শুক্রবার, ৯ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাঙালি সংস্কৃতি, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

বাঙালি সংস্কৃতি, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার

“আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের কাছে নতিস্বীকার করবো না। ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলবো, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। ...তোমরা মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও।”

-১০ জানুয়ারি ১৯৭২, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর প্রদত্ত বক্তৃতা

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণের এক পর্যায়ে বলেছিলেন “...আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলব। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।” সভ্যতার শিখরে পৌঁছাতে হলে একটি স্বাধীন দেশের জন্য এই তিন ধরনের মুক্তি অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি জনগোষ্ঠী বিশ্ব দরবারে স্বতন্ত্র পরিচয় লাভ করে তাদের ভাষা, নিখাদ অসাম্প্রদায়িক চেতনা, লালিত ঐতিহ্য, বিশুদ্ধ কৃষ্টি ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে।

আমরা বাংলাদেশের জনগণ, আমরা বাংলায় কথা বলি, তাই আমরা বাঙালি। তবে বাঙালি যে একটি স্বতন্ত্র ‘জাতি’ এটি অনুধাবন করতে সময় লেগেছে বহু বছর। যুগে যুগে অনেক জ্ঞানী গুণী, কৃতী ব্যক্তিত্ব ও নেতার জন্ম হয়েছে এই ভূখণ্ডে। তাঁরা বাঙালি জনগোষ্ঠীর উন্নতি, কল্যাণ ইত্যাদির জন্য শুভ চিন্তা করেননি তা নয়, তবে বঙ্গবন্ধুর পূর্বে বাঙালিদের জন্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই।

ইতিহাসে দেখা যায় যে, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দর্শন ও এর ভিত্তিতে ভৌগোলিক বিভাজন সম্ভবত এই উপমহাদেশেই সবচেয়ে প্রবল ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে, কিন্তু আমাদের এই ভূখণ্ডে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সফল নেতৃত্ব প্রদান করতে সক্ষম হয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে যে রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল সেটি ছিল একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র। তাই কাঠামোগত দিক থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল বাঙালি জাতির নিজস্ব পরিচয় নির্মাণ ও আত্মবিকাশের পথে দৃশ্যমান অন্তরায়। কিন্তু এরূপ পরিস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধু নিজ ধর্মবিশ্বাসে অটল থেকে বৈষম্যের নিগড় থেকে এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে সফল আন্দোলন ও সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়েছেন। এই জাতির সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে তাঁর সেই উচ্চকিত ভাবনা, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রজ্ঞার ফলে আমরা পেয়েছি বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র- প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের কথা, চিন্তা, কর্ম ও চেতনার মাঝে নিরন্তর প্রবহমান ছিল অসাম্প্রদায়িক ভাবনা, দেশজ সংস্কৃতি উৎসারিত গভীর দেশপ্রেম ও সর্বোপরি বাঙালি জাতির প্রতি অসীম ভালোবাসা, প্রেম ও মায়া।

বর্তমানে বাংলা ভাষায় কথা বলার মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে নেহাতই কম নয়। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের কিয়দংশসহ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সমগ্র বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা প্রায় ত্রিশ কোটির মতো। এই সুবৃহৎ জনগোষ্ঠী তাদের হৃদয়ের গভীরে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালন করে। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে যারা কর্ম ও ভাবনার মাধ্যমে নিজেকে সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে সমাজ ও সমষ্টির অগ্রগতির অগ্রযাত্রায় সক্রিয় তাদেরই বলা হয় সংস্কৃতিবান মানুষ। বৃহত্তর অর্থে যে পরিবার বা জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির নিরন্তর চর্চা ও বিকাশের সঙ্গে সচেতনভাবে যুক্ত ও সক্রিয় তাদের বলা হয় সংস্কৃতিবান পরিবার বা জনগোষ্ঠী। এরকমই একজন পরিশুদ্ধ সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্বের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এই জাতির রাজনৈতিক দার্শনিক, তিনি বাঙালি জাতির পিতা। সারা জীবন বাংলার মানুষের সংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায় আপোসহীন অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন তিনি। তাঁরই উৎসাহে ও প্রেরণায় বাঙালি জনগোষ্ঠী আজ একটি সুন্দর ও ক্রমবিকাশমান সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে বসবাস করছে। এদেশের শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক, প্রকাশনা প্রভৃতি আজ যে পর্যায়ে উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হয়েছে এর পেছনে ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধু এবং সমষ্টি হিসেবে তাঁর পরিবারের সুগভীর প্রভাব ও অবদান রয়েছে।

বিভিন্ন জনের স্মৃতিকথায় দেখা যায় পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে যখনই কোথাও জনসভা করতেন সেই জনসভায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া হতো। তিনি তাঁর সহকর্মীদের প্রায়শ বলতেন কোনো জনসভার আগে যেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি (বর্তমানে আমাদের জাতীয় সংগীত)” গানটি গাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা বই থেকেও জানা যায় যে, বঙ্গবন্ধু যতবার জেলে গেছেন ততবারই সঙ্গে নিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতবিতান, সঞ্চয়িতা ও কবি নজরুলের বই সঞ্চিতা। রাজনৈতিক বইয়ের পাশাপাশি তিনি সবসময়ই সাহিত্য ও কবিতার বই কাছে রাখতেন। ষাটের দশকে যখন রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করা হয় তখন বঙ্গবন্ধু ও এদেশের প্রগতিশীল নেতা-কর্মী ও সংস্কৃতিকর্মীরা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন।

প্রখ্যাত কবি ও কথাসাহিত্যক আনিসুল হকের বই ‘এখানে থেমো না’-তে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু যখন কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন তারপর থেকেই রেডিওতে-‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো আগুন জ্বালো’-গানগুলো গাওয়া হতে থাকে। তখন বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে এবং তাঁর অর্থানুকূল্যে রবীন্দ্রসংগীতের একটি অ্যালবামও বের করা হয়েছিল। শিল্পী জাহিদুর রহিম ও অন্যান্যরা মিলে ছয়টি গানের এই অ্যালবামটি বের করেন যার নাম দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই-‘আমার সোনার বাংলা’।

বঙ্গবন্ধু প্রায়শই বলতেন বাঙালি জাতিকে পদানত করতে হলে যে তার সংস্কৃতিকে আগে ধ্বংস করতে হবে পাকিস্তানিরা এটা ভালোই বুঝতো। তাই তারা সবার আগে আমাদের ভাষার ওপর হামলা চালিয়েছিল। আনিসুল হক তাঁর বইয়ে আরও লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু একটি ভাষণে বলেছেন, “এরপর তারা হামলা চালাল সংস্কৃতির ওপর। রবীন্দ্রসংগীত এদেশে নিষিদ্ধ করতে চাইল। তারা জানে না রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া বাংলা সংগীত সম্পূর্ণ হয় না। অন্য যে কোনো বাঙালির মতো আমার ওপরও রবীন্দ্রনাথের প্রভাব অনেক। আমি যখন কারাগারে বন্দি ছিলাম, যখন আমাকে নির্জন প্রকোষ্ঠে আটকে রাখা হতো, যখন সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হলো, আমাকে হত্যার চক্রান্ত হলো, তখন আমি রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা থেকে সাহস নিতাম। আমি আবৃত্তি করতাম-“বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা-বিপদে আমি যেন না করি ভয়...।”

এই অঞ্চলের নাম হিসেবে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি বঙ্গবন্ধুর খুবই প্রিয় ছিল। ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে নারায়ণগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু প্রথম ‘বাংলাদেশ’ নামটি উচ্চারণ করেছিলেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের “নমঃ নমঃ নমো বাংলাদেশ মম/ চির মনোরম চির মধুর” কবিতাটি ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম প্রিয় একটি কবিতা। এই কবিতায় ‘বাংলাদেশ’ শব্দটির উল্লেখ এরূপ প্রিয়তার অন্যতম কারণ বলে মনে হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৪ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে নিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু। ভারত সরকারের কাছে তিনি বলেছিলেন, ‘যে ভাষার জন্য কবি তাঁর যৌবন উৎসর্গ করেছেন, যে মানুষের অধিকারের জন্য কবি কারাগারে নিক্ষেপিত হয়েছেন, সেই বাঙালি জনগোষ্ঠীর দেশ বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, তাই আমি আমাদের এই কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে যেতে চাই।’ ভারতের তৎকালীন প্রাধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর এই আবেদনে সাড়া দিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে আনার অনুমতি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে আমাদের জাতীয় কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন। কবির লেখা গান ‘চল, চল, চল...’ বাংলাদেশের রণসংগীত হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে।

নুরুল হুদা সম্পাদিত ‘বিদ্রোহী কবি ও বঙ্গবন্ধু’ বইয়ে বলা হয় কবির নাতনি খিলখিল কাজী বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে লিখেছেন, “তিনি প্রায়ই দাদুকে দেখতে চলে আসতেন ধানমন্ডির কবি ভবনে। মাকে খুব স্নেহ করতেন, মাকে নাম ধরে ডাকতেন ‘উমা’ বলে। মায়ের কাছে খোঁজখবর নিতেন-দাদুর স্বাস্থ্য, খাওয়া-দাওয়া। সব বিষয়ে তাঁর নজর ছিল প্রখর। এত সুন্দর বাগানওয়ালা বাড়ি পেয়ে দাদুও খুব খুশিতে বিভোর থাকতেন। আমাদের ছোটদের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধু কথা বলতেন ‘কেমন লাগছে এই দেশে? এখান থেকে আর যাবা না ভারতে? যখন তিনি আসতেন দাদুকে দেখতে আমরা তাঁকে ঘিরে থাকতাম। মাঝে মাঝে আমরা, মা বাপি সবাই বঙ্গবন্ধু ও দাদুর সামনে গান গাইতাম, তিনিও মাঝে মাঝে গলা মেলাতেন। তাঁর আগমনে আমাদের বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। তিনি সব সময় আমাদের পরিবারের একজন অভিভাবকের মতন ছিলেন। মায়ের সঙ্গে দাদুর সব রকম আলোচনা করতেন। তাঁর ব্যবহারে কোনো দিন (তাঁকে) রাজনৈতিক গণ্ডির মধ্যে পাইনি, অসামান্য আন্তরিকতা ছিল তাঁর ব্যবহারে।”

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে কবি নজরুলের প্রথম জন্মবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “বাংলাদেশের বিদগ্ধ সমাজকে কবির সৃষ্টির পুনঃমূল্যায়নের দায়িত্ব নিতে হবে।” শুধু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামই নন, বঙ্গবন্ধু এদেশের সব কবি সাহিত্যিকের কর্ম ও অবদানকে যথাযথ স্বীকৃতি দিতেন এবং মূল্যায়ন করতেন। অনুপম হায়াত তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’ বইয়ে উলেখ করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা তেমনি তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের ভিত্তিভূমি ‘বাংলাদেশে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার’ও প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৫৭ সালে এই সংস্থাটির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আধুনিক চলচ্চিত্র শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু গণপরিষদে বিল উত্থাপন করেন। তখন তিনি ছিলেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী। একটি সূত্র বলছে, বঙ্গবন্ধু সিনেমা হলে বসে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ চলচ্চিত্রটি দেখেছেন। এটি অনিবার্যভাবেই বলতে হয় বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের দেশের চলচ্চিত্র জগৎও অনেক এগিয়েছে। খ্যাতিমান চিত্র পরিচালকগণের অনেকেই স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনার কথা বলতেন এবং বঙ্গবন্ধু তাঁদের কথা শুনে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতির উন্নয়নের পরামর্শ দিতেন।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া একমাত্র সত্যজিৎ রায়ই সারা বিশ্বে বাংলাকে পরিচয় করিয়েছেন বৈশি^ক ভাষারূপে। ছাত্রলীগ এই কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। তাঁর সঙ্গে অবশ্য ভারত থেকে অনেক প্রখ্যাত শিল্পী, সাহিত্যিক ও পরিচালক এসেছিলেন। সহজেই অনুমান করা যায় বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন ও আগ্রহের কারণেই সত্যজিৎ রায়কে ছাত্রলীগ ভাষাদিবসে তাদের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি করেছিল।

সত্যজিৎ রায় এ দেশের মানুষ। তাঁর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায়, তবে পূর্ববঙ্গ ও ঢাকার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি থানার মসুয়া গ্রামে। তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য তিনি তখন বৃত্তিও পেয়েছিলেন। তারপর কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে উচ্চশিক্ষা লাভের পর কলকাতাতেই থিতু হন সত্যজিৎ রায়ের দাদা উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী। সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও পূর্ববঙ্গের সঙ্গে উপেন্দ্র কিশোরের যোগাযোগ ছিল বহু বছর। সত্যজিৎ রায় মাত্র আড়াই বছর বয়সে পিতাকে হারান। তখন থেকেই মূলত পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগে ছেদ পড়ে। ১৯৭২ সালে ঢাকার পল্টন ময়দানের অনুষ্ঠানে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “গত ২০ বছরে অনেক জায়গায় অনেক দেশে অনেকবার নানাভাবে সম্মানিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু জোর গলায় আজকে এখানে দাঁড়িয়ে এই শহীদ দিবসের পুণ্য তিথিতে আমি বলতে পারি যে, আজকের যে সম্মান, সে সম্মানের কাছে আগের সমস্ত সম্মান হার মেনে যায়। এর চেয়ে বড় সম্মান আমি কখনো পাইনি। আর আমার মনে হয় না, আমি আর কখনো পাব। জয় বাংলা।”

