মানবতার মুক্তির দূত আদর্শ সমাজ সংস্কারক মহানবী (সা.) বলেন, মুনাফিকের নিদর্শন হলো তিনটি- যখন সে কথা বলবে তখন মিথ্যা বলবে এবং যখন অঙ্গীকার করবে তখন তা ভঙ্গ করবে আর যখন তার কাছে আমানত রাখা হবে তখন সে তা খেয়ানত করবে। অপর বর্ণনা মতে চতুর্থ একটি নিদর্শন হলো- যখন ঝগড়া-বিবাদে উপনীত হবে তখন সে অশ্লীল আচরণ করবে। (সহিহ বুখারি)। নামাজ রোজা ইসলামের শ্রেষ্ঠতম ইবাদত। আল্লাহর ইবাদত করা মুসলমানদের পরিচয় ও একান্ত কর্তব্য। তবে নামাজ-রোজা যতই হোক না কেন দুর্নীতি ও অনৈতিকতা পরিপূর্ণ মুসলিম হওয়ার পথে অন্তরায়। মিথ্যা বলা, মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, আপন কর্তব্যে অবহেলা করা, কাজে ফাঁকি দেওয়া সবই ইসলামের দৃষ্টিতে দুর্নীতির অন্তর্র্ভুক্ত। জাল সার্টিফিকেট বানানো, মানব কল্যাণে প্রচলিত বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করা তো আমরা বুদ্ধিমান লোকের কাজ বলে ধারণা করি। অথচ এসব ভয়াল গ্রাস সমাজটাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যোগ্য প্রাপককে বঞ্চিত করা, অযোগ্য ও স্বজনকে দায়িত্ব অর্পণ করা বর্তমান সমাজে নিত্যদিনের দুর্নীতিতে রূপ নিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে গোপন বৈঠকের কোনো তথ্য ফাঁস করাও দুর্নীতি হিসেবে গণ্য হয়। বেতনভুক্ত কাজে ফি নেওয়া এবং কোনো কাজের ধার্যকৃত ফি অপেক্ষা অতিরিক্ত বিনিময় নেওয়া ইত্যাদি জঘন্যতম দুর্নীতি। ইবাদত বন্দেগি করুক বা না-ই করুক দুর্নীতিতে লিপ্ত ব্যক্তি পরিপূর্ণ মুসলমান নয়। বরং হাদিসের ভাষায় সে মুনাফিক-ভেজাল মুসলিম। আজকের সমাজ দুর্নীতির বেড়াজালে আবদ্ধ। মানবসেবার প্রায় প্রতিটি সেক্টরে দুর্নীতি ছেয়ে গেছে। বর্তমান বিশ্বের রক্ষকরাই ভক্ষকের নায়ক। সাধারণ মানুষ দুমুঠো ভাত আর তাদের অধিকারের আকুতি জানাচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা আরও শোষণের চেষ্টা করছে। শ্রমিক তার পাওনা আদায়ে মিছিল করছে। আর মালিকপক্ষ শ্রমিকের কাজ বুঝে পাওয়ার জন্য কঠোর অবস্থান নিচ্ছে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নিজের পাওনা যথাযথ না পাওয়ার অভিযোগ আমাদের নিত্যসঙ্গী। সব অভিযোগের পেছনে খেয়ানত ও দুর্নীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর প্রতিরোধকল্পে ইসলাম সব ধরনের দুর্নীতিকে হারাম ঘোষণা করেছে। ইহ ও পরকালে শাস্তির বিধান উল্লেখ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে আপন আপন কর্তব্য ও দায়িত্ব সঠিকভাবে আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে। মালিককে বলেছে শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগে তার মজুরি প্রদান কর। আর শ্রমিককে মালিকের পাওনা আদায়ের প্রতি যত্নবান হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এভাবে মাতা-পিতা, সন্তান, স্বামী-স্ত্রী এবং রাজা-প্রজা সবাইকে আপন আপন দায়িত্ব আদায়ের প্রতি নির্দেশনা প্রদান করেছে ইসলাম। মহানবী (সা.) ঘোষণা করেন ‘নিশ্চয়ই তোমার প্রতি তোমার প্রভুর অধিকার আছে, নিশ্চয়ই তোমার প্রতি তোমার শরীরের অধিকার আছে, নিশ্চয়ই তোমার প্রতি তোমার পরিবারবর্গের অধিকার আছে, নিশ্চয়ই তোমার প্রতি তোমার মেহমানের অধিকার আছে, নিশ্চয়ই তোমার প্রতি তোমার স্ত্রীর অধিকার আছে, অতএব প্রত্যেকের অধিকার যথাযথভাবে আদায় কর।’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)। দুর্নীতি দমনের জন্য সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং দুর্নীতি দমন কমিশন প্রশংসিত পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে আমরা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, যাদের মধ্যে ইসলামের আদর্শ নেই, অন্তরে খোদার ভয় নেই, আইনের মাধ্যমে তাদের দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় তাদের অনৈতিক অপকর্মের দুরভিসন্ধি থেকে বের করে একটি রোল মডেল সমাজ বিনির্মাণের দিকে এগিয়ে নেওয়া। তাই দুর্নীতিমুক্ত একটি আদর্শ দেশ গড়ার আন্দোলনে, প্রতিটি নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, অসহায়দের বিড়ম্বনা মুছে দেওয়ার স্বপ্ন পূরণে ইসলামের নীতি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। নেই মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শ ব্যতীত আমাদের শান্তি ও মুক্তির অন্য কোনো উপায়।
♦ লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা