শিরোনাম দেখে চমকে ওঠেনি এমন কেউ হয়তো থাকতে পারে। তবে আল্লাহর এক খোশনসিব বান্দা সত্যি সত্যিই একদিন সকালে হৃদয়ের ফুল নবীর কদমে রাখার আকুতি নিয়ে এ গোনাহগারের দুয়ারে হাজির হয়েছেন। প্রথমে কিছু বুঝতে পারিনি। বোঝার পর কিছু বলতে পারিনি। যা বলেছি তা আমি বলেছি নাকি আমাকে দিয়ে অন্য কেউ বলিয়েছেন তা এখনো বড় রহস্য আমার কাছে। আর রহস্য নয়। এবার খুলে বলার পালা।
দিনক্ষণ মনে আছে। তবে বলব না ব্যক্তিগত কারণে। সময়টা ছিল দুর্গাপূজার আগে আগে। আমরা যারা দেশের নানা প্রান্তে ওয়াজ করে বেড়াই, আমাদের সবারই অল্প সংখ্যক অমুসলিম শ্রোতা থাকে।
বরিশালের এক এলাকায় প্রায় প্রতি বছরই আমার যাওয়া হয়। অনেক জ্ঞানী বা ভালো বক্তা এ কারণে নয়, লোকজন আমাকে ভালোবাসে বলেই দাওয়াত করে। ওই এলাকায় আমার দুজন সনাতন ধর্মাবলম্বী ভক্ত আছেন। একজনের নাম রমেশ। অন্যজন গণেশ। আজকের নায়ক এই রমেশ। ৩০ বছরের টগবগে যুবক। ছোটবেলা থেকেই সে আমার ওয়াজ শোনে। একদিন সাহস করে দেখা করতে এলো। ছোট্ট করে বলল, ‘হুজুর! আমি সনাতন ধর্মের। তবে আপনার ওয়াজ নিয়মিত শুনি। খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে যখন নবীজির কষ্টের জীবনের কথাগুলো বলেন চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না।’ মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘আল্লাহ তোমাকে ইসলামের জন্য কবুল করুন।’
এরপর থেকে যখনই ওই এলাকায় মাহফিলে যাই সে আমার সঙ্গে দেখা করে। কোনো বছর তাকে না দেখলে খোঁজ নিয়ে আমি দেখা করি। করোনার আগের ঘটনা। মাহফিল শেষে রমেশ বিদায় নিতে এসে বলল, ‘হুজুর দোয়া করবেন ইসলাম কবুল করতে চাই কিন্তু সামাজিক বাধা অনেক।’ কানের কাছে মুখ লাগিয়ে বললাম, ‘গোপনে কালেমা পড়ে নাও। পরিস্থিতি বুঝে ঘোষণা দিও।’ ‘জি ইনশাল্লাহ’ বলে সে বিদায় নিল। সেদিন রমেশের মুখে ‘ইনশাল্লাহ’ শুনে বুকটা ভরে গেল। এরপর যখনই আমার রমেশের কথা মনে হতো, তার হেদায়াতের জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করতাম।
করোনার বছর আর বরিশালের মাহফিলে যাওয়া হলো না। কী এক কারণে পরের বছরও ওই মাহফিল হলো না। তবে সময়ে সময়ে রমেশের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। একদিন রাতে দীর্ঘ সময় কথা হলো তার সঙ্গে। তার আগ্রহের বিষয় ছিল নবীজি (সা.) দেখতে কেমন ছিলেন! নবীজিকে যারা দেখেছেন তাদের চোখ দেখতে কেমন! ওই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও বুঝি প্রশান্তি আর তৃপ্তির রোশনাই চোখে লাগে! সে বলল, ‘জানেন হুজুর! যেদিন নবীজির কথা শুনেছি, সে থেকে প্রতি রাতে বিছানায় যাই নবীজিকে স্বপ্ন দেখার আকুতি নিয়ে। এমন অনেক রাত কেটেছে নবীজিকে ভেবে দুই চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে। বারবার বলতাম, হে কৃপার নবী! আমি মুসলমান নয় এ কারণেই কি আমাকে দেখা দেন না? অথচ আপনার জীবদ্দশায় কত অমুসলিম আপনাকে দেখেছে। ভাগ্য আমার এতই খারাপ যে, ডাক শুনেও না শোনার ভান করে আছেন! এমনিভাবে আরও কত রাগ-অনুরাগ নিয়ে নবীজির কদমে হৃদয়ের ফুল বিছিয়ে দেওয়ার আকুতি জানিয়ে রাত কাটে সেসব কথা মোবাইলে বলা সম্ভব নয়।’ আমি বললাম, ‘তাহলে ঢাকায় চলে আসো! তোমার সব কথা শুনব।’
আমাকে অবাক করে দিয়ে পরদিন বিকালে সত্যি সত্যি রমেশ সোজা অফিসে। সেদিন ছিল সরকারি ছুটি। অফিসে আমি একা। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল রমেশ। বারবার জিজ্ঞেস করছি, কী হয়েছে বলো। কান্নার কারণে কিছুই বলতে পারছে না।
প্রায় এক ঘণ্টা লাগল স্বাভাবিক হতে। স্বাভাবিক হওয়ার পর সে যা বলল, তাতে আমার শরীর পুরোপুরি বরফ হয়ে গেল। রমেশ বলল, ‘এত বছরের অপেক্ষার অবসান হলো। হৃদয়মন্দির সাজিয়ে যাকে এত দিন কেঁদে কেঁদে ডেকেছি, কাল রাতে তিনি এসে আমাকে ধন্য করেছেন। গতকাল রাত থেকেই আমি মুসলমান। আমি নবীর উম্মত। আমি শিরক মুক্ত। আমি ইমানি কাফেলার সদস্য। আবেগের বশে আরও অনেক কথাই বলছিল আমার ভাই। তবে কোনো কথাই আমার কানে যাচ্ছিল না।
এক অজানা ঢেউ এসে হৃদয়ের পাড় ভাঙতে শুরু করল। প্রথমে ফুঁপিয়ে, তারপর চাপা স্বরে, অবশেষে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘হে নবী! তোমাকে ভালোবাসার মতো ভালোবাসতে পারিনি বলে কেয়ামতের দিন এ গোনাহগারকে দূরে রেখো না! ভুলে যেও না। তাড়িয়ে দিও না।’
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি
পীর সাহেব, আউলিয়ানগর
www.selimazadi.com