দেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যার পানি প্রবেশ করে আগস্টে। আর ভারি বৃষ্টি ও ফেনী থেকে নেমে আসা বানের পানিতে প্লাবিত হয় নোয়াখালীর ৮টি উপজেলা। বন্যা শেষ হওয়ার দুই মাস পার হলেও মানুষের দূর্ভোগ শেষ হয়নি।
দীর্ঘ হচ্ছে জেলার জলাবদ্ধতার পরিস্থিতি, এর জন্য অবৈধভাবে খাল দখল, খালের ওপর বহুতল ভবন, অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র কালভার্ট, বাঁধ নির্মাণকে দায়ি করে দ্রুত এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।
এর আগে বন্যা নোয়াখালী জেলার গত ৫০-৬০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। সরকারি হিসেব মতে বন্যায় ৪ হাজার ১৯১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে নোয়াখালীতে।
সরেজমিনে জলাবদ্ধ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন সড়ক থেকে পানি নেমে গেলেও এখনও পানি রয়েছে বিভিন্ন বাড়ির উঠানে। কোথাও হাঁটু পরিমাণ, কোথাও এর চেয়ে বেশি পানি রয়েছে। একই চিত্র সদরের নেওয়াজপুরের দৌলতপুর ও বেগমগঞ্জ, ছয়ানীতে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত ২০আগস্ট রাতে ফেনী থেকে নেমে আসা বন্যার পানি প্রবেশ করায় পৌরসভার সবকয়টি এলাকা প্লাবিত হয়। এরই মধ্যে টানা ভারি বৃষ্টিতে প্রতিটি বাড়ির উঠোন ও সড়ক ৮/৯ ফুট পানির নিচে প্লাবিত হয়। নিজেরদের বসত ঘর ছেড়ে আত্মীয়-স্বজনের বহুতল ভবনের বাসা ও পার্শ্ববর্তী আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেন বন্যা কবলিত মানুষজন।
এখনও অনেকে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে রয়েছেন। বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে জেলার সদর, কবিরহাট, সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ, সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলা।
কিন্তু বন্যার দীর্ঘ দুই মাস অতিবাহিত হলেও এখনও পানিবন্দি হয়ে আছে চৌমুহনী পৌরসভার বেশির ভাগ ওয়ার্ড। বিভিন্ন সড়ক থেকে পানি নেমে গেলেও এখনও বেশির ভাগ বাড়ির উঠোনো হাঁটু পরিমান পানি রয়েছে।
মজিবুল হক নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, বসত ঘর থেকে পানি নেমে গেলেও রান্না ঘর ও উঠানে পানি আছে। ঘরের ভিতরে কাঁদা-মাটিতে ভরা। ছোট নাতি-নাতনীদের নিয়ে এ পরিস্থিতিতে ঘরে উঠা সম্ভব না। কারণ যে পরিমাণ পানি রয়েছে এটাতে পড়লে তারা ডুবে যাবে।
তিনি বলেন, প্রায় ২মাস আগে তিনি বাড়ি থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যান। কয়েকদিন আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে যাওয়ার কারনে আশ্রয় কেন্দ্রে থেকে তাঁদের চলে আসতে হয়েছে। এরপর থেকে চৌমুহনী বাজারের ছোট একটি বাসায় ভাড়া নিয়েছেন তাঁরা। এখনও পরিবারের সবাই ওই বাসায় আছে। কবে নাগাদ পানি নামবে, আর কবে বাড়ি আসতে পারবেন তা নিশ্চিত নয় মজিবুল।
স্থানীয়রা বলছেন, শুধু চৌমুহনী পৌরসভা নয় একই চিত্র জেলার সদর উপজেলার নেয়াজপুর, চরমটুয়াসহ বিভিন্ন উপজেলার অনেক ইউনিয়নে এখনও জলাবদ্ধতা রয়েছে। আর এই জলাবদ্ধতা দীর্ঘ হওয়ায় বেড়েছে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ।
জলাবদ্ধ এলাকার লোকজনের অভিযোগ, গত কয়েক বছরে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল ক্ষমতাকে ব্যবহার করে জেলার অধিকাংশ বড় খাল দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে। দোকান-ঘর করে ভাড়া দিয়েছে অনেক স্থানে। সংযোগ খালগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ, অপরিকল্পিতভাবে এ খালগুলোর মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে কালভার্ট, বাড়ির দরজার করা জন্য দেওয়া হয়েছে বাঁধ।
খালে ময়লা-আবর্জনা ফেলায় বন্ধ হয়েছে পানির গতিপথ। যার ফলে দীর্ঘ দুই মাসেও বন্যা কবলিত এলাকাগুলো থেকে পানি নেমে যেতে পারছে না।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নোয়াখালীর পানি লক্ষীপুর হয়ে মেঘনা নদীতে পড়ে। এ কারণে নোয়াখালীর জলাবদ্ধ পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে লক্ষীপুর জেলার খালের উপর সকল বাঁধ, অবৈধ স্থাপনা, ভেসাল জালসহ পানি নামার জন্য প্রতিবন্ধকতাগুলো সরানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নোয়াখালী ও লক্ষীপুর প্রশাসন যৌথভাবে কাজ করা দরকার।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নোয়াখালী খালের সদর উপজেলার বিভিন্ন অংশ, শহরের ওপর ছাগলমারা খাল, চাটখিলের খিলপাড়া, রামনারায়ণপুর, বদলকোট, নোয়খলা, সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া, কেশারপাড়, সোনাইমুড়ী উপজেলার বগাদিয়া উত্তর পোল থেকে কালিকাপুর পর্যন্ত, কলেজ গেইট থেকে নান্দিয়া পাড়া পর্যন্ত, বজরা থেকে চাঁদুপুর পর্যন্ত খাল দখল হয়ে আছে।
এছাড়াও বেগমগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে একাধিক স্থাপনা রয়েছে। চৌমুহনী বাজারে খালের সিংহভাগ অংশ ব্যবসায়িরা ময়লা আর্বজনা ফেলে ভরাট করেছে।
চৌমুহনী বাজারের ব্যবসায়ী মো. সোহাগ বলেন, বড় খাল সংস্কার করার পাশাপাশি ছোট খালগুলোর দখলকৃত স্থান গুলো উদ্ধার করা না হলে এ পানি সহজে নামবে না।
জেলা শহর মাইজদীর সাইফুল ইসলাম নামের এক বাসিন্দা বলেন, শহরে জলাবদ্ধতার কারণ অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা। তাঁর মতে শহরে যেভাবে ড্রেন করার কথা ছিলো সেটি সেভাবে না করে ড্রেনের জায়গায় কোনভাবে নালা করা হয়েছে। আজ প্রায় ৩মাসের বেশি সময় ধরে শহরে জলাবদ্ধতা লেগেই আছে। কবে এটি থেকে মানুষ মুক্তি পাবে এটি কারও জানা নেই।
স্থানীয়দের অভিযোগ, জেলা প্রশাসকের রাজস্ব বিভাগের কাগজে-কলমে অনেক খালের হিসাব থাকলেও বাস্তবে তা নেই। কয়েক বছর ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রভাবশালীরা খালগুলো ব্যবসায়ীদের কাছে ইজারা দিয়েছেন, নিজেরাও দখলে নিয়েছেন অনেকাংশ। অথচ, একসময় জেলার বাণিজ্য কেন্দ্র চৌমুহনী থেকে এসব খাল হয়ে পণ্যবাহী নৌকা জেলার বিভিন্ন উপজেলা এবং পাশের লক্ষীপুর, ফেনী ও চাঁদপুরে যেতো। বর্তমানে নৌকাতো দূরের কথা এসব খাল দিয়ে পানি নামতে পারছে না।
জেলা প্রশাসক খন্দতার ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, বন্যা পরবর্তী সময় বিভিন্ন উপজেলায় একাধিক স্থান থেকে স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় খালের ওপর থাকা কিছু স্থাপনা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে খাল দখল করে যেসব স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে সেগুলো ভাঙ্গাসহ খাল পুনঃসংস্কারের ব্যবস্থা পরিকল্পনায় রয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/আশিক