাসিতা ও রাষ্ট্র পরিচালনায় দুর্নীতি পুরো রাজপরিবারকে সাধারণ জনগণের প্রতিপক্ষ করে তোলে। আন্দোলন দানা বাঁধে। বিদ্রোহীদের কাছে শেষ পর্যন্ত বন্দী অবস্থায় উপনীত হন রাজা ষোড়শ লুই। ক্ষমতা হারানোর সুবাস পেতে শুরু করেন। আন্দোলনকারীদের কাছে কার্যত বন্দী রাজা ষোড়শ লুইয়ের বিচার শুরু হয়। ১৭৯৩ সালের ২১ জানুয়ারি শতসহস্র জনতার সম্মুখে রাজা ষোড়শ লুইসকে গিলোটিনে শিরোচ্ছেদ করা হয়। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সময় আয়োজিত ভোটে ৩৬১ জন মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে এবং ২৮৮ জন বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। অন্যদিকে তার স্ত্রীকেও বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। ফ্রান্সের কুইন মারি অ্যান্তনের বিলাসিতার জন্য অনেকেই অপছন্দ করতেন। এ ছাড়া দুর্নীতির কলকাঠি আড়ালে থেকে তিনিই নাড়তেন বলে জনগণের অভিযোগ ছিল। বিচারের পর ১৬ অক্টোবর রানীর ক্ষেত্রেও একই শাস্তি কার্যকর করা হয়।

 

 

ফরাসি বিপ্লবে চট্টগ্রামের ছেলে

 

 

ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক দাসের নাম। তার পরিচয় শুধু দাস নয়, সে একজন বিপ্লবী। তার নাম জামর। ১৭৭৩ সাল। চট্টগ্রাম উপক‚লে ইংরেজ দাস-ব্যবসায়ীদের হাতে ধরা পড়েছিল সে। তখন বয়স সবে মাত্র ১১। জাহাজে করে তাকে পাচার করা হয়। গন্তব্য মাদাগাস্কার। সেখান থেকে ফ্রান্স। এই দাসকে কিনে নেন ফরাসি সম্রাট পঞ্চদশ লুই। জামর পড়তে জানতেন। জামর পড়ছিলেন জাঁ জাক রুশোর বই। রুশোর দর্শন তাকে বিদ্রোহী করে তুলল। ধীরে ধীরে আগ্রহ বাড়ল রাজনীতিতে। এরই ফাঁকে একবার গোপনে যোগাযোগ হলো জ্যাকবপন্থি বিপ্লবীদের সঙ্গে। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব শুরু হলে জামর হলেন কমিটি অব পাবলিক সেফটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।

বিপ্লবীদের হাতে সম্রাটের পতন ঘটল। ৬ ডিসেম্বর ১৭৯৩ সালে মাদাম বারি গ্রেফতার হলে সাক্ষী হিসেবে  হাজির করা হয় জামরকে। আদালতে দাঁড়িয়ে জামর নিজের সত্যিকারের পরিচয় প্রকাশ করল। বলল, আমি আফ্রিকার নই, চট্টগ্রামের ছেলে। দাস-ব্যবসায়ীরা আমাকে মাদাগাস্কার নিয়ে যায়। সেখান থেকে নিয়ে আসে ফ্রান্সে।’ ফরাসি লেখিকা ইভ রুজিয়ের তার লো রেভ দো জামর বা জামরের স্বপ্ন (২০০৩) উপন্যাসের মুখবন্ধে বলেছেন, কৈশোরে ভারতের দক্ষিণের বেলাভুমিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় জামরের জীবন। সাগর-মহাসাগর আর দ্বীপের বন্দরে বন্দরে কেটেছে জীবনের একটা সময়। দাস হিসেবে সে এসে পৌঁছায় কাউন্টেস বারির কাছে। কৃষ্ণাঙ্গ এ তরুণ এক সময় হয়ে ওঠে ভার্সেইবাসীর চোখের মণি।

মাদাম দ্য বারি এবং দ্য ওয়েজ অব বিউটির লেখিকা জন হাসলিপ বলেছেন, বিপ্লবের সময় জামর প্যারিস রয়্যাল ক্যাফেতে যাতায়াত করত। ইংরেজ বিপ্লবী জর্জ গ্রিভের সঙ্গে সেখানে তার বন্ধুত্ব হয়। জামরের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন ফ্রান্সের সে সময়ের কয়েকজন শিল্পী। তেমনই একটি প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন ফরাসি নারী-শিল্পী মারি-ভিক্তোয়ার লোমোয়ান। গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের জামরকে কৃষ্ণাঙ্গ বলে মনে হয়। জামরের জীবনতথ্য নিয়ে ১৯৭৮ সালে ফ্রান্স থেকে বেরিয়েছে লা রু পের্দ্যু নামে একটি কমিক উপাখ্যান। ১৮২০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি জামর মারা যায়।

 

ইউরোপের নতুন অধ্যায়

 

 

ফরাসি বিপ্লব এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিল। বিশেষত রাজতন্ত্রের পতন ও বিশ্বাসভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনে। ইউরোপের রাষ্ট্রব্যবস্থায় ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ইউরোপ তো বটেই, সারা পৃথিবীর মোড় ঘুরে যায় ফরাসি বিপ্লবের ফলাফলে। এখন বিশ্বের বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী রাষ্ট্রব্যবস্থার সুফল ভোগ করছে।

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্র শব্দটি অর্থবহ হয়ে ওঠে ফরাসি বিপ্লবের পর। রাজা ষোড়শ লুইকে প্রতিভু থেকে সাধারণ নাগরিক লুইতে পরিণত করার পর, জাতি শব্দটি তার সার্বভৌমিক পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল।   বিপ্লবের পর একটি মাত্র নির্দিষ্ট আইন ও বিচারব্যবস্থার পুরো ফ্রান্সকে নিয়ে আসা হয়। ফরাসি বিপ্লবের যুগান্তকারী ঘটনাটি ইউরোপে এক অবিশ্বাস্য ওলটপালট ঘটিয়েছিল।

এ সময় থেকেই ‘গণতন্ত্র’ হয়ে উঠল এক আন্দোলন, এক যুদ্ধ, যা নিছক রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। বিপ্লবের পর নাগরিকদের নিজ নিজ পেশা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা, সব সরকারি পদে নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়োগ এবং নিয়মিত নির্বাচন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোকে জোরদার করেছিল। এর পাশাপাশি ফ্রান্সে কার্যকর করা হলো রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি। বিপ্লবী সরকার কর্তৃক নাগরিকদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো। ফরাসি বিপ্লব আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। সেটি হলো মেট্রিক পদ্ধতি চালু।

 

 

নেপোলিয়নের উত্থান

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। ফরাসি বিপ্লব তুঙ্গে। ফরাসি বিপ্লবে তিনি একক আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হন। তার যুদ্ধকৌশল সবার নজর কাড়ে।

নেপোলিয়ন তখন একজন জেনারেল। বিপ্লবের রেশ তখন বিশ্বব্যাপী। যোদ্ধা নেপোলিয়নের উত্থান সে সময়। নেপোলিয়ন ফরাসি প্রজাতন্ত্রের প্রথম কনসল ছিলেন। নেপোলিয়নের বয়স যখন মাত্র ৯ তখন তাকে একটি ফরাসি মিলিটারি স্কুলে ভর্তি করানো হয়। বিদ্যালয়ে ভর্তির আগে তাকে ফরাসি ভাষা শিখতে হয়েছিল। ১৭৮৫ সালে ডিগ্রি লাভ করে নেপোলিয়ন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে ভুষিত হন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৬। ১৭৮৯ সালের বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত নেপোলিয়ন ভ্যালেন্স এবং এক্সনে সেনারক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী অধিকাংশ বছর তিনি করসিকাতে অতিবাহিত করেন। তখন সেখানে রাজবংশীয়-বিদ্রোহী-সাধারণ কর্সিকানদের মধ্যে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব চলছিল। নেপোলিয়ন জ্যাকোবিনের ফ্যাকশনকে সমর্থন করেন এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে ভুষিত হন। ১৭৯৬ সালের ২৭ মার্চ নেপোলিয়ন ফরাসি আর্মি অব ইতালির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সফলতার সঙ্গে ইতালি আক্রমণ করেন। ১১ নভেম্বর, ১৭৯৯ থেকে ৬ এপ্রিল ১৮১৪ পর্যন্ত ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন এবং পুনরায় ১৮১৫ সালের ২০ মার্চ থেকে ২২ জুন পর্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন। তিনি ইতালির রাজাও ছিলেন। এ ছাড়া তিনি সুইস কনফেডারেশনের মধ্যস্থতাকারী এবং কনফেডারেশন অব রাইনের রক্ষকও ছিলেন। তার নেতৃত্বে ফরাসি সেনাবাহিনী এক দশকের বেশি সময় ধরে সব ইউরোপীয় শক্তির সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং তিনি ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চল তার আয়ত্তে নিয়ে আসেন।

সর্বশেষ খবর