বৃহস্পতিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

পারস্য সাম্রাজ্যের জানা অজানা ইতিহাস

সাইফ ইমন

পারস্য সাম্রাজ্যের জানা অজানা ইতিহাস

পারস্য ইরানের প্রাচীন নাম। ইরান পৃথিবীর প্রাচীনতম কাল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত অস্তিত্বশীল বৃহৎ সভ্যতাগুলোর অন্যতম। ইরানের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের। এর সূচনা হিসেবে বলা যায়, ইরানি প্লেটে অবস্থিত আজারবাইজানের মানইয়ান সভ্যতা।  এর পর আসে জাবোলের শহর-ই-সোখতা সাম্রাজ্য। ঐতিহাসিকদের মতে, এলাম সাম্রাজ্য এবং আকিমেনিড সাম্রাজ্য দ্বারা শহর-ই-সোখতা সাম্রাজ্য প্রতিস্থাপিত হয়।  পরবর্তীতে আসে পারস্য এবং সাসানীয় সাম্রাজ্য; যার পতনের মাধ্যমেই আধুনিক ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের অভ্যুদয় ঘটে। পারস্য সাম্রাজ্যের আদ্যোপান্ত নিয়েই আজকের রকমারি...

 

যেভাবে সূচনা

পারস্য শব্দটি এসেছে পার্স থেকে। এটি প্রাচীনকালের একটি ভাষার নাম। প্রাচীন পারস্যে ছিল প্রাচীন নিনেভের অসিরীয় সাম্রাজ্যের অধীনে। খ্রিস্টের জন্মের পাঁচ/ছয় শ বছর আগে পারসিয়ানরা অসিরীয়দের হটিয়ে নিনেভ দখল করে নেয়। ইরানিরা জাতিতে ছিলেন আর্য। এরপর পারস্যবাসী আর্যরা এক বিরাট সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। এই রাজ্যের বিখ্যাত রাজাদের নাম ছিল কাইরাস, দারিয়ুস, জেরোক্সিস। ইতিহাসে এরা আকিমেনিড রাজবংশ নামে পরিচিত। ২২০ বছর এই বিশাল সাম্রাজ্য পারসিয়ান আর্যরা শাসন করে। এরপর মেসিডোনিয়ান সম্রাট আলেকজান্ডার এই সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দেন। এই অঞ্চলে মূলত আর্য জাতির বিভিন্ন গোত্র খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের দিকে ইরানীয় মালভূমিতে বসতি স্থাপন করে। এদের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মেদেস ও পারসিক গোত্রদ্বয়। মেদেস গোত্রীয় লোকেরা মালভূমির উত্তর-পশ্চিম অংশে বাস করা শুরু করেন। পারসিক জাতির লোকেরা ঊর্মিয়া হ্রদের পশ্চিমের পার্সুয়া নামের অঞ্চল থেকে এসেছিল। এরা ইরানীয় মালভূমির দক্ষিণ অংশে বসবাস শুরু করে এবং অঞ্চলটির নাম দেয় পার্সুমাশ। পারসিকদের প্রথম বড় নেতার নাম ছিল হাখ’মানেশ। তিনি ৬৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ জীবিত ছিলেন।

 

আকিমেনিড সাম্রাজ্যের উত্থান

ইতিহাসে সাইরাসের নাম চির সমুজ্জ্বল। তাঁকে বলা হয় সাইরাস দি গ্রেট। ঐতিহাসিকদের মতে, সর্বকালের সেরা একজন শাসক ও বিজেতা হিসেবে তাঁকে বিবেচনা করা হয়। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ অব্দে মেডেসদের শাসন কর্তৃত্ব উৎখাত করেন। তিনি মেডিয়াকে তাঁর সাম্রাজ্যের প্রথম প্রদেশ ঘোষণা করেন। এরপর সাইরাসের রাজ্যই পারস্য সাম্রাজ্য নামে  বিশ্বে পরিচিত হয়। সাইরাস তাঁর জীবদ্দশায় এই সাম্রাজ্যকে ইতিহাসের অন্যতম বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, দুটি বৈশিষ্ট্য সাইরাসকে সাধারণ যোদ্ধা ও রাজাদের থেকে পৃথক করেছে। প্রথমত, তিনিই প্রথম ইরান দেশ সৃষ্টি করার কথা কল্পনা করেন। ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে ইরান বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দ্বিতীয়ত, সাম্রাজ্যের গঠন-প্রকৃতি সম্পর্কে সাইরাস অত্যন্ত জ্ঞানদীপ্ত ধারণা পোষণ করতেন। সাইরাসের আকিমেনিড সাম্রাজ্য এক রাজনৈতিক এককে পরিণত হয়। সে সময় কৃষিনির্ভর অর্থনীতির যুগে কৃষিতে অনগ্রসর ছিল পারস্য। তাই রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে অধিকতর সম্পদের প্রত্যাশায় সাইরাস সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হয়েছিলেন।

 

২০০ বছর ছিল গ্রিকদের নিয়ন্ত্রণে

৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট জারজিসের গ্রিস অভিযানের পর থেকেই রাজকোষ খালি হতে থাকে। এ সময়ই উত্থান ঘটে দিগি¦জয়ী গ্রিক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের। সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুসের সঙ্গে তাঁর কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের হাতে পতন ঘটে প্রতাপশালী এই সাম্রাজ্যের। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে পারস্যে অনেক বিপ্লব ঘটে। শেষ পর্যন্ত মেসিডোনিয়ার রাজা আলেকজান্ডার ৩৩৪ থেকে ৩৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ করেন এবং সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুসের সৈন্যদের পরাজিত করে পারস্য বিজয় করেন। পারস্য আলেকজান্ডারের বিশাল সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। এরপর ২০০ বছর গ্রিকরা পারস্য নিয়ন্ত্রণ করেন। আলেকজান্ডার সেনাবাহিনীতে বহু পারসিক সেনাকে অন্তর্ভুক্ত করে নেন এবং তাঁর নির্দেশে সব গ্রিক উচ্চপদস্থ সেনা অফিসাররা পারসিক মহিলাদের বিয়ে করেন। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যু হলে তাঁর সেনা নেতাদের মধ্যে পারস্যের সিংহাসন দখলের লড়াই শুরু হয়। পরবর্তী কয়েক বছরে সংঘটিত বেশ কিছু যুদ্ধের পর সুবিশাল মেসিডোনীয় সাম্রাজ্য ক্যাসান্ডার, প্রথম টলেমি, লাইসিম্যাকাস এবং সেলুকাস নিকেটর- এই চারজন জেনারেলের মাঝে ভাগ হয়ে যায়। ক্যাসান্ডার পেয়েছিলেন গ্রিস, প্রথম টলেমি মিসর, লাইসিম্যাকাস থ্রেস এবং সেলুকাস নিকেটর পেয়েছিলেন পারস্য, মেসোপটেমিয়া এবং মধ্য এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ। সেলুকাস পূর্বে সিন্ধু নদ থেকে পশ্চিমে সিরিয়া ও এশিয়া মাইনর পর্যন্ত বিশাল এলাকার রাজা ছিলেন। পরবর্তীতে সেলুকাসের বংশধররা পারস্য সাম্রাজ্যজুড়ে সেলুকাসীয় রাজবংশ গঠন করেন।

 

শিল্পকলায় শীর্ষে

শিল্পকলায় পারসিয়ানরা বরাবরই শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছিলেন সে সময়। তৎকালীন সময়ে ধর্ম, সংস্কৃতি, স্থাপত্যশিল্প, কলা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি প্রভৃতিতে তাদের অবদান ছিল অন্যতম সেরা। এদিক থেকে তারা নিজেদের বৈশ্বিক কেন্দ্র হিসেবে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পারসিয়ানরা ধাতবশিল্প, বস্ত্রশিল্প, শৈলস্থাপত্যশিল্পসহ আরও অনেক কিছুতে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। বিশেষ করে সে সময়ের পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে বিভিন্ন ভাস্কর্য, সমাধিক্ষেত্র এখনো বিদ্যমান। মাত্র ১৬ বছর বয়সে পারস্যের শাসনভার গ্রহণ করা প্রথম আব্বাস ইসফাহান শহরকে তাঁর রাজধানী ঘোষণা করেন। তাঁর শাসনামলে ইসফাহান বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর একটি শহরে পরিণত হয়। আব্বাসের আমলে শিল্পকলায় পারস্যের কীর্তি শীর্ষে আরোহণ করে। আলোকিত পান্ডুলিপি, মৃৎশিল্প, চিত্রকলা এর সবই বিকাশ লাভ করে। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ও ইংরেজরা বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে পারস্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। আব্বাস একজন উদারমনা ও সহিষ্ণু শাসক ছিলেন। এ ছাড়াও পারস্যে নানা সময়ে নানা গুণীজনের আবির্ভাব ঘটেছে। শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলায় পারস্য এক সময় পুরো বিশ্বকে প্রতিনিধিত্ব করেছে। যুগের পর যুগ এই অধিপত্য ধরে রেখেছিলেন পারসিয়ানরা। সেই সময়ের জ্ঞানী-গুণীরা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে চালকের আসনে আসীন হন। ইসলাম-পূর্ব যুগেও জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ইরানিরা এতটা এগিয়ে ছিল যে, তা সভ্যতাকে নানাভাবে করেছে প্রভাবিত। ইসলাম-পূর্ব যুগের কাব্য ও সাহিত্যের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে প্রাচীন কিলকিয় ভাষা, পাহলভি, আভেস্তা ও আরামি ভাষায়।

 

মহানবী (সা.)-এর চিঠি ও মুসলমানদের পারস্য জয়

মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবিত থাকা অবস্থায়ই পারস্য সাম্রাজ্যের  অধীন ইয়েমেনের শাসনকর্তা বাজান ও তাঁর লোকজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ফলে ইয়েমেন মুসলমানদের আওতায় চলে আসার মাধ্যমে পারস্য বিজয়ের সূচনা হয়েছিল...

মুসলিমদের পারস্য বিজয় ৬৫১ সালে সাসানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। এই বিজয়ের ফলে ইরানে জরস্ট্রিয়ান ধর্মের প্রভাব কমে আসে। মুসলিমরা ৬৩৩ সালে সাসানীয় অঞ্চলে আক্রমণ করেন। এ সময় খালিদ বিন ওয়ালিদ বর্তমান ইরাকের অংশ মেসোপটেমিয়ায় হামলা চালান। তৎকালীন সময় এই অঞ্চল ছিল সাসানীয় সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র। ৬৩৬ সালে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে দ্বিতীয় পর্যায়ের অভিযান শুরু হয়। ৬৪২ সালে খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব সাসানীয় সাম্রাজ্যে পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণের নির্দেশ দেন। ৬৫১ সালে এই জয় সম্পন্ন হয়। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, একবার

পারস্য সম্রাট মহানবী (সা.)-এর প্রেরিত চিঠি ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলেছিল। এ ঘটনা শুনে মহানবী (সা.) মুসলমানদের হাতে পারস্য বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। মহানবীর ওফাতের অল্প দিনের মধ্যেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়। মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবিত থাকা অবস্থায়ই পারস্য সাম্রাজ্যের অধীন ইয়েমেনের শাসনকর্তা বাজান ও তাঁর লোকজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ফলে ইয়েমেন মদিনাভিত্তিক রাষ্ট্রের আওতায় চলে আসার মাধ্যমে পারস্য বিজয়ের সূচনা হয়েছিল। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে পারস্য সাম্রাজ্যের প্রভাবিত এলাকা বাহরাইনের শাসনকর্তা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় বাহরাইনও মদিনাভিত্তিক রাষ্ট্রের অধীনে চলে আসে। এক সময় কিরমান, মাকরান, সিস্তান, খোরাসান, আজারবাইজান প্রভৃতি অঞ্চল একে একে মুসলমানদের অধীনে চলে আসে। এভাবে মুসলমানদের পারস্য বিজয় সম্পর্কে মুহাম্মদ (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়। এরপর পারস্যে রচনা হয় মুসলমানদের বিজয়গাথা।

 

সাইরাস দি গ্রেট বা মহান কুরুস

ইতিহাসে সাইরাস মহান কুরুস নামেও খ্যাত। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি ছিলেন মিডিয়ার শেষ রাজার জামাতা। কারও কারও মতে, তিনি ছিলেন তাঁর নাতি। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই পারসিক জাতিকে তাঁর শাসনাধীনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। সর্বকালের সেরা একজন শাসক ও বিজেতা হিসেবে তাঁকে বিবেচনা করা হয়। সে সময় সাইরাস আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। প্রাচীন পারস্যের গোত্রীয় প্রশাসন ও আধিপত্য ভেঙে স্থাপন করেন আকিমেনিড সাম্রাজ্য। পিতার পর উত্তরাধিকার হিসেবে পারসিক প্যাসারগাদেই গোত্রের অধিপতি হন সাইরাস। আকিমেনিড বংশটা ছিল মূলত তারই অন্তর্ভুক্ত। প্রথম দিকে সাইরাস মিডিয়ার রাজা ও নানা আসটিয়াজেসের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক বজায় রাখেন। কিন্তু ৫৫৩ খ্রিস্টপূর্বের দিকে বিদ্রোহ করেন। সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হলে উভয়পক্ষে মুখোমুখি দুই দফায় মোকাবিলা হয় এবং সাইরাস বিজয়ী হন।

 

দারিয়ুস দি গ্রেট ও পাহাড়ের সমাধি

খ্রিস্টপূর্ব ৫২২ থেকে ৪৮৬ সালের মধ্যবর্তী সময়কালে তখন প্রাচীন পারস্যের আখমেনীয় সাম্রাজ্যের রাজা ‘দারিয়ুস দি গ্রেট’ সিংহাসনে জাঁকিয়ে বসেছেন। বিচক্ষণতায় তিনি ছিলেন সময়ের শীর্ষে। চারিদিকে নানা রাজ্য জয় করে চলেছেন। এমন সময় নিজের সমাধি তৈরি করেন তিনি। আখমেনীয় সাম্রাজ্যের সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজধানী পার্সেপলিসের কাছেই এক সুউচ্চ পর্বতের চূড়ায় তৈরি করেন নিজের সমাধি। এর মধ্য দিয়ে তৈরি হলো প্রাচীন পারস্য সভ্যতার এক আশ্চর্য নিদর্শন যা নাকশে রুস্তম নামেই পরিচিত। প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানী পার্সেপলিস থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এই রহস্যময় রাজসমাধি নাকশে রুস্তম। নাকশে রুস্তম অর্থ ‘রুস্তমের চিত্র’। এটি মূলত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ বা পঞ্চম সালের দারিয়ুসসহ চার আখমেনীয় রাজা ও তাঁদের পরিবারের কবরস্থান। দারিয়ুস দি গ্রেট, তার তিন বংশধর জারজেস, আর্তাজারজেস ও দ্বিতীয় দারিয়ুস- মোট চারজনের সমাধি রয়েছে এখানে। বর্তমানে এখানে প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে।

 

পারস্যের ঐতিহাসিক যত কবি সাহিত্যিক

পারস্যে অনেক ঐতিহাসিক কবি সাহিত্যিকদের দেখা মিলেছে। ফারসি মহাকাব্য ‘শাহনামা’র রচয়িতা মহাকবি ফেরদৌসি। ৯৪০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর-পূর্ব ইরানের তুস শহরের কাছে পাজ গ্রামে ফেরদৌসি জন্মগ্রহণ করেন। আরও একজন পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম। তাঁকে বলা হয় ইসলামী স্বর্ণযুগের শ্রেষ্ঠ কবি। একই সঙ্গে তিনি একজন দার্শনিক, গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদ। শেখ সাদিও পারস্যের কবি। শিরাজ শহরে ১২১০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কবি হাফিজও পারস্যের। তাঁর জন্ম-মৃত্যুর সঠিক তথ্য নিয়েও রয়েছে নানা মত। ইরানিরা কবিকে আদর করে ‘বুলবুল-ই-শিরাজ’ বলতেন। মাওলানা রুমী ১৩শ শতাব্দীতে পারস্যের একজন প্রখ্যাত কবি, আইনজ্ঞ, ইসলামী ব্যক্তিত্ব, ধর্মতাত্ত্বিক, অতীন্দ্রিয়বাদী এবং সুফি ছিলেন।

 

শ্বেত অভ্যুত্থান ও ইসলামিক প্রজাতন্ত্র

মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ১৯১৯ সালের ২৬ অক্টোবর তেহরানে জন্মগ্রহণকারী ইরানের শাহানশাহ ছিলেন। ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের ফলে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। ইরান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় ও পাহলভি পরিবারের সর্বশেষ সম্রাট ছিলেন তিনি। রেজা পাহলভি ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী তাজ উল-মুলক দম্পতির সন্তান তিনি। ১১ বছর বয়সে ইনস্টিটিউট লে রোজে নামের একটি সুইস বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হন। চার বছর অধ্যয়নের পর ১৯৩৬ সালে হাইস্কুলের ডিপ্লোমা নিয়ে ইরানে ফিরে আসেন। এরপর তেহরানের স্থানীয় সামরিক একাডেমিতে নিবন্ধিত হন এবং ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪১ সালে তিনি ক্ষমতায় আসেন। এ সময় অ্যাংলো-সোভিয়েত বাহিনী তাঁর বাবা রেজা শাহকে জোরপূর্বক ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করান। তাঁর আমলে সংক্ষিপ্তকালের জন্য ইরানের তেলশিল্প জাতীয়করণ করা হয়। শাসক হিসেবে অর্থনীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্গঠনকে ঘিরে শ্বেত অভ্যুত্থানের প্রবর্তন করেন। ধর্ম নিরপেক্ষবাদী মুসলিম হিসেবে তিনি শিয়াদের সমর্থন হারানোসহ শ্রমিক শ্রেণি, বাজারি নামে পরিচিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষ, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায়, দুর্নীতিতে শাসকগোষ্ঠীর জড়ানোয় তাঁর জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিতর্কিত নীতি গ্রহণ, সমাজতান্ত্রিক দল তুদেহ পার্টি নিষিদ্ধকরণ ও গোয়েন্দা সংস্থা সাভাককে রাজনীতিতে জড়ান। রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৮ সালে ২ হাজার ২০০ রাজনৈতিক কর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়। যার ফলে ইসলামিক অভ্যুত্থান ঘটে। রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে ১৭ জানুয়ারি ১৯৭৯ সালে বিপ্লব সংঘটিত হয়। ইরানীয় রাজতন্ত্রের আনুষ্ঠানিকভাবে বিলোপ ঘটে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে।

 

প্রাচীন পারস্য থেকে আজকের ইরান

নিনেভের অসিরীয় সাম্রাজ্যের অধীনে

প্রাচীন পারস্যের কথা বললে প্রথমেই বলতে হয় অসিরীয় সাম্রাজ্যের কথা। পারস্য ছিল প্রাচীন নিনেভের অসিরীয় সাম্রাজ্যের অধীনে। খ্রিস্টের জন্মের পাঁচ/ছয় শ বছর আগে এই ইরানি বা পারসিকরা তাঁদের প্রভু অসিরীয়দের হটিয়ে নিনেভ দখল করে নেন। ইরানিরা জাতিতে ছিলেন আর্য। 

 

দারিয়ুসের আকিমেনিড রাজবংশের অবসান

দ্য গ্রেট দারিয়ুসকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে পারস্যে আকিমেনিড রাজবংশের অবসান হয়। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর রাজ্য সেনাপতিরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন।

 

সাসানিদ রাজবংশ আকিমেনিড রাজাদের উত্তরসূরি

খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে পারস্যে আবার জাতীয় জাগরণ এলে ক্ষমতায় আসে সাসানিদ রাজবংশ। এরা নিজেদের প্রাচীন আকিমেনিড রাজাদের উত্তরসূরি ঘোষণা দেয়। এ সময় আসে পারসিয়ান উগ্র জাতীয়তাবাদ। 

 

মুসলিমদের বিজয়

দীর্ঘকাল পারস্য শাসন করে সাসানিদ বংশ। বাইজেনটাইনদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ লেগেই ছিল। এত দীর্ঘ যুদ্ধে উভয়পক্ষের অবস্থাই খারাপ হয়ে গেছে। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর ১০ বছরের মাথায় পারস্য মুসলিমদের দ্বারা বিজিত হয়।

 

বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি মুসলিমরা

পারস্য বিজয়ের ফলে মুসলিমরা এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। এ সমৃদ্ধিশালী দেশের ওপর আধিপত্য লাভ করে তাঁরা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বাবলম্বী হন। পারস্য বিজয় মুসলমানদের আরও আধিপত্য বিস্তারে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল।

 

মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ক্ষমতাচ্যুত

১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের ফলে মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ক্ষমতাচ্যুত হন। তিনি শাহেনশাহ পদবি ধারণ করেন। এ ছাড়াও আরিয়ামের, বুজুর্গ আর্তেশতারান পদবিও তিনি লাভ করেন। ইরান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় ও পাহলভি পরিবারের সর্বশেষ সম্রাট ছিলেন তিনি।

 

ইসলামিক অভ্যুত্থান

রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৮ সালে ২ হাজার ২০০ রাজনৈতিক কর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়। যার ফলে ইসলামিক অভ্যুত্থান ঘটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মদদপুষ্ট সরকারকে ঘিরে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে তাঁর মতভেদ ঘটতে থাকে ও কমিউনিস্টদের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়।

 

২০২১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ইব্রাহিম রাইসুল-সাদাতি

সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রাইসুল-সাদাতি একজন ইরানি রক্ষণশীল ও প্রিন্সপালিস্ট রাজনীতিবিদ ও মুসলিম বিচারপতি। তিনি ২০২১ সালে ইরানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন।

সর্বশেষ খবর