বান্দার বৈশিষ্ট্য হলো, কখনো যদি তার দ্বারা গুনাহ সংঘটিত হয়ে যায় তখন সে অস্থির হয়ে পড়ে। চোখের মাঝে ময়লা পড়লে যেমন সারা শরীর অস্থির হয় এবং সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে পড়বে। তদ্রুপ মুমিন বান্দার দিলের মধ্যে ময়লা পড়লে সব নেক আমল বন্ধ হয়ে যায়। আল্লাহপাক আমাদের হেফাজত করুন!
যারা গুনাহ করেছে আখেরাতে তাদের তো প্রায়শ্চিত্ত আছেই, তাদের শাস্তির কথা শুনে তখন জান্নাতিরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বে। সেদিন ছোট-বড়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ভালো-মন্দ, ধনী-গরিব সবাইকে আল্লাহর সম্মুখে হাজির হতে হবে। দুনিয়াতে যারা আল্লাহকে ভয় করেছে কেয়ামতের দিন তাদের মুখ থাকবে চিন্তামুক্ত। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘তাদের ভয় প্রদর্শন করো’। উল্লেখ্য, ভয় দুই প্রকার (১) যার সঙ্গে শত্রুতা আছে তাকে ভয় করা। অর্থাৎ শত্রুকে ভয় করা। শত্রু মানুষও হতে পারে, পশুও হতে পারে। যেমন সাপ। সাপ মানুষের মিত্র নয়; বরং স্থায়ী শত্রু। একজন আমাকে ভয় প্রদর্শন করল, এ রাস্তায় যেও না, সাপ আছে এ হলো এক ধরনের ভয় প্রদর্শন।
(২) এক ছাত্র আরেক ছাত্রকে বলল, তুমি যদি ক্লাসে অনুপস্থিত থাক তাহলে ওস্তাদজি তোমাকে শাস্তি দেবেন। কিংবা মুরিদ আরেক মুরিদকে বলল, পীরসাহেব যে আমল ঠিক করে দিয়েছেন সেগুলো যদি তুমি আদায় না কর তাহলে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে তোমার জন্য বদদোয়া করবেন, তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রথম প্রকারের ভীতি প্রদর্শন আর দ্বিতীয় প্রকারের ভীতি প্রদর্শনের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। দ্বিতীয় প্রকারের ভীতি প্রদর্শন মায়া, দরদ, হিতাকাক্সিক্ষত ও কল্যাণকামিতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। এ ধরনের ভীতি প্রদর্শনের জন্য আরবি ভাষায় (ইনজার) শব্দ ব্যবহার করা হয়। কোরআনে কারিমে আল্লাহ রসুলে মাকবুল (সা.)-কে (বাশিরান ওয়া নাজিরান) আখ্যায়িত করে বলেছেন, আমি তোমাকে বাশির ও নাজির হিসেবে পাঠালাম। বাশির মানে, তুমি তাদের জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান কর, যাতে তারা জান্নাতের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে খুব বেশি পরিমাণে নেক আমল করে। তদ্রুপ আমি তোমাকে নাজির হিসেবে পাঠালাম, তুমি তাদের ভয় প্রদর্শন কর, যাতে তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের জন্য চেষ্টা করে।
নবীর ভয় প্রদর্শন একমাত্র কল্যাণকামিতার ভিত্তিতেই হয়। আল্লাহপাক নবী (সা.)-কে আদেশ করে বলেছেন, তাদের কল্যাণের জন্য তুমি তাদের ভয় প্রদর্শন কর। নবীগণ উম্মতের জন্য কল্যাণকামী হন। তারা যে ভয় প্রদর্শন করেন সেটা কল্যাণের জন্য। কিন্তু উম্মতের অনেকে এ বিষয়টিকে বোঝে না। যেমন অনেক ছাত্র তার ওস্তাদের, অনেক মুরিদ তার পীরের, অনেক সন্তান মাতা-পিতার কল্যাণ কামনাকে কল্যাণ কামনা হিসেবে বোঝে না বরং তাদের শাসক হিসেবে জ্ঞান করে। এটা তাদের ভুল ধারণা। কোনো পিতা-মাতা কখনো সন্তানের জন্য অকল্যাণ কামনা করতে পারেন না, কোনো হক্কানি পীর কখনো মুরিদের অকল্যাণ চাইতে পারেন না, কোনো আদর্শ ওস্তাদ কখনো ছাত্রের অকল্যাণ আশা করতে পারেন না; এতটুকু যদি জানা থাকে তাহলে তো কামিয়াব। মুরুব্বির ধমকের কারণ যদি জানা থাকে তাহলে বহু পেরেশানি ও ক্ষতি থেকে বাঁচা যাবে। ধমক খেলে চিন্তা করতে হবে যে, যিনি আমাকে ধমকালেন তিনি আমার পিতা, অতএব এ ধমকের ভিতরে আমার জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। পীরসাহেব ধমক দিয়েছেন তিনি তো আমার জন্য অবশ্যই কল্যাণকামী, বুঝতে হবে তাঁর ধমকের মধ্যে আমার জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। ওস্তাদের ক্ষেত্রেও ঠিক একই বিশ্বাস রাখতে হবে। মনে করতে হবে, ওস্তাদের যে কোনো শাস্তি ও ধমকে অবশ্যই আমার জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এতটুকু যদি ছাত্ররা বোঝে তাহলে তারা কোনো দিন ওস্তাদের সঙ্গে বেয়াদবি করতে পারে না, মুরিদরা পীরের সঙ্গে বেয়াদবি করতে পারে না, সন্তানরা পিতা-মাতার সঙ্গে বেয়াদবি করতে পারে না।
জনৈক বুজুর্গ তার ভক্তদের নিয়ে কোথাও যাচ্ছেন, এমন সময় এক লোক তাকে শক্ত ভাষায় গালি দিয়ে বসল। পীরসাহেব তার বিশেষ খাদেমকে বললেন, তুমি লাঠি দিয়ে তাকে দু-চারটি বাড়ি দিয়ে আসো। খাদেম ভাবল হুজুর দয়ালু মানুষ, এখন রাগ করে এমন হুকুম করেছেন, কিছুক্ষণ পর হয়তো তাঁর এ রাগ থাকবে না, এসব ভেবেচিন্তে সে আর পীরসাহেবের নির্দেশ পালন করেনি। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল যে, ওই গালিদাতা মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ল। তখন পীরসাহেব খাদেমকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি তাকে প্রহার করোনি? খাদেম বলল, না। পীরসাহেব বেদনা ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললেন, ইস! তুমি কী সর্বনাশ করলে! আমি তোমাকে নির্দেশ দিয়েছি গালিদাতাকে দু-চারটি পিটুনি দিতে আর তুমি মানলে না! আমি তো এই নির্দেশ দ্বারা তার প্রতিশোধ নিয়ে তার ক্ষতি বা অকল্যাণ করতে চেয়েছি এমন নয়। বরং আমি তার কল্যাণ করতে চেয়েছিলাম। আমার নির্দেশ পালন করে তুমি যদি তাকে দু-চারটি পিটুনি দিতে তাহলে তার মৃত্যু হতো না, তার মৃত্যুকে ঠেকানোর জন্যই আমি তোমাকে পেটাতে বলেছিলাম। যেহেতু আমি প্রতিশোধ নিইনি তাই আল্লাহপাক আমার পক্ষ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছেন, আর যদি আমি প্রতিশোধ গ্রহণ করতাম তাহলে আল্লাহপাক বলতেন, যার প্রতিশোধ সে নিয়ে নিয়েছে, আমার আর প্রতিশোধ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। দেখলেন? এখানে রহস্যটা কোথায় লুকিয়ে রয়েছে! লাঠি দিয়ে পেটানো হলে বাহ্যিকভাবে দেখা যায় যে, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে রাগ ও ক্ষোভ মেটানো হচ্ছে কিন্তু আসলে যে তার ভালোর জন্য, কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য এরূপ করা হয়েছে।
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