খুবই অল্প বয়স ও স্বল্পতম সময়েই নিজের স্বতন্ত্র ও শানিত শিল্পস্বর খুঁজে পেয়েছিলেন আবুল হাসান। এর মূল অনুষঙ্গ ছিল কবিতার প্রতি অকৃত্রিম নিষ্ঠা ও ভালোবাসা। কবিতা মানে অনেক কিছু নয়, তাঁর কাছে কবিতা ছিল নিজের জীবনকে উপেক্ষা করে সব কিছু। কবিতার অন্তঃপুরে ছিল প্রেম ও বিষণ্ন নৈঃসঙ্গ পীড়িত জীবন। আবুল হাসান জীবনে-জীবন ঘষে যে আগুন জ্বালিয়েছেন-সেই ‘শাদা আগুনের’ দহন তাঁর মৃত্যুকেও ছুঁয়েছে। তাঁর নিজের উচ্চারণ ‘প্রিয়তম পাতাগুলো ঝরে যাবে মনেও রাখবে না। আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম-কে আমি/সংসারী না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী/হয়েছি হিরণদাহ, হয়েছি বিজন ব্যথা, হয়েছি আগুন, (সেই মানবীর কণ্ঠ)।’
আবুল হাসান (১৯৪৭-৭৫) মাত্র ২৯ বছরের যাপিত আয়ুর সীমানা। ‘রাজা যায় রাজা আসে’ আর আমাদের স্বপ্নচুরি হয়ে যায়, অরক্ষিত শস্যভরা মাঠ অবিনাশী বানের জলে ভাসে। বোবা কান্নার অশ্রু ওই জলে যায় মিশে। ‘যে তুমি হরণ করো’-সে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে যায় কখনো আসে না ফিরে। কেবলই সন্ধে নামে পথে, ঘাতক রাত্রি এসে দাঁড়ায় পাশে। প্রিয় পথগুলো ভুল গন্তব্যে অন্য বাড়ি যায়। মানুষকে দেখে মানুষ খুব ভয় পায়, দরোজা খোলে না কেউ। একদিন কবি নিজের চিবুকের কাছেও ভীষণ একা ও অচেনা হয়ে যান। একদিন তিনি উপলব্ধি করলেন দুঃখের কোনো মাতৃভাষা নেই। রাত্রিদিন কেবল ‘পৃথক পালঙ্কে’ শুয়ে অচিকিৎস্য আরোগ্যের পাশে আশ্চর্যজনকভাবে ছিলেন প্রবল আত্মবিশ্বাসী। অন্তরে অনিঃশেষ দহন’ পুড়ে যাচ্ছে তাঁর কাঙ্ক্ষিত সুন্দর। কবির কোনো অভিযোগ-অনুযোগ নেই কারও প্রতি। কবি বলেন, ‘ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সয়ে যাও/ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও, অথবা ‘মৃত্যু আমাকে নেবে জাতিসংঘ আমাকে নেবে না’ এ তাঁর কোনো বিষাদের তীব্র অভিমানী নাকি নীরব বিদ্রোহের শানিত উচ্চারণ? তিনি কি আলোকিত সূর্যের নিচে অধিকারবঞ্চিত অন্ধদিন যাপনের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন? কেন তাঁকে বলতে হয়েছে ‘আমি কার কাছে যাবো, কোন দিকে যাবো?/অধঃপতনের ধুম সব দিকে, সভ্যতার সেয়ানা গুন্ডার মতো/ মতবাদ, রাজনীতি, শিল্পকলা শ্বাস ফেলছে এদিকে ওদিকে/শহরের সব দিক সাজানো রয়েছে শুধু শানিত দুর্দিন।’
