বদলে যাচ্ছে আগামীর বিশ্ব। প্রযুক্তির বদৌলতে এখন সমগ্র দুনিয়া দেখা যাবে। তাও আবার থ্রি ডায়মেনশনাল ভার্চুয়াল বিশ্ব। যেখানে দেখাশোনা থেকে খেলাধুলা এমনকি কাজকর্ম সবই চলবে- সেই অন্য বিশ্বে।
ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি হচ্ছে কাল্পনিক বাস্তবতা। সহজ কথায় বলতে গেলে, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি (ভিআর) হচ্ছে একটি ‘থ্রিডি’ দুনিয়া, যা কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে সৃষ্টি এবং পরিচালনা করা হয়। আরেকটু সহজভাবে বলতে গেলে, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি হচ্ছে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সিস্টেম, যাতে মডেলিং ও অনুকরণবিদ্যা প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষ কৃত্রিম ত্রিমাত্রিক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পরিবেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন বা উপলব্ধি করতে পারে। ভিআর-এ মানুষ যা দেখে তা অনুভব করতে পারে, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটিতে সৃষ্ট পরিবেশ পুরোপুরি বাস্তব পৃথিবীর মতো মনে হতে পারে। কল্পনার জগৎটা যেন হুবহু বাস্তব। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় অপ্রকৃত বাস্তবতা থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়।
ভিআর-এর ধারণা আজকের নয়। ১৯৬২ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা মর্টন হেলিগ সেনসোরামা নামের একটি যন্ত্র তৈরি করেন, যাতে চেয়ারে বসে পর্দার ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে ত্রিমাত্রিক ছবি দেখা যেত, সেই সঙ্গে কম্পনের মাধ্যমে অনুভূতি এবং গন্ধ পাওয়া যেত। যন্ত্রটি বড়সড় হওয়ায় ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য সুবিধাজনক ছিল না। তবে ছয় বছর না পেরোতেই ১৯৬৮ সালে প্রথম মার্কিন বিজ্ঞানী আইভান সাদারল্যান্ড মাথায় পরার মতো ছোট ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি যন্ত্র তৈরি করেন। এরপর একতরফাভাবে সামরিক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণের কাজে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির ব্যবহার দেখা যায়। লড়াইয়ের কৌশল বা বিমান ও জাহাজ চালনা শেখার ক্ষেত্রে এটি ভালো ফল দেয়। মজার ব্যাপার, তখনো কিন্তু ‘ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি’ নামটাই চালু হয়নি। আশির দশকে মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী জ্যারন ল্যানিয়ার প্রথম ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি শব্দযুগলের প্রচলন শুরু করেন। নব্বইয়ের দশকে কিছু যন্ত্র তৈরি হয়েছিল বটে, তবে এরপর তা নিয়ে আলোচনা একরকম থেমে যায়। এর স্বপ্নদ্রষ্টারা যে কাজের জন্য ভিআর তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছিল সেসময়ে।
গত কয়েক বছরে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে। আজকের বিশ্বে কিছু হেডসেট তৈরি হয়েছে, যা মানুষের চোখের সঙ্গে এমন চালাকি করতে পারে যে আপনি যখন ভার্চুয়াল পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াবেন তখন মনে হবে সবকিছু থ্রিডি-তে দেখতে পাচ্ছেন। আজ যেটা কাল্পনিক, কাল সেটিকেই বাস্তবে পরিণত করছে প্রযুক্তি। আর এ ক্ষেত্রে এ সময়ের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হচ্ছে ‘ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি’। কয়েক বছরের মধ্যে বিস্ময়কর গতিতে ভার্চুয়াল জগৎকে বাস্তব করে তোলার এ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ঘটেছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ প্রযুক্তি কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা, রোগ নিরাময় ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র স্পর্শ করবে।
ডিজিটাল সুস্থতায় টিকটক!
ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের ব্যবহার আমাদের জীবনের মূল অংশ হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে সম্ভাব্য ক্ষতির দিকও আছে। যার মধ্যে অন্যতম মানসিক স্বাস্থ্য, যা সত্যিই একটি উদ্বেগের বিষয়। তাই টিকটকের মতো প্ল্যাটফরমগুলো কেবল বিনোদন নয়, ডিজিটাল সুস্থতার বিষয়েও দায়িত্বশীল হয়ে উঠছে। ব্যবহারকারীদের জন্য নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতে কাজ করছে। ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করার জন্য টিকটকে ডিজিটাল ওয়েল-বিয়িং ফিচার রয়েছে। টিকটকের ‘সেফটি সেন্টার’ এর মধ্যে অন্যতম, যেখানে আছে ওয়েল-বিয়িং গাইড। বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ব্যবহারকারীদের মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে তারা ডিজিটাল কনটেন্ট সম্পর্কে টিপস দেয়। ১৮ বছরের কম বয়সীদের জন্য আছে ডিফল্ট ফর্মে প্রতিদিন ৬০ মিনিট স্ক্রিন টাইম।
ভার্চুয়াল দুনিয়ায় কেনাকাটা
যে কোনো স্থান থেকে গ্রাহক তার প্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটা করতে পারেন কেবল অনলাইন কেনাকাটার মাধ্যমে। আর পণ্যের মূল্যও পরিশোধ করা যায় নগদ টাকার পাশাপাশি ই-কারেন্সির মাধ্যমে। ই-কমার্সের অন্তর্ভুক্ত অনলাইন সেক্টরগুলো খুব সহজেই গ্রাহকের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। করোনাকালীন অনলাইনে ব্যবসা ও কেনাকাটার সবচেয়ে বেশি প্রবণতা দেখা গেছে। আজকাল তরুণরা বেশি কেনাকাটা করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাদের কাছে এটি এখন ‘ভার্চুয়াল শপিং স্পেস’। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৮ কোটি মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেনাকাটা করে। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী বছরগুলোয় ১০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। কেনাকাটার জন্য মানুষ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করবে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম। যেখানে ৭০ শতাংশ ক্রেতা বিভিন্ন পণ্যের খোঁজে ঢুঁ মারেন।
ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং
‘ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং’ হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মার্কেটিংয়ের একটি ‘রূপ’। যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভীষণ জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী, তাদের বলা হয় ‘ইনফ্লুয়েন্সার’। পণ্য ও ব্র্যান্ডের প্রচারে সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, তাদের ব্যবহার বেড়েছে। অতীতের দিনগুলোর মতো আগামীতেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিজ্ঞাপনে তাদের প্রবণতা আরও বাড়বে। বলা যায়, এ ধারাই ট্রেন্ড হয়ে উঠবে। এ ট্রেন্ডকে বলা হচ্ছে ‘ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং’। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, ভবিষ্যতে ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং ব্যয় ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে। ইতোমধ্যে প্ল্যাটফরমগুলো তাদের অ্যালগরিদমকে আরও বেশি বিজ্ঞাপনবান্ধব করার জন্য কাজ করছে। ফলে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে বেশি ‘স্পন্সর’ পোস্ট দেখা যায়।
আছে ডিজিটাল মুদ্রা
ক্রিপ্টোকারেন্সি (Cryptocurrency) হলো ডিজিটাল মুদ্রা। ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না এমন ডিজিটাল মুদ্রা দিয়ে হয়তো ভবিষ্যতের অর্থনীতি চলবে। মূলত ব্লকচেইন প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে এই ডিজিটাল মুদ্রার লেনদেন হচ্ছে। আধুনিক পৃথিবীতে ডিজিটাল লেনদেন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সে ধারাবাহিকতায় ক্রিপ্টোকারেন্সি সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে। ইতিবাচক-নেতিবাচক নানাদিক থাকলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগামীতে এ ধরনের মুদ্রার ব্যবহার বাড়বে। ডিজিটাল মুদ্রা মূলত ক্রিপ্টোগ্রাফি বা তথ্য ধারণার ওপর কাজ করে। (Cryptocurrency) বলা হয় ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল অর্থ যার লেনদেন ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে হয়ে থাকে। এ প্রযুক্তিকে ব্লকচেইন প্রযুক্তি বলা হয়। সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০০০ ধরনের কারেন্সির লেনদেন হয়ে থাকে।
ভার্চুয়াল দুনিয়ায় মেটার চমক
প্রতিনিয়ত বদল আসছে প্রযুক্তি দুনিয়ায়। সেই বদলে গা এলিয়ে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি নিয়ে কাজ করছে প্রযুক্তি বিশ্বের বহু নামিদামি কোম্পানি। তাদের মধ্যে অন্যতম জাকারবার্গের কোম্পানি মেটাভার্স। তালিকায় আছে গুগল, মাইক্রোসফট এবং অ্যাপলের মতো প্রযুক্তি মহারথীরা। ভিআর প্রযুক্তির অগ্রগতিতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও মেটা (পূর্বে ফেসবুক) এ ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে অনন্য উদ্ভাবনী শক্তি। ইতোমধ্যে তারা তাদের মেটাভার্সের কাজ শেষ করেছে। বলা হচ্ছে, মেটাভার্সই হবে ইন্টারনেটের ভবিষ্যৎ। প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, মেটাভার্সের কারণে ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল জগৎকে মনে হবে বাস্তব জগতের মতো যেখানে মানুষের যোগাযোগ হবে বহুমাত্রিক। মেটাভার্স প্রযুক্তির মাধ্যমে আপনি কোনো কিছু শুধু দেখতেই পাবেন না, তাতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতেও সক্ষম হবেন। ভিআর হেডসেট তৈরি করা হলেও মূলধারায় এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয় ২০১০-এর পরে। এ সময়েই বিভিন্ন কোম্পানি, বিশেষ করে ফেসবুক (বর্তমানে মেটা), এ প্রযুক্তির মধ্যে সম্ভাবনা খুঁজে পায়।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী আলোচনার জন্ম দিয়েছে মেটার কোয়েস্ট সিরিজের সর্বশেষ সংযোজন, Meta Quest 3S.-এর দশকে প্রথম ভিআর হেডসেট তৈরি করা হলেও মূলধারায় এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয় ২০১০-এর পরে। এ সময়েই বিভিন্ন কোম্পানি, বিশেষ করে ফেসবুক (বর্তমানে মেটা), এ প্রযুক্তির মধ্যে সম্ভাবনা খুঁজে পায়। ২০১৪ সালে মেটা তাদের ভিআর বিভাগের জন্য Oculus কিনে নেয় এবং তখন থেকে তাদের লক্ষ্য হয়ে ওঠে মানুষের সামাজিক যোগাযোগ, বিনোদন এবং কাজের ধরন পরিবর্তন করা। মেটার প্রথম বড় সাফল্য আসে ২০১৬ সালে Oculus Rift-এর মাধ্যমে। যদিও এটি ছিল হাই-অ্যান্ড পিসিভিত্তিক হেডসেট। ২০১৯ সালে বাজারে আসে Quest সিরিজের প্রথম হেডসেট। Quest হেডসেটগুলো ব্যবহারকারীকে স্বাধীনভাবে ভিআর অভিজ্ঞতা প্রদান করে কোনো কম্পিউটার বা বাহ্যিক ডিভাইসের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার প্রয়োজন ছাড়াই। ফলে সাধারণ ব্যবহারকারীদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি প্রযুক্তি।