২১ ফেব্রুয়ারিতে সেই বক্তৃতায় সত্যজিৎ রায় আরও বলেছিলেন “এবার আমি অনেক জরুরি কাজ ফেলে চলে এসেছি। এবার আর বেশি দিন থাকা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আমার ইচ্ছা আছে, আমার আশা আছে যে অদূর ভবিষ্যতে আমি আবার এদেশে ফিরে আসব, এ দেশটাকে ভালো করে দেখব। এ দেশের মানুষের সঙ্গে এমনভাবে জনসভায় নয়, সামনা-সামনি, মুখোমুখি বসে কথা বলে তাদের সঙ্গে পরিচয় করব। এ আশা আমার আছে।”

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে আরও যারা এসেছিলেন এদের মধ্যে ছিলেন ঋত্তিক ঘটক, শ্যামল মিত্র, অমল মুখার্জি, সুমিত্রা মুখার্জি, বরুণ বকশি প্রমুখ। শিল্পীরা প্রায় সবাই বঙ্গবন্ধুকে একটি করে গান শুনিয়েছিলেন। জানা যায়, বঙ্গবন্ধু সত্যজিৎ রায়সহ পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত সমস্ত শিল্পীকে নিজের হাতে চা পরিবেশন করেছিলেন। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে সবাইকে চা পরিবেশন করার মধ্য দিয়ে শিল্প ও শিল্পীদের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা যেমন মূর্ত হয়েছে ঠিক তেমনি দৃশ্যমান হয়েছে তাঁর মহান অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি প্রবণ হৃদয়ের।

সত্যজিৎ রায় ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল পরলোকগমন করেছেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলার মাটিতে এই মহান মানুষটিকে স্বাগত জানিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে। যদিও সত্যজিৎ রায়ের ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশে আবারও আসার, কিন্তু ১৯৭২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সময়কালে বিশ্বনন্দিত এই ব্যক্তিত্বকে বাংলাদেশের মাটিতে আনার কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর যে অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থা এদেশ দখল করে নিয়েছিল সেখানে বরং বাঙালি সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার চেয়ে ভিন্নরূপ ও বিপরীত সংস্কৃতির দৃশ্যমান লালন-পালন পরিলক্ষিত হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ফজিলাতুন নেছা মুজিব দম্পতির পাঁচ সন্তান। তাঁরা হলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন পুত্র, দুই পুত্রবধূ ও একমাত্র ভাইসহ আঠারোজনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে সেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা দেশে না থাকায় তাঁরা বেঁচে যান। কিন্তু তাঁদের জীবনে নেমে আসে সীমাহীন বেদনা ও বিশাল শূন্যতা। শৈশব থেকে তাঁরা তাঁদের জীবনে পিতাকে বহুবার কারাগারে যেতে দেখেছেন। বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের জন্য পিতার অসীম ত্যাগ ও তাঁর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক জীবনে সন্তান হিসেবে তাঁরা অনেক সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় কষ্ট ও বেদনায় অধ্যায়। তবে ধীরে ধীরে সেই শোক সামলে নিয়ে ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার গড়া সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ বছর সংগঠনটির সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন।

জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও জাতির পিতার পদাঙ্ক ও দর্শন অনুসরণ করেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পিতার রেখে যাওয়া রাজনৈতিক দল পরিচালনার পাশাপাশি এ দেশের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন। কোনো অনুষ্ঠানে যখন জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকলে তাঁকে জাতীয় সংগীত গাইতে দেখা যায়। তিনি বাংলাদেশের সমস্ত শিল্পী-কলাকুশলীদের সঙ্গে অত্যন্ত আন্তরিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে হাসিমুখে তাঁদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে থাকেন। অনেক কবি শিল্পী সাহিত্যিককে তিনি আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করেছেন এবং এখনো করে চলেছেন অকাতরে। নিঃসন্দেহে এগুলো তাঁর সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে শান্তি নিকেতনে ২০১৮ সালে ‘বাংলাদেশ ভবন’ স্থাপন করা হয়েছে। সে বছর ২৫ মে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে এই ভবনটি উদ্বোধন করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে অবস্থিত কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে বলেছিলেন- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার জয় বাংলা সোগান কবি নজরুলের কবিতা থেকেই নেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার লেখা বইগুলো পড়লে সহজেই অনুমান করা যায় দুই বাংলার কবি সাহিত্যিকদের লেখা কত বই-ই না তিনি পড়েছেন। বাংলা সহিত্যের প্রতি তাঁর এই অনুরাগ তাঁর পিতার দর্শনের প্রতিফলন।

বঙ্গবন্ধু তাঁর সন্তানদেরও গড়ে তুলেছিলেন তাঁরই লালিত দার্শনিক বোধ, চেতনা ও আদর্শে। তবে পরিশেষে যাঁর কথা না বললে অন্যায় হবে তিনি হলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারের কর্তাব্যক্তি হলেও বাঙালির বিভিন্ন দাবি বাস্তবায়নের আন্দোলনের জন্য তাঁকে জীবনের বহু বছর কাটাতে হয়েছে কারান্তরালে। সেই অর্থে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর পুত্র-কন্যারা তাঁদের মাতা মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অভিভাবকত্বেই বেড়ে উঠেছিলেন।