সময়ের ব্যবচ্ছেদ জীবনবোধের অনুষঙ্গ স্বতন্ত্র ও শানিত শিল্পস্বরে দ্বিধাহীন বলা যায় ‘বাংলা কবিতায় আবুল হাসান একটি মিথের নাম। একটি শাশ্বত সুন্দর অহঙ্কারের নাম। একটি অমিয় অমিত শক্তিধর কবি প্রতিভার নাম।’ ‘অবশেষে জেনেছি মানুষ একা’/সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে অথবা, ‘কেবল পতাকা দেখি/কেবল উৎসব দেখি/আমাদের বাড়িঘর কিছুই নেই। আছে কবিতা, গরিব কবিতা আর গরিব ক্ষিধে।’ কী বিস্ময়কর কী ভয়ংকর বৈরী সময়ের বিরুদ্ধে জীবনমুখী সাহসী উচ্চারণ। এখানেই তাঁর স্বতন্ত্র ও শানিত শিল্পস্বর। আবদুল মান্নান সৈয়দ যথার্থই বলেছেন, ‘পৃথিবীতে এমন কেউ কেউ থাকে যারা কবিতা ছাড়া আর কিছু জানে না। যেমন ইংরেজি সাহিত্যে জন কিটস, বাংলা সাহিত্যে সুকান্ত ভট্টাচার্য, ফারসি সাহিত্যে জ্যাঁ আর্তুর র্যাবো, রুশ সাহিত্যে মায়াকোভস্কি; তেমনি আমাদের আবুল হাসান।’ বিনয়ী ভাষায় যাকে বলা যায় ‘অনিন্দ্য সুন্দর’। কবি তাঁর ভেতর বাহির খুলে দিয়েছেন। ‘ভিতরে বাহির’ কবিতায় ‘আমার বিন্যাস, ফর্ম, আমার শিল্পের সব ভাঙ্গাচোরা/আর ঐ ঐতিহ্য আড়াল:/ জোড়া দাও:/ কখনো সে গ্রামীণ চরকার তাঁত: গৃহস্থের গোধূলি মুকুর/আমার ছায়াকে আমি ভালোবাসি, আর কাউকে না।’
কবি শামসুর রাহমান বলেছেন, সর্বপ্রথম আবুল হাসানের কবিতা পড়ি ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকীতে। সেই বৈশিষ্ট্যহীন কবিতার লেখকের নাম ছিল আবুল হোসেন। নাম পরিবর্তনের পর তাঁর কবিতাও বদলে যেতে লাগল। একজন খাঁটি কবির জন্ম হলো। এই কবির জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কবিতায় ভরপুর ছিল। যেন হাওয়ায়, ধুলোয়, গাছের পাতায়, পাখির ডানায়, নদীর জলে, দিনের কোলাহলে, রাত্রির নিস্তব্ধতায় তিনি কবিতা পেয়ে যেতেন অবলীলায়। আবুল হাসান তাঁর নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পান প্রাথমিক অনুশীলনের প্রক্রিয়ার মধ্য থেকেই।’
আবুল হাসান নৈঃসঙ্গ বেদনার কবি। তাঁর কবিতা শিল্প সৌন্দর্য বোধে তীক্ষè। জীবন ও সময়ের ছবি এঁকেছেন নিপুণ শিল্পিত ভাষায়। তাঁর কাব্যভাষার স্বতন্ত্রস্বর মুগ্ধতা মুখর। নিজের জীবনের প্রতি খামখেয়ালিপনা থাকলেও তীব্র ভালোবাসা ছিল মানুষের প্রতি। কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল যথার্থই বলেছেন, ‘চূড়ান্ত ব্যবচ্ছেদ করলে তাঁর (আবুল হাসানের) ভিতরে মায়া ও মমতা, মানুষের জন্য দুঃখবোধ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না।’ তাঁর উচ্চারণ- ‘আমাকে গ্রহণ করতে হবে সব মানুষের উত্থান-পতন/জয় পরাজয় বোধ, পিছু ফেরা সামনে তাকানো/আমার অনলে আজ জাগো তবে হে জীবন, জয়শ্রী জীবন।’ জীবনের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক অথবা জীবন ও রাজনীতির কী কূটচাল এ বিষয়ে নির্মলেন্দু গুণকে উৎসর্গ করা ‘অসভ্য দর্শন’ কবিতায় হাসান লিখেছেন ‘গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি/তরুণেরা অধঃপাতে যাচ্ছে তাও রাজনীতি পুনরায়/মারামারি যুদ্ধ আর অত্যাচার হত্যার আগ্রাসী খুন মানুষের/ছাড়ানো বীজের ব্যথা, বিষণ্ন মিথুন/আমি পকেটে দুর্ভিক্ষ নিয়ে একা একা অভাবের রক্তের রাস্তায় ঘুরছি। জীবনের অস্তিত্বে ক্ষুধায় মরছি তাও রাজনীতি/’ হোর্হে লুইস বোর্হেস এর (কবিতার কারখানা) থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। তিনি বলেছেন, ‘আমরা কবিতার দিকে এগোই, আমরা জীবনের দিকে এগোই। আর আমি নিশ্চিত যে, জীবন কবিতা দিয়েই তৈরি।’ আমরা এর সঙ্গে যুক্ত করতে পারি কবিতা হচ্ছে, সময়ের ভিতর জীবনযাপন। আবুল হাসান সময়ের ক্যানভাসে জীবনকে চিত্রিত করেছেন বহুবর্ণিল অভিধায়। তাঁর সময়ের কবি মোহাম্মদ রফিক বলেছেন, ‘শুধু কবিতা, কবিতার জন্য তিনি তাঁর প্রথম প্রেমের বিচ্ছেদ ঘটিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন প্রেমে বিচ্ছেদ না হলে বেদনার্ত হওয়া যাবে না। আর বেদনার্ত না হলে কবিতা হয় না। তাই তাঁর কবিতায় স্বতন্ত্রস্বর খুঁজতে তিনি বেছে নিয়েছিলেন দীর্ঘশ্বাস হতাশা, নৈরাশ্য বিষাদ, একাকিত্ব এবং বিছিন্নতাকে।’ বারবার এ কথাটাই বলতে হয় যে, আবুল হাসান তাঁর কবিতাকে দুঃখের সংগীতে গীত করতে চেয়েছিলেন। এবং সেভাবেই তিনি স্বতন্ত্র, তিনি আলাদা। তিনি আবুল হাসান।
কালিক শিল্পসংস্কৃতি, সমাজনীতি, রাজনীতি স্বদেশ প্রকৃতি, প্রেম বিরহ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, দহন সব কিছুকেই এক বুকে ধারণ করতে পেরেছিলেন আবুল হাসান। এ কারণে তিনি দ্বিধাহীনভাবে বলতে পেরেছেন হাসান হাফিজকে উৎসর্গ করা ‘ভিতর বাহির’ কবিতায় ‘আমার শরীর খোঁড়া দুঃখময় আত্মার গাঁথনী, দ্যাখো আমি ঠিকই/ খণ্ডিত ইটের মতো খুলে যাবো সহজেই, কিছুই থাকবো না/মায়া ও মমতা ছাড়া, মানুষের দুঃখবোধ ব্যথাবোধ ছাড়া আর/কিছুই থাকবো না/’
অথচ এই কবি ‘আবুল হাসান’ শিরোনাম কবিতায় নিজেকে নিয়ে বলেছেন ‘তবে কি সে মানুষের সাথে সম্পর্কিত ছিল, কোনো দিন/ ভালোবেসেছিল সেও যুবতীর বাম হাতে পাঁচটি আঙুল/ভালোবেসেছিল ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর ইশকুল/’
শিল্প বিষয়ে আবুল হাসানের উক্তি ও উপলব্ধির প্রকাশ লক্ষ্য করি- শিল্প তো স্বাতীর বুক মানবিক হৃৎপিণ্ড তাই/আমি হৃৎপিণ্ডে যাই চিরকাল রক্তে আমি/শান্তি আর শিল্পের মানুষ/’ শান্তি আর শিল্পের মানুষ, সর্বোপরি মানবিক বোধের এই কবি শান্তি খুঁজে পাননি তাঁর যাপিত জীবনে। বৈরী ও জটিল কুটিল সময় তাঁর পিছু ছাড়েনি। তাঁর মনে হয়েছে প্রিয় হাতগুলো অপ্রিয়দের হাত, প্রিয় চোখগুলো অপ্রিয়দের চোখ, প্রিয় ছায়াগুলো অপ্রিয়দের ছায়া। নক্ষত্রের স্নিগ্ধ শাদা রোদ্দুর তাঁকে স্পর্শ করেনি। রোদ্দুরকে সঙ্গী করে হেঁটে গেছেন দীর্ঘ রাত্রির দিকে আনন্দমুখর দুপুর বিকেল ফিরে গেছে অন্ধকারে কী গভীর বেদনাবোধ থেকে হাসান উচ্চারণ করেন ‘মানুষ এখন নিজেকে মানুষ বলতে- বলে ফেলে পাশব দানব/দানবেরা এখন দেবতা/’(পাখি প্রবাহও অন্যান্য প্রত্যাশা) আবুল হাসান জীবনের অবিচ্ছিন্ন ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন কবিতাকেই। এ কথা বললেও হয়তো ভুল হবে না। কবিতায় আবুল হাসান যাপন করেছেন দ্বিতীয় জীবন। যে জীবন ছিল তাঁর তুমুল অহঙ্কারের। অনিঃশেষ আনন্দের। কাব্যজীবন উদযাপনে হাসানের কোনো কৃপণতা ছিল না। প্রকাশ ভঙ্গিতে রহস্যময়তা বা কুহকের কুটচাল নেই। সহজ শব্দের শানিত স্বর ও ব্যবহারে পরিমিতিবোধ ভিন্নমাত্রা পেয়েছে আবুল হাসানের কবিতা। উদ্ধৃতি দেওয়া যায় ‘গাছগুলো’ (শহীদ কাদরী) কবিতার সকালে কাঠের খোঁপ থেকে বের হয়ে মুরগিগুলো/যখন শস্যকণা খোঁজে কাক ও চড়ুই চষ্ণুদিয়ে খুঁটে খুঁটে তুলে আনে/টাটকা সুগন্ধী ভোর তখনো কোচড় থেকে সোমত্ত সুন্দর গাছগুলো/ঢেলে দেয় মিহি অক্সিজেন/’
কবি মহাদেব সাহা বলেছেন, হাসানের ‘বোহেমিয়ানিজম’ ছিল অন্তর্গত। তাঁর রক্তের মধ্যে এ জন্যে তার বাইরের কোনো আবরণের প্রয়োজন হয়নি। কিছুটা লাজুক স্বভাবের হাসান নিজের অনেক দুঃখই লুকিয়ে রাখতেন নিজের মধ্যে। হাসানের মধ্যে সব সময়ই একজন দুঃখী মানুষ বাস করতো।’ ‘এখন পারি না’ কবিতায় হাসান বলেন, এখন পারি না কিন্তু এক সময় পারতাম/আমিও গ্রহণ করে দেখেছি দুঃখকে/দেখেছি দুঃখের জ্বালা যতদূর না যেতে পারে/তারও চেয়ে বহুদূর যায় যারা সুখী/দেখেছি দুঃখের চেয়ে সুখ আরো বেশি দুঃখময়/’
আবুল হাসান রাহাত খানকে উৎসর্গ করা ‘ডোয়ার্ফ’ কবিতায় বলেছেন, ‘আমাদের জায়গা নেই, গ্রহণ করব কাউকে, বন্ধুকে অথবা শত্রুকে/এত ছোট এত ছোট হয়ে গেছি আমরা সবাই/’হাসানের কাব্যজীবন নিয়ে সুরাইয়া খানম লিখেছেন, ‘কতগুলি মুখস্থ মানুষের’ কাছে আবুল হাসান চিরদিন এক দুর্বোধ্য আত্মক্ষয়ী উড়নচন্ডি মানুষ হয়েই থাকবেন নাকি? ‘আমাদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের অপরিসীম ঘৃণা ও বিদ্বেষে আবুল হাসানের কবিতা এক তীব্র চাবুকের আঘাত।’ বিত্ত-বৈভবের মুখ দেখেননি কখনো আবুল হাসান। এ কারণে যেমন মনোযোগ দিতে পারেননি সংসারের প্রতি, তেমনি নিজের প্রতি। তবে নিজের প্রতি নিরন্তর উদাসীন থাকলেও সংসারের স্বজন প্রিয়জনদের প্রতি তাঁর দায়িত্বের ক্ষেত্রে কোনো অবহেলা ছিল না। এ বিষয়ে জানতে পারি তাঁর বোন হোসনে আরা খানমের কাছ থেকে। হোসনে আরা খানম আবুল হাসানের সেই আদরের ছোট বোন ‘বুড়ি’। বড়দা’র স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হোসনে আরা লিখেছেন- ‘আবুল হাসান শুধু বড়ভাই ছিলেন না আমার, ছিলেন আমার জীবন ভাবনার মডেল, অনুকরণ যোগ্য ব্যক্তির উদাহরণ। তিনি কোনো কিছুতে না থেকেও কীরকম সকল কিছুর ভাবনায় তাড়িত হতেন, ব্যথিত হতেন, উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতেন অমঙ্গল আশঙ্কায়। সংসার তাঁকে টানেনি, কিন্তু সাংসারিক দায়-দায়িত্ব পালনের উদ্বেগ ছিল তাঁর হৃদয়ের সবটুকুতে। আবুল হাসান জীবনের ভেতর বর্ণিল জীবন খুঁজেছেন তাঁর কবিতায়।’ এ কারণে তাঁর কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে ‘মানুষ’। তাঁর ‘ধরিত্রী’ কবিতাতেও আছে সেই অসাধারণ নিবিড় উচ্চারণ ‘পাতা কুড়োনীর মেয়ে তুমি কী কুড়োচ্ছো?/মানুষ আমি মানুষ কুড়োই/মানুষ আমি মানুষ কুড়োই/আহত সব নিহত সব মানুষ তারা বাক্স খুলে রক্ত ঝরায় তাদের রাস্তাঘাটে/পঙ্গু তবু পুণ্যেভরা পুষ্প, তাদের কুড়াই আমি দুঃখ কুড়াই/’ সমাজ, রাষ্ট্র, দেশ, প্রকৃতি, প্রেম, দহন, সব কিছুকে অতিক্রম করেছে জীবন।
শিল্পের ভিতর রয়েছে যাপিত জীবন। শিল্প মূলত জীবন কেন্দ্রিক। শিল্প জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আবুল হাসান বলেন, ‘শিল্প তো নিরাশ্রয় করে না/কাউকে দুঃখ দেয় না/’
‘পৃথক পালঙ্ক’ আবুল হাসানের তৃতীয় ও শেষ কাব্যগ্রন্থ। ‘পৃথক পালঙ্ক’ প্রসঙ্গে কবি শামসুর রাহমানের মন্তব্য ‘বাংলাদেশের কাব্যমানচিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকার অধিকারী আবুল হাসান তাঁর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও। আমরা যারা তাঁর কবিতার গুণমুগ্ধ পাঠক, তারা জানি, তিনি ক্রমশ পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এই পরিণতির স্বাক্ষর বহন করেছে আবুল হাসানের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পৃথক পালঙ্ক’। এই ‘পৃথক পালঙ্ক’ তাঁর কবিতার স্বাতন্ত্র্যের পরিচায়ক। তিনি চিরদিন ‘পৃথক পালঙ্কে’ সমাসীন থাকবেন।’
ষাট দশকের সামরিক শাসন, নিষিদ্ধ রবীন্দ্র সংস্কৃতি চর্চা, ভাষা সংস্কার, গণঅভ্যুত্থানসহ নানাবিধ রাজনৈতিক সমস্যা সংক্ষুব্ধ বাংলাদেশ। এই সংকটের ভিতর থেকে আবুল হাসানের কবিতার স্বতন্ত্র ও শানিত স্বর ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। তিনি জীবন ও সময়কে তাঁর কবিতায় চিত্রিত করেছেন নিপুণ-দক্ষ শিল্পীর চোখে দেখে। তাঁর কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে- ‘মারী ও বন্যায় যার মৃত্যু হয় হোক/আমি মরি নাই, শোনো/লেবুর কুঞ্জের শস্যে সংগৃহীত লেবুর আতর জিভে জিভে রেখে/ সংগোপন শিহরণে পায়- আমি তাই/আমার আত্মাকে দীর্ণ করতে পারবে না/(নচিকেতা) ‘আবুল হাসান নচিকেতার মতো চিনেছিলেন মৃত্যু, চিনেছিলেন অগ্নিবিদ্যাময় আধুনিক পৃথিবীর যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। মিথিক্যাল দেবতা অগ্নি সুখস্বরূপ সত্যস্বরূপ কিন্তু আবুল হাসান বিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে আগুনে দেখেছেন জ¦লন্ত মানুষ, দগ্ধদেশ, পুড়ে যাওয়া মানবিকতা’/এই পটভূমিতেই শানিত স্বরে নির্মিত হয়েছে তাঁর কাব্যের অমর পঙ্ক্তি ‘আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে/আমার মৃত্যুর আগে বোলে যেতে চাই/,সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন/কী লাভ যুদ্ধ করে? (জন্মমৃত্যু জীবন যাপন) আবুল হাসান দীর্ঘজীবন পাননি।
স্বল্প আয়ুর কাব্যজীবনে আবৃত বেদনায় ধারণ করেছেন ‘পৃথক পালঙ্ক’। ভালোবাসার নিবিড় স্বপ্ন ছুঁয়েছে তাঁকে কিন্তু তিনি তাঁর ভালোবাসার স্বপ্নকে ছুঁতে পারেননি। জীবন তাঁকে বারবার টেনে নিয়ে গেছে বেদনা বিষাদে ভরা কণ্টকাকীর্ণ কুহকের পথে। কিন্তু মৃত্যু শয্যায়ও কবিতা তাঁকে ছেড়ে যায়নি। অন্য প্রসঙ্গে হলেও কবি হুমায়ুন আজাদের সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তিটি হাসানের কবিতা সম্পর্কেও প্রাসঙ্গিক ‘যতই গভীরে যাই, মধু’। জীবনে নিঃসঙ্গতার তীব্র দহন, বিচ্ছিন্নতার-বিরহকাতরতায় তাঁর ‘এপিক’ কবিতাটিও অসাধারণ সৃষ্টি ‘যতদূর থাকো ফের দেখা হবে। কেননা মানুষ/যদিও বিরহকামী, কিন্তু তার মিলনই মৌলিক/মিলে যায় পৃথিবী আকাশ আলো একদিন মেলে।’
কবি আবুল হাসান কিছুটা অস্থির প্রকৃতির ছিলেন। স্বভাব কবির মতো যখন তখন খুব দ্রুতই লিখতে পারতেন তিনি। কিন্তু মৃত্যু তাঁকে ডেকে নিয়েছে বড় অসময়ে। হাসান নিজেকেই উচ্চারণ করেছেন এইভাবে ‘বাঘিনীর মুখে চুমু খেয়ে আমি বলেছি আমাকে উদ্ধার দাও’ কিংবা ‘সক্রেটিসের হেমলক আমি মাথার খুলিতে ঢেলে তবে পান করেছি মৃত্যু হে কবি কিশোর’/মৃত্যুর পর হাসান যতটুকু পেয়েছেন বেঁচে থাকা অবস্থায় পেলে হয়তোবা আরও কিছুদিন দীর্ঘায়িত হতো তাঁর স্বপ্নময় কাব্যময় জীবন। বাঙলা সাহিত্য পেত আরও কিছু অসাধারণ কবিতা। তবু যতটুকু পেয়েছি আমরা আবুল হাসান বেঁচে থাকবেন স্বতন্ত্র ও শানিত শিল্পস্বরে শিল্পজনের নিবিড় ভালোবাসায়।