ম্যাঞ্চিনীল ট্রি
বিষাক্ত গাছ হিসেবে কুখ্যাতি রয়েছে ম্যাঞ্চিনীল ট্রির। এ গাছের বিষের প্রতিক্রিয়া মারাত্মক। ত্বকের সংস্পর্শে এলে রীতিমতো ক্ষত তৈরি হয়ে যায়। চোখে এ বিষ পৌঁছলে অন্ধত্ববরণ করতে হতে পারে। গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম ‘হিপোম্যানি ম্যান্সিনেলা’। গ্রিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডেও পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত গাছ হিসেবে এর নাম রয়েছে। গাছের ফল এবং পাতা আপেল গাছের মতো। অনেকে এই আপেলগুলোকে ‘মৃত্যুদূত’ বলে থাকেন। এ গাছগুলো ফ্লোরিডা, ইউএস, মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান এবং উত্তর দক্ষিণ আমেরিকায় বেশি দেখা যায়। উপকূলীয় সমুদ্রসৈকত এবং লোনা জলাভূমিতে ম্যানগ্রোভের মধ্যে জন্মায়। ম্যাঞ্চিনীল গাছ চিরহরিৎ প্রজাতির এবং ৪৯ ফিট পর্যন্ত উচ্চতার হতে পারে। ফুল ছোট হয় এবং রং সবুজাভ-হলুদ। এই গাছ এত বিষাক্ত হয়ে ওঠার কারণ সম্পূর্ণভাবে এখনো জানা যায়নি। গাছটির রসে রয়েছে ফরবল এবং অন্যান্য ত্বক যন্ত্রণাদায়ক উপাদান, যার সংস্পর্শে শরীরে প্রচন্ডভাবে অ্যালার্জি ডার্মাটাইটিস হয়। এমনকি বৃষ্টির দিনে যদি কেউ এই গাছের নিচে আশ্রয় গ্রহণ করে, তাহলে পানি ধোয়া রস চামড়ায় ফোস্কা সৃষ্টি করে। গাড়ির রং নষ্ট হয়ে যায় এই গাছের রস পড়লে। যদি এই গাছ পোড়ানো হয় তাহলে এর ধোঁয়া চোখের জন্য অনেক ক্ষতিকর। এর চেয়েও বড় খারাপ গুণ হচ্ছে, অনেকের অভিযোগ গাছটির ফল খেলে মানুষের নিশ্চিত মৃত্যু ঘটে। যেসব জায়গায় এই গাছ জন্মে সেখানকার লোকজনকে এই গাছের কাছে না ঘেঁষার জন্য সতর্ক করে সরকারের পক্ষ থেকে নোটিস ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বেশির ভাগ পাখি এবং জন্তু এই গাছ থেকে দূরে থাকে। গাছটি ভয়ংকর হলেও প্রকৃতিতে এ গাছের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এই গাছের শেকড় মাটি ধরে রেখে সমুদ্রসৈকতের ক্ষয় রোধ করে।
বিষাক্ত ফুল
উইস্টেরিয়া : মেয়েদের চুলের খোঁপায় প্রায়শই শোভা পায় এ ফুলটি। দানাদানা এ ফুলটি দেখতে যেন লম্বা এক ফুলের মালা। গাঢ় বাদামি, হালকা গোলাপি ইত্যাদি রঙের এ ফুলটি ভয়াবহ রকমের বিষাক্ত। অনেকেই ফুলটিকে নিরীহ ভেবে থাকেন। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, বিষের প্রভাব ধীরে ধীরে হলেও শারীরিক বিপর্যয়ে এটি কোনো অংশেই কম নয়। বমি, ডায়রিয়ার সঙ্গে মাংসপেশিতে টান পড়ে রোগীকে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়।
এনথোরিয়াম : ছোট ছোট হার্টের আকৃতি নেওয়া এ গাছের পাতাগুলো দেখলে হঠাৎ আপনার মনে হবে মেয়েদের পায়ের নূপুর। পাতাগুলো সাধারণত সবুজ, লাল অথবা গোলাপি রঙের হয়ে থাকে। অপূর্ব এই পাতাবাহার গাছের পাতা অসম্ভব বিষাক্ত। কোনোক্রমে মুখে দিলে বেদনাদায়ক জ্বালাপোড়া অনুভূতি করবে। মুখের ভিতরে ফোসকা পড়ে যাবে। কণ্ঠস্বর ভারী, কর্কশ হয়ে যাবে। এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব হিসেবে খাদ্য চিবাতে সমস্যা হতে পারে। এনথোরিয়াম ফুলটি বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। তবে গোলাপি রঙের এনথোরিয়াম বেশির ভাগই পাওয়া যায় বিভিন্ন নার্সারিতে।
ফিকাস : বেনজামিন ট্রি হিসেবে পরিচিত এ গাছটিকে অনেকে ছোট পাতার রাবার গাছ ভেবে থাকেন। কেউ বলেন ক্রন্দনকুমারি-ডুমুর গাছ। পাতায় আছে দুধের মতো সাদা ও রসালো বিষ। না জেনে এ গাছটি অনেকেই বাড়িতে ছোট ছোট পাত্রে পাতাবাহারের মতো লালন করেন। এর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আগে কেউ কল্পনাও করতে পারে না কতটা বিষাক্ত এই গাছের পাতাগুলো। পাতার বিষে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার ত্বক চুলকাতে থাকবে, বিষ ছড়িয়ে ত্বকের নিচে বাতাস জমে ফুলে গেছে বলে মনে হবে। অ্যালার্জি কমায় এমন ওষুধ ব্যবহার করে চিকিৎসকরা এ বিষক্রিয়া থামানোর চেষ্টা করে থাকেন।
নারসিসাস : এটি সাদা এবং হলুদ রঙের অপূর্ব একটি ফুল। অনেকে এটিকে পিঁয়াজ ফুল ভেবে ভুল করে থাকে। ডেফোডিল জাতীয় এ ফুলটি যতটা সুন্দর তারচেয়েও বেশি বিষাক্ত। ভুলেও যদি এটি কারও পেটে যায় তাৎক্ষণিকভাবে এটি তার দেহে ভয়াবহ বিষক্রিয়া ঘটাবে। বমির উদ্রেক, মাংসপেশিতে টান পড়া এবং ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
ক্রাইশেনথিমাম : সহজ করে মাম ফ্লাওয়ার বলে ডাকা হয়ে থাকে। কমলা, হলুদ ছাড়াও আরও অনেক রঙের এ ফুলটি পাপড়ি মেলে দিলে মনে হবে টব ভর্তি রঙের হাসি। অনেকেই শখ করে ঘরের দরজায় এ ফুলের গাছ লাগিয়ে থাকেন। ক্রাইশেনথিমামের আরও প্রায় ১০০ থেকে ২০০টি প্রজাতির ফুল রয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত এটি। তবে ত্বকে ফুসকুড়ি পড়া থেকে বাঁচতে এই ফুলগাছটি নিয়ে ছেলেখেলা না করাই ভালো।
রডোডেনড্রন : ফুলের বাগানের অন্যতম আকর্ষণীয় ফুল এটি। ফুলটি মধুতে ভরপুর হলেও এই ফুল গাছের পাতা কল্পনাতীত বিষাক্ত। এই গুল্মজাতীয় গাছের পাতা মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুখ পুড়ে যাবে, লালা ঝরতে আরম্ভ করবে। সঙ্গে বমি, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হবেন এবং চূড়ান্ত বিপর্যয় হিসেবে ত্বকে ফুসকুড়ি পড়তে থাকবে। বিষের প্রভাব এতটাই তীব্র হবে, শিগগিরই হƒদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে কমে আসবে। দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে না পারলে রোগী কোমায় চলে যেতে পারে।
ইউট্রিকুলারিয়া
ব্ল্যাডারওয়ার্ট নামে এ গাছটি বেশ পরিচিত। বিভিন্ন মহাদেশে এই ইউট্রিকুলারিয়াদের অধীনে প্রায় ২০০ প্রজাতি রয়েছে। মাংসাশী উদ্ভিদের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রজাতি ইউট্রিকুলারিয়ার অন্তর্ভুক্ত। এই উদ্ভিদ মশা এবং অন্যান্য অনেক ধরনের ছোট পোকামাকড় খায়। এর দৈহিক গঠন অন্যান্য উদ্ভিদ থেকে আলাদা। এটি প্রোটোজোয়া, পোকামাকড়, লার্ভা, মশা এবং এমনকী নতুন ট্যাডপোল খায়। এটি ভ্যাকুয়াম তৈরি করে নেতিবাচক চাপ তৈরি করে। এতে পোকামাকড় আটকে যায় এবং মারা যায়। জলে ও স্থলে এরা জন্মায়। এই উদ্ভিদের দেহে ব্ল্যাডার বা থলির মতো গঠনবিশিষ্ট ফাঁদ থাকে। এই ফাঁদের মুখে গ্রন্থি ও সংবেদী লোমসমেত প্যাঁচানো অ্যান্টেনার মতো গঠন থাকে। এই অ্যান্টেনা শিকারকে ফাঁদের দরজায় নিয়ে আসতে সাহায্য করে। এরপর সংবেদী লোমে টান পড়া মাত্র ঘটনা ঘটে যায়। বাইরের তুলনায় থলির ভিতরে চাপ কম থাকে বিধায় টান পড়া মাত্র থলি নিজ দায়িত্বে শিকারকে ভিতরে টেনে নেয়।
পিচার প্লান্ট
মাংসখেকো গাছ বলতে শুরুতে বলা যায় পিচার প্লান্টের কথা। পাপুয়া নিউগিনি, অস্ট্রেলিয়া, মাদাগাস্কার, সিসিলিস, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জঙ্গলে এই গাছের দেখা পাওয়া যায়। কলসির মতো দেখতে গাছটি। এর ভিতরে জমে থাকা বৃষ্টির পানি প্রায়ই বানর খেতে আসে বলে এদের আরেক নাম হচ্ছে মাঙ্কি কাপ। এরা মাটি থেকে পুষ্টি গ্রহণের পাশাপাশি পোকামাকড় পেলে তাদেরও খায়। পিচার প্লান্ট প্রথমে শিকারকে আকৃষ্ট করে নিজেদের দিকে নিয়ে আসে। পিচারের ঢাকনা থেকে হালকা সুবাস নির্গত হয়; যা মাছি, পিঁপড়া, গুবরে পোকা, প্রজাপতির ন্যায় পতঙ্গদের আকৃষ্ট করতে পারদর্শী। অনেক সময়ে পিচারের উজ্জ্বল রং দেখেও পোকামাকড় আকৃষ্ট হয়। এ ছাড়া এদের ছোট ছোট পাখি ও ইঁদুরদের ভোজ হিসেবে গ্রহণ করতে দেখা যায়। পতঙ্গরা যখন পিচারের ওপর গিয়ে বসে, তখন এরা পিছলে পিচারের ভিতরে আঠার ফাঁদে আটকে যায়। বেশ পিচ্ছিল থাকায় পতঙ্গগুলো শত চেষ্টা করেও বের হতে পারে না। ধীরে ধীরে পিচারের ঢাকনা বন্ধ হয়ে পাচক রস নির্গত হতে থাকে। এ ছাড়াও অ্যাসিড ক্ষরণ হয়। পাচক রস এবং অ্যাসিডের বিক্রিয়ায় প্রাণীটি খাদ্যে পরিণত হয়।
ড্রসেরা
মাংসাশী উদ্ভিদ সম্প্রদায়ের রত্ন বলা যায় ড্রসেরাকে। সবচেয়ে সুন্দর আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফাঁদ ব্যবস্থার অধিকারী ড্রসেরা উদ্ভিদগুলোকে ‘সানডিউ’ বলেও ডাকা হয়। কারণ এদের পাতায় সরু কাঠির ন্যায় উপাঙ্গের মাথায় এক ধরনের আঠালো, হজম সহায়ক এনজাইম জমে থাকে। দেখে মনে হয় বিন্দু বিন্দু শিশির জমে আছে। রোদে ঝকমক করা এমন শিশিরভেজা উদ্ভিদ দেখে বুঝার উপায় নেই এটি মাংসাশী। পোকামাকড় এ গাছ দেখে এগিয়ে আসে, আর আটকা পড়ে যায়। পাতার পৃষ্ঠে আঠালো গ্রন্থি থাকে যা পোকামাকড়দের আটকে ফেলে আর শিশির বিন্দুর ন্যায় এনজাইমগুলো পোকার দেহ হজম করে ফেলে। ড্রসেরা স্ব-পরাগায়ণ ও স্ব-নিষেক করতে সক্ষম।