সম্প্রতি বিখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদারের তিরোধানের পর বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক নঈম নিজাম একটি ঘটনার উলেখ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন- সমরেশ মজুমদার ১৯৯৪ অথবা ১৯৯৫ সালে ঢাকায় এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একদিন তাঁকে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানান। গল্পচ্ছলে শেখ হাসিনা সমরেশ মজুমদারকে জানান তাঁর লেখা বেশির ভাগ বই-ই তাঁর পড়া। সাত কাহনের দীপাবলি চরিত্র নিয়েও শেখ হাসিনা কথা বলেন। নইম নিজাম আরও লিখেছেন, ‘সমরেশ দা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে খুবই খুশি হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন আপনি এখন বিরোধীদলীয় নেত্রী। দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে আপনার কাছে যা চাইব তা কি পাব?’ শেখ হাসিনা সে দিন উত্তরে বলেছিলেন, ‘লেখক যা চাইবে তা দিয়ে দিব।’ তখন সমরেশ মজুমদার বলেছিলেন, ‘তবে সাদা কাগজে লিখে দিন আপনি প্রধানমন্ত্রী হলে বাংলাদেশে প্রবেশে সমরেশ মজুমদারের কোনো ভিসা লাগবে না।’ শেখ হাসিনা কাগজ কলম নিলেন, লিখে দিলেন ‘আমি প্রধানমন্ত্রী হলে লেখক সমরেশ মজুমদারের বাংলাদেশে প্রবেশে ভিসা লাগবে না।’ নিচে স্বাক্ষরও করেন। নঈম নিজাম আরও লিখেছেন ঘটনার এখানেই শেষ নয়। ‘১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলেন। সমরেশ দা ১৯৯৭ সালে বইমেলায় ঢাকায় আসেন। ঢাকা বিমান বন্দরে পাসপোর্ট-এর পরিবর্তে জমা দেন শেখ হাসিনার লেখা সেই কাগজ। অফিসারের চোখে বিস¥য়! কি করবেন এমন এক পর্যায়ে তিনি সিনিয়র অফিসারকে ডেকে আনলেন। সিনিয়র অফিসার আবার সমরেশ মজুমদারের ভক্ত। এই অফিসার বললেন দাদা জাতির জনকের কন্যার পক্ষেই সম্ভব এভাবে একজন লেখককে সম্মান জানানো। বাইরে আপনার লোকজন অপেক্ষা করছে। এ সময় সমরেশ দা পাসপোর্টটি বের করে দেন।’

নঈম নিজামের লেখায় আরও প্রকাশ পায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেদিনকার লেখা কাগজটি সমরেশ মজুমদার আমৃত্যু তাঁর সংগ্রহে রেখেছিলেন। সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে শেখ হাসিনার আলাপচারিতা এবং তাঁকে সাদা কাগজে বাংলাদেশে বিনা ভিসায় প্রবেশ করার অনুমতি প্রদান সম্বলিত লেখা থেকে শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সম্মানবোধ যেমন উপলব্ধি করা যায় তেমনি তাঁদের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি তাঁর অনুরাগ ও আগ্রহের বিষয়টিও প্রতিফলিত হয়ে ওঠে। এরকম আরও অগণিত উদাহরণ রয়েছে। খুবই প্রাসঙ্গিক বিধায় আমি নিজে সাক্ষী এমন একটি ঘটনার উল্লেখ করা এখানে প্রয়োজন বলে মনে করি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন ড. শৈলজারঞ্জন মজুমদার। কবিগুরুর জীবদ্দশায় শৈলজারঞ্জন মজুমদার ছিলেন বিশ্বভারতীর সংগীত ভবনের আচার্য। বিশুদ্ধ রবীন্দ্রসংগীত চর্চার ব্যাপারে শৈলজারঞ্জন ছিলেন আপোসহীন। তাঁর বাড়ি বর্তমান নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জের বাহাম গ্রামে। ১৯১২-১৪ সালের দিকে শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে ভালো লেখাপড়া করানোর উদ্দেশ্যে তাঁর পিতা রমনী দত্ত মজুমদার কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন। রসায়নের ছাত্র শৈলজারঞ্জন মজুমদার পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের শিক্ষক হয়েছিলেন এবং ১৯৩২ সালের দিকে তিনি কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগ্রহে বিশ্বভারতী, শান্তি নিকেতনে রসায়নের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এরপর থেকে তিনি ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। ১৯৭৫ সালে তিনি একবার বাংলাদেশে এসে গ্রামের বাড়ি মোহনগঞ্জের বাহামে গিয়েছিলেন। আমার নিজের বাড়ি মোহনগঞ্জে এবং এই সূত্রে তাঁদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেই সময় তিনি দুই-তিন দিন আমার বাবার আতিথেয়তা গ্রহণ করে আমাদের মোহনগঞ্জের বাসায় অবস্থান করেছিলেন।

মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরে অথবা মোহনগঞ্জে যাওয়ার আগে কোনো এক সময় শৈলজারঞ্জন মজুমদার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে চলে আসতে বলেছিলেন। তিনি তাঁর লেখা বইয়ে লিখেছেন- ইচ্ছে ছিল আবার একবার জন্মভূমিতে যাব, কিন্তু বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের মৃত্যুতে সে ইচ্ছা বিসর্জন দিতে হয়েছিল। মনে পড়ে তিনি বারবারই বলছিলেন থেকে যেতে। বলেছিলেন, ‘আপনারে আর ছাড়ুমই না’। শৈলজারঞ্জন মজুমদার বলেছিলেন, “আমার গ্রামের বাড়িতে উদ্বাস্তু, শহরের বাড়িতে মসজিদ হয়েছে, থাকার জায়গা কোথায়?” উত্তরে জোর দিয়ে তিনি (বঙ্গবন্ধু) বলেছিলেন “ছাইড়্যা দ্যান। আমি আপনেরে বাড়ি দিমু, গাড়ি দিমু, ডোমিসিল দিমু।” আরও বলেছিলেন, আপনার জায়গার অভাব হবে না। শৈলজারঞ্জন লিখেছেন, ‘সে আমি আমার অন্তরের অন্তস্তলে উপলব্ধি করেছি।’ (সূত্র : শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জীবনী সংবলিত বই যাত্রাপথের আনন্দগান, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১৩৪)।

আমার পরিবারের সঙ্গে, বিশেষ করে আমার বাবার (ডা. আখ্লাকুল হোসাইন আহমেদ, আওয়ামী লীগ নেতা ও ১৯৭২ সালের গণপরিষদ সদস্য) সঙ্গে শৈলজারঞ্জনের সম্পর্ক ছিল বেশ ঘনিষ্ঠ। এই মহান সংগীতসাধকের স্মৃৃতি ধরে রাখার জন্য তাঁর গ্রামের বাড়িটি উদ্ধার করে সেখানে কিছু করা যায় কিনা এ বিষয়ে আমার বাবা এবং আমি নিজেও অনেক ভেবেছি। অবশেষে ২০১২ সালে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আমি স্থানীয় শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিয়ে সেই বাড়িটি দেখতে যাই। মোহনগঞ্জে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের পিতৃপুরুষদের জমিদারি ছিল। কিন্তু যখন আমি সেই বাড়িতে গেলাম তখন তার কোনো স্মৃৃতিচিহ্নও পাওয়া যায়নি। আমার ছোটভাই সাজ্জাদুল হাসান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব ও তাঁর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব থাকাকালীন গল্পচ্ছলে মাঝে মধ্যে আমাদের আগ্রহের কথা বলেছি এবং সে বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গোচরে এনেছিল। তাই পরবর্তীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত আগ্রহে প্রায় চল্লিশ কোটি টাকা ব্যয়ে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জন্মভিটায় স্থাপিত হয়েছে ‘শৈলজারঞ্জন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’।

পূর্ববঙ্গে যে ক’জন মানুষ রবীন্দ্রনাথকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন বা বলা যায় রবীন্দ্রনাথের কর্মকে পূর্ববঙ্গে ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে শৈলজারঞ্জন মজুমদার অন্যতম। কিন্তু তারপরও একথা বলতেই হবে পূর্ববঙ্গে জন্ম নেওয়া অনেক অনেক নামি-দামি মানুষের স্মৃৃতি আজ প্রায় বিস্মৃৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানে ‘শৈলজারঞ্জন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ স্থাপন নিঃসন্দেহে আমাদের প্রতি, নেত্রকোনাবাসীর প্রতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সহমর্মিতা ও তাঁর সংস্কৃতি-অন্তপ্রাণ মনের পরিচয় বহন করে। এ কেন্দ্রটি স্থাপিত হওয়ায় দুই বাংলার রবীন্দ্র-প্রেমিকদের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে আরও একটি বিষয়ের উল্লেখ করা প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটিতে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের সুন্দর একটি ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে। এর সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও দুটি ম্যুরাল স্থাপন খুবই প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করি। একটি হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল, অপরটি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। বঙ্গবন্ধু শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে দেশে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন আর বিশ্বকবি তো শৈলজারঞ্জনের সরাসরি গুরু যাঁর কিরণে তিনি আলোকিত। শৈলজারঞ্জন মজুমদার ছাড়াও আমাদের ভাটি অঞ্চলে যুগে যুগে অনেক কালোত্তীর্ণ সংস্কৃতিসেবী ও সাহিত্য প্রতিভার জন্ম হয়েছে। তাঁদের মধ্যে মোহনগঞ্জ-খালিয়াজুরি অঞ্চলের গায়ক ও গীতিকার উকিল মুন্সি অন্যতম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অর্থানুকূল্যে উকিল মুন্সির সমাধিস্থলটিও সংরক্ষণ করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, মূলত বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক আবহের মধ্যেই শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়াচর্চার একটি সরব ধারার উপস্থিতি ও চর্চা ছিল। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা একজন সাহিত্য-প্রেমিক ব্যক্তিত্ব। বই পড়ার অভ্যাস বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রায় সব সদস্যেরই ছিল। সমরেশ মজুমদারের লেখা ‘আপনজন’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আমাকে দেখে একগাল হাসলেন শেখ হাসিনা, আপনি সমরেশ মজুমদার। বসুন। আপনার সঙ্গে আমার ঝগড়া আছে। কিন্তু তার আগে আপনার একজন ভক্তকে খবর দিই। তিনি কাউকে বললেন রেহানাকে ডেকে আনতে। এলেন। ছিপছিপে তরুণী ঘরে ঢুকতেই শেখ হাসিনা বললেন, দেখ তো, একে চিনিস কিনা! রেহানা কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার শেখ হাসিনার দিকে তাকাচ্ছেন। তখন শেখ হাসিনা আমার পরিচয় দিলেন। শোনা মাত্র রেহানা দ্রুত ভেতরে চলে গেলেন। ...শেখ হাসিনার কথা শেষ হতেই ওঁর বোন আমার লেখা গোটা চারেক বই নিয়ে এসে হাসিমুখে অনুরোধ করল অটোগ্রাফ দিতে। জানলাম, আমার লেখা তার ভালো লাগে।’ (আপনজন শেখ হাসিনা, সংকলন ও সম্পাদনা ড. মোফাকখারুল ইকবাল, পৃষ্ঠা ১২-১৩)।

ব্যক্তিজীবনে শেখ রেহানাও বাবা ও বড় বোনের মতো একজন সংগীতপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধু পরিবারে সবসময়ই সংগীতের কদর ছিল। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের গান-বাজনার সঙ্গে সখ্য ছিল। তিনি সেতার বাজাতেন। খেলাধুলার প্রতি তাঁর ছিল দুর্নিবার আকর্ষণ। তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা শাহীন স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তিনি ছায়ানট থেকে সেতার বাজানোয় তালিম নিয়েছিলেন। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন প্রাপ্ত হয়েছিলেন। দেশের প্রখ্যাত ক্রীড়া সংগঠন আবাহনী ক্লাব শেখ কামালের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শেখ কামাল ফুটবল ছাড়াও ভলিবল, ক্রিকেট ও টেনিস খেলতে পছন্দ করতেন। আবাহনী ক্লাবের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের টুর্নামেন্ট আয়োজন করতেন। শেখ কামাল নাট্যচক্র নামে একটি নাট্য সংগঠনও গঠন করেছিলেন। তিনি যেমন সেতার বাজাতে জানতেন তাঁর ছোট ভাই শেখ জামাল গিটার বাজাতেন। শেখ কামাল নিজে বিভিন্ন নাটকে অভিনয়ও করেছেন। একটি সূত্র থেকে জানা যায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু দিন ছায়ানটে ভায়োলিন বাজানো শিখেছিলেন এবং ছোট বোন শেখ রেহানা নাচ এবং গানের তালিম নিয়েছিলেন ছায়ানট থেকে।

শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন এবং তাঁর শাহাদাত বরণের ঠিক আগের দিন অর্থাৎ ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ তিনি এমএ শেষ পর্ব পরীক্ষা শেষ করেছিলেন। যার ফলাফল বেরিয়েছিল ১৯৭৬ সালে। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেলকে মাত্র ১০ বছর বয়সেই হত্যা করা হয়েছিল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। শেখ রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন তখন। নিষ্পাপ এই শিশুকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে, এরা মানুষ নামের কলঙ্ক, এদের হিংস্রতা বর্বর পশুদেরও হার মানিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংস্কৃতিমনস্কতা ও সাংস্কৃতিক চিন্তা বাঙালি জাতির সামষ্টিক সাংস্কৃতিক সত্তাকে এক সুসংহত ভিত্তি ও পরিচয় দান করেছে। তাঁর লালিত এসব সুমহান মূল্যবোধ তাঁর পরিবারের মধ্যে সমানভাবে বহমান ও চির জাগ্রত। তাই বঙ্গবন্ধুর পরিবার বাঙালি সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে ধারণ করে এদেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এভাবে এক সময় বঙ্গবন্ধুই হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশই বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাঁকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে ঘাতকেরা বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হত্যার বৃথা স্বাদ পেতে চেয়েছে, কেননা ওই নরপশু ঘাতকরা জানে না বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা যায় না।

তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পয়লা বৈশাখ আমাদের জাতীয় জীবনে অনন্য অসাম্প্রদায়িক একটি উৎসব। আপামর মানুষ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে এই দিনটি উদ্‌যাপন করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পয়লা বৈশাখে সরকারি কর্মচারীদের স্বীয় বেতনের শতকরা ২০ ভাগ হারে বৈশাখী ভাতা প্রদানের প্রচলন করেছেন যা এই দিনটিতে উৎসব পালনে একটি বড় প্রেরণা। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শেখ রেহানা উভয়েই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অনেক শিল্পী-সাহিত্যিকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখেন। কারও কারও জন্মদিনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে শুভাশীষ জানাতে ভোলেন না। সুগভীর সংস্কৃতিপ্রীতি থেকে উৎসারিত এই ভালোবাসা।

বঙ্গবন্ধু তাঁর সন্তানদেরও গড়ে তুলেছিলেন তাঁরই লালিত দার্শনিক বোধ, চেতনা ও আদর্শে। তবে, পরিশেষে যাঁর কথা না বললে অন্যায় হবে তিনি হলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারের কর্তাব্যক্তি হলেও বাঙালির বিভিন্ন দাবি বাস্তবায়নের আন্দোলনের জন্য তাঁকে জীবনের বহু বছর কাটাতে হয়েছে কারান্তরালে। সেই অর্থে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর পুত্র-কন্যারা তাঁদের মাতা মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অভিভাবকত্বেই বেড়ে উঠেছিলেন। বিভিন্ন লেখকের বই থেকে জানা যায়, পুত্র-কন্যাদের বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছুটির দিনে লাইব্রেরিতে নিয়ে যেতেন তাঁরা যেন তাঁদের পছন্দ মতো বই সংগ্রহ ও পাঠ করতে পারে।

পশ্চিমবঙ্গের লেখক সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, “শেখ মুজিব বললেন, আমার জীবনের বড় স্বপ্ন ছিল বাঙালিকে জাতি তৈরি করা। আমার সে স্বপ্ন সার্থক হয়েছে, বাঙালি আজ জাতি হয়েছে।”

একটি জাতির সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে পরিগঠন ও সুসংহতকরণ কোনো সোজা কাজ নয়। হাজার বছর ধরে যে জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক চেতনা ও ঐতিহ্যের বিকাশ ও বিবর্তন ঘটেছে তাকে একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মানচিত্রের জাতি-রাষ্ট্রভিত্তিক কাঠামোর মধ্যে স্থাপন করা এক মহাকালিক দায়িত্ব। মহাকালের তরী বেয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির পিতা কর্তৃক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই পরিচয় পূর্ণতা লাভ করেছে। এই ভীষণ নিঃসঙ্গ ও অশেষ প্রতিবন্ধকতায় পরিপূর্ণ পথ পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুকে দলের নেতৃবৃন্দের বাইরে যে মানুষটি একান্তভাবে নিরন্তর সাহস জুগিয়েছেন, সহযোগিতা করে গেছেন, তিনি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। মহৎ পারিবারিক ঐতিহ্যে লালিত ও তাঁদের স্নেহধন্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, প্রেরণায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি রক্ষার যে আন্দোলন অব্যাহত আছে তা সামনের দিনে আরও বেগবান হবে বলে প্রতিটি বাঙালির মনের কথা।

জাতির পিতার সারা জীবনের সাধনা ছিল উদার, মানবিক ও অসাম্প্রদয়িক এক বাংলাদেশ নির্মাণ। কিন্তু একটি জাতির সামষ্টিক মননে এসব অমূল্য আদর্শের বীজ রোপণ করা কোনো সাধারণ মানুষের কাজ নয়। এ জন্য প্রয়োজন হয় মহাজীবনের অধিকারী কোনো মহামানবের। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আমাদের সেই কাক্সিক্ষত মহামানব।

ওই মহামানব আসে।

দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে

মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে॥

সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,

নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক-

এল মহাজন্মের লগ্ন।

আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত

ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।

উদয় শিখরে জাগে ‘মাভৈঃ মাভৈঃ’

নব জীবনের আশ্বাসে।

‘জয় জয় জয়রে মানব-অভ্যুদয়’

মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে॥

লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর