শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

বৈশাখে নয় ইলিশ নিধন

শাইখ সিরাজ

বৈশাখে নয় ইলিশ নিধন

আজ পয়লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। মহাধুমধামের সঙ্গে পালন করা হচ্ছে বাঙালি জীবনের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং তাত্পর্যময় দিনটি। চারদিকে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ধুম। রমনার বটমূল থেকে শুরু করে দেশব্যাপী মিলনমেলা। বৈশাখ এলেই ইলিশ বিক্রি বাড়ে। বাড়ে দাম। কখনো দাম বেড়ে পাঁচ থেকে ছয় গুণ হয়ে যায়। এই যে আমাদের পান্তা আর ইলিশ নিয়ে এত উত্তেজনা, তার ইতিহাসটা একটু দেখে আসতে চাই প্রিয় পাঠক। প্রথমত, আমরা সবাই জানি বাংলা মাস গণনার এ নিয়মটি চালু করেছিলেন সম্রাট আকবর। সেটি ছিল কৃষি সমাজের পরিবর্তন করার জন্য। তবে একথা সত্য যে, বাংলা ইতিহাসের কোনো জায়গায় উল্লেখ নেই সম্রাট আকবর পান্তার সঙ্গে ইলিশ খেয়েছেন। বা অন্যকে খেতে বলেছিলেন সংস্কৃতির অবশ্য পালনীয় একটি কাজ হিসেবে। দীর্ঘ সময় পর আজ সত্যি পান্তা-ইলিশ যেন আমাদের ঘাড়ের ওপর চেপে বসেছে। কিন্তু, মজার বিষয়, আমরা কেউই সঠিক করে বলতে পারছি না কোথা থেকে এলো এই পান্তা-ইলিশ খাওয়ার রেওয়াজ! সেই উত্তরই খুঁজে চলেছি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরলে এর বংশ বিস্তারে বাধা পড়বে। আর ব্যাহত হতে পারে এই মাছের উৎপাদন কার্যক্রম। যা আপাতদৃষ্টিতে আমাদের জন্য ক্ষতিকর। ইলিশের জন্য তো অবশ্যই। জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহ্বান জানিয়েছেন পয়লা বৈশাখে ইলিশ না খেতে। আমরা জানি সরকার এ সময় ৩০ দিন ইলিশ মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বর্তমানে জাটকা প্রতিপালন মৌসুম চলছে। অক্টোবরের ২২ দিন পূর্ণিমার সময় মা ইলিশ যে পোনা ছেড়েছে সেগুলো বড় হয়ে জাটকা হয়েছে। এই মাছগুলোই কৈশোর পেরিয়ে তরুণ হবে, বড় হবে। তখন সেই মাছ আমরা ধরতে পারি, খেতে পারি। তার আগে নয়। দুঃখের বিষয় মা ইলিশ ধরাও চলছে। একই সঙ্গে জাটকাও। যা মারাত্মক অপরাধ। উল্লেখ্য, গত বছর এই সময়টায় ইলিশ কম ধরা হয়েছে বলে আমরা কিন্তু প্রচুর ইলিশ পেয়েছি। তাও বেশ কম দামে। আমাদের ইলিশ সম্পদ বাড়ছে এভাবেই। এবং আমি নিশ্চিত এই নিয়মগুলো মেনে চলতে পারলে আমরা ইলিশ রপ্তানিও করতে পারব। সাম্প্রতিক সময়ে ইলিশ গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যমতে ইলিশ সংরক্ষণের কারণে জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে ইলিশের একটি ‘মাইনর’ মৌসুম তৈরি হয়েছে। যা আমাদের জন্য শুভ সংবাদ। আর আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর আমরা পেটপুরে ইলিশ মাছ খেতে পারি এবং কম দামে। ফিরে আসি পুরনো আলোচনায়। তাহলে, বছরের একটি দিনকে উপলক্ষ করে ইলিশ নিয়ে এই বাড়াবাড়ির প্রবণতার উদ্ভব হলো কীভাবে? সে উত্তর সহসাই মিলছে না বলে মনে হচ্ছে। এই ইলিশ মাছ নিয়ে গত চার দশক ধরে গণমাধ্যমে বিভিন্ন কাজ করেছি। তারই কিছু অভিজ্ঞতা আজ আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। ভাগ করে নিতে চাই বৈশাখ, বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে আমার নিবিড়তার গল্প।

বৈশাখ মানে নতুন এক আবেদন। নতুন কিছু। সব পুরনোকে বিদায় দিয়ে নতুন করে জেগে ওঠা। আনন্দে, সাফল্যে, নতুন প্রেরণায় বুক বাঁধা। একটা সময় ছিল যখন ঢাকার আশপাশের গ্রামে বৈশাখী মেলা বসত। পুরো দেশের আনাচে-কানাচে এ দিনটি উদযাপন হতো। তখনো নগরবাসী বৈশাখ পালনে ততটা সোচ্চার হয়ে ওঠেনি। এরপর ধীরে ধীরে বৈশাখ এলো রমনার বটমূলে। বৈশাখ হয়ে গেল নগরবাসীর। বৈশাখ হয়ে উঠল কর্পোরেট। বৈশাখের গণ্ডি যেন শুধু এই মহানগরেই একটি বিরাট রূপ পেল। যদিও বৈশাখের ঐতিহাসিক সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা রয়েছে এবং তা পুরো দেশেই। ঢাকার বাইরে আমার খুব মনে পড়ে মেরাদিয়া, গোড়ান, পূবাইল, টঙ্গীর নদীর ওপারে কীভাবে বৈশাখ পালিত হতো। সে সময়ের কথা মনে পড়ে সত্যি অন্যরকম এক অনুভূতি হয়। 

শহরে যখন বৈশাখ এলো তখন এর আলাদা একটা রূপ দিয়ে দিল গণমাধ্যম। পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন—কেউই বাদ পড়ল না। এলো নতুন পোশাক। সাজ-সজ্জা। খাওয়া-দাওয়া। বৈশাখের সেই আদি রূপ পেল নতুন মাত্রা। সেই আদি রূপ হারিয়ে গেলেও বৈশাখ নিয়ে একটা বড় বাজার তৈরি হলো। বাণিজ্য এলো বৈশাখের ওপর। বৈশাখ হয়ে উঠল বাণিজ্যের বলয়। কিন্তু গ্রামের মানুষের কাছে কখন বৈশাখ আসে আর কখন যায়, তারা টেরই পায় না। আর শহরের মানুষের কাছে চলে এলো একদিনের জন্য বাঙালি হয়ে ওঠার এক সুবর্ণ সুযোগ। বৈশাখ পালনে তাদের নানা প্রস্তুতি আমাদের অবাক করে দিল। দিনে দিনে কে কত বেশি আয়োজন করে বৈশাখ পালন করতে পারে, তা নিয়ে শুরু হলো প্রতিযোগিতা। 

প্রিয় পাঠক, বাংলা নববর্ষকে ধরে হালখাতা করার উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআর এবার আনুষ্ঠানিকভাবে চৈত্রসংক্রান্তিও করেছে। কর আদায় না করে, সম্মানজনকভাবে বকেয়া কর পরিশোধের সুযোগ দিয়েছে ব্যবসায়ীদের। দেশের সব আয়কর, শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) কমিশনারদের কার্যালয়ে হালখাতা চলবে বৈশাখ মাসজুড়েই, জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। নিঃসন্দেহে এটি এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ। অন্যদিকে, ক্রেডিট কার্ডে বৈশাখের মাসে ব্যাপক ছাড়ের বিজ্ঞাপনও চোখে পড়েছে। আমাদের পয়লা বৈশাখের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে। বাংলাদেশে বাংলা বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এ বিষয়টি নিঃসন্দেহে গৌরবের। 

একটু অতীতে ফিরে যেতে চাই পাঠক। স্কুল ফাইনাল দিয়ে প্রতি বছর পরিবারসহ শীতকালে নানাবাড়ি যাওয়ার অভিজ্ঞতা ভোলার নয়। বড় হওয়ার পর বাবা নিয়ে যেতে পারতেন না। একবার একা গেলাম। ইলিশের দেশের মানুষ আমি। মেঘনার পাড়েই কেটেছে আমার ছোটবেলা। একবার নানাবাড়ি গোবিন্দিয়া গ্রামে যাওয়ার পথে মৌ মৌ গন্ধ পেলাম রাস্তাঘাটজুড়ে। মেঘনার ধার ঘিরে শুধু ইলিশ আর ইলিশ। আমার হাতের ডানদিকে ছিল মেঘনা নদী। সে স্মৃতি ভোলা যায় না। তিন দিন নানাবাড়িতে থাকার পর ছোট মামার সঙ্গে বাজারে গিয়ে ঠিক করলাম ইলিশ কিনব। যেই কথা সেই কাজ। কিনলাম এক ঝুড়ি ইলিশ। এক টাকায় পাঁচটি ইলিশ। যার প্রতিটির গড় ওজন দেড় কেজি তো হবেই। আমার জীবদ্দশায় আমি এত বড় ইলিশ মাছ দেখিনি। আর আজ, পয়লা বৈশাখে একটি ইলিশের দাম দাঁড়ায় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা।

পেশাগত জীবনে ঢোকার পর মাটি ও মানুষের অনুষ্ঠানের কারণে ইলিশ নিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন তৈরি করেছি। ইলিশ সংরক্ষণের ওপর কাজ করতে গিয়ে প্রথম জানতে পারলাম একটি ডিমওয়ালা ইলিশ খেয়ে ফেলা মানে ১০ লাখ ইলিশ খেয়ে ফেলা। বিষয়টি আমাকে প্রচণ্ড প্রভাবিত করল। ভাবলাম সত্যিই তো কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরা যাবে না। প্রিয় পাঠক, বলে রাখি, বাস্তবিক অর্থে আমি নিজে যখন এ দৃশ্য ধারণ করতে যাই তখন জানতাম না কারেন্ট জাল মানে কি। কেউ জিজ্ঞাসা করলে প্রথম প্রথম উত্তর দিতে পারতাম না। মনে হতো বিদ্যুৎ দিয়ে মাছগুলোকে টেনে আনা হয় এমন কোনো জাল বুঝি এ কারেন্ট জাল। পরে কাজ করতে গিয়ে জেনেছি মনো ফিলামেন্ট জাতীয় এক ধরনের সুতা দিয়ে তৈরি এ জাল এক অদৃশ্য জাল যা পানির সঙ্গে মিশে যায়। কোনো মাছ আটকালে শুধু জড়াতেই থাকে। নিয়ম ছিল ৯ ইঞ্চির নিচে মাছ ধরা যাবে না। ছোট মাছ যেন জাল দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে সেরকমই নির্দেশনা ছিল সরকারের পক্ষ থেকে। সেই নির্দেশনা অনেকেই মেনেছে, অনেকেই মানেনি। এখনো ঘটনাটা প্রায় সেরকম। কিন্তু কিছুটা হলেও সচেতন হয়েছে মৎস্যশিকারিরা। যেমন ইলিশের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা অনেক কমেছে। সমুদ্রের মাছ ইলিশ হলেও একটি নির্দিষ্ট সময় এ মাছটি নদীতে আসে। গত ৪০ বছরে দেখেছি মাছই যাদের একমাত্র জীবিকা যারা দাদন নিয়ে কষ্ট করে মাছ ধরেই জীবন চালায়, প্রশাসন কোনো এক অজানা কারণে এ নিরীহ মানুষগুলোর জাল পুড়িয়ে দেয়। অথচ মূল দোষী চলে যায় অন্তরালে। একটা সময় এসে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে, অর্থাৎ মাছ না ধরার সময়ে, নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ, খাওয়া দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। সেগুলো পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকায় জেলেদের বেশ সুবিধা হয়েছে।

গত সপ্তাহেই চাঁদপুরের ইলিশসমৃদ্ধ এলাকা হাইমচরে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠান ধারণ করতে গিয়েছিলাম। জানলাম ইলিশ ধরা বিরতি চলছে। চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক নিজেও এ ব্যাপারে বেশ তত্পর। তিনিও সরেজমিন দেখাশোনা করেন। নৌকা নিয়ে চলে যান মাঝনদীতে। তিনি জানালেন অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ১৪ হাজার জেলেকে ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে চাঁদপুরে। প্রকল্পটি দিন দিন বড় হচ্ছে। আর এ সময়ের ভিতর ইলিশের উৎপাদন নিশ্চিতভাবেই বাড়ছে। গত ১০ এপ্রিল চাঁদপুরে ইলিশের মহালে গিয়েছিলাম। দেখলাম দেদার চলছে ইলিশের বেচাকেনা। অথচ এ মৌসুমে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। পয়লা বৈশাখে আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে থাকে নানা আয়োজন। ভাই-বোন সবাই মিলে দারুণ উপভোগ্য হয়ে ওঠে সময়টি। আর খিলগাঁওয়ে আমাদের পৈতৃক বাড়িটি নতুনভাবে নির্মাণ করে পয়লা বৈশাখেই উঠেছিলাম কয়েক বছর আগে। সে জন্য, পহেলা বৈশাখ আমার এবং আমার পরিবারের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। 

প্রিয় পাঠক, জাটকা প্রতিপালন মৌসুমে মাছ না ধরার কার্যক্রম বিস্মৃত হয়েছে। এ সময় যেসব জেলে মাছ ধরছেন না তাদের জন্য ব্যবস্থা হয়েছে নানা অনুদানের। জাটকা ধরা কমেছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। তবুও বৈশাখের একটি দিনে বাজার ধরার জন্য ব্যবসায়ীদের এ দাম হাঁকানো এবং অবশেষে বৈশাখের মান রক্ষায় এরকম গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল মৌসুমে ইলিশ খাওয়া ও অতিথিদের জন্য আপ্যায়ন করার বিষয়টি বেশ কষ্টই দেয়। আমি আশা করি, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের উচিত হবে প্রজনন মৌসুমে ইলিশ মাছ ক্রয় থেকেও বিরত থাকা, যদিওবা তা বাজারে পাওয়া যায়। এভাবেই একজন থেকে শুরু করে যখন সবাই এ নিয়ম মেনে চলবে, নিশ্চয়ই জেলে এবং ব্যবসায়ীদেরও নিরুৎসাহিত করা যাবে নিষিদ্ধ মৌসুমে ইলিশের বাণিজ্য থেকে। আর এর মাধ্যমে আমরা নিজেরাই কিন্তু রক্ষা করতে পারব আমাদের জাতীয় সম্পদ, আমাদের গৌরবের, অহংকারের আর স্বাদের ইলিশ মাছ। স্বল্প দামে পেটপুরে খেয়েও রপ্তানি করতে পারব আমাদের জাতীয় মাছ।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

            [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর