ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। বাঙালির অতি প্রিয় এই মাছ। পাঁচ-সাত রকম মাছ থাকলেও আমরা ইলিশই সবার আগে পাতে তুলি। চিংড়ির মালাইকারি, চিতলের পেটি, পাঙ্গাশের ঝোল, রুইয়ের মাথা রেখে আমরা নিই ইলিশ। ইলিশ শুনলেই আমাদের রসনাসিক্ত হয়ে ওঠে। শর্ষে ইলিশ, ভাপা ইলিশ, ইলিশ পাতুরি, কড়া ভাজা, দোপেঁয়াজা, ঝোল কচুর পাতা এবং ইলিশ মাছের কাটা, মাথা ইত্যাদির ঘণ্ট সবই প্রিয়। পেটে ডিমভরা ইলিশ এবং সুগন্ধি চাল দিয়ে রান্না হয় ইলিশ পোলাও। এ ছাড়াও ইলিশ ভাপে, ভেজে, সিদ্ধ করে, কচি কলা পাতায় মুড়ে, পুড়িয়ে সরিষা দিয়ে, জিরা, বেগুন, আনারস দিয়ে শুকিয়ে শুঁটকি করে রান্না করা হয়। ইলিশের ডিমও খুব জনপ্রিয়। ইলিশ মাছে প্রচুর তেল থাকে। তাই এই মাছ রান্না করতে খুব অল্প তেল লাগে। ২০১৭ সালে ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
বর্ষায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ামাত্র শুরু হয় ইলিশ আর খিচুড়ি রান্নার ধুুম। এ মাছ আমাদের কখনো ক্লান্ত করে না অর্থাৎ ইলিশ খেতে কখনই একঘেয়েমি আসে না আমাদের। কিন্তু একঘেয়েমি তো দূর, আমাদের ক’জনের পাতে ইলিশ পড়ে সেটা লাখ টাকার প্রশ্ন! আর যে মাছ সর্বসাধারণ খেতে পারে না সেটা কী করে জাতীয় মাছ হয় এটাও কোটি টাকার প্রশ্ন!
ইলিশ সামুদ্রিক মাছ। ডিম পাড়ে বড় নদীতে। ডিম ফুটে বাচ্চা বড় হলে সাগরে ফিরে যায়। সাগরে ফিরে যাওয়ার পথে জেলেরা এই মাছ ধরে। ডিম পাড়ার জন্য ইলিশ সাগর থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতের নদীতে আসে। বাংলাদেশ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, ত্রিপুরা ও আসামে ইলিশ অত্যন্ত জনপ্রিয়। আসামে ‘ইলিশ’কে ইলিশ নামেই ডাকা হয়। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশেও ইলিশ পাওয়া যায়। সেখানে ইলিশকে ডাকা হয় পাল্লু মাছ।
ইলিশ মাছের চাষ হয় না। জেলেরা নৌকা নিয়ে নদীতে গিয়ে জাল ফেলে মাছ ধরে। মাছ আনা হয় উপকূলবর্তী ঘাটে। সেখান থেকে বরফের চাদরে মুড়ে পাঠানো হয় দেশের দূরবর্তী স্থানসমূহে। ভোলা জেলার তজুমুদ্দিনে মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় সর্বাধিক ইলিশ পাওয়া যায়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইলিশ পাওয়া যায় বরগুনা জেলায়।
ইলিশ প্রধানত পদ্মা, মেঘনা নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। তবে পদ্মার ইলিশের স্বাদ সবচেয়ে ভালো। ভারতের রূপনারায়ণ, গঙ্গা ও গোদাবরী নদীর ইলিশ তাদের সুস্বাদু ডিমের জন্য বিখ্যাত। ইলিশ মাছ সাগর থেকেও ধরা হয়। তবে সাগরের ইলিশ নদীর মাছের মতো স্বাদু না।
ওয়ার্ল্ড ফিশের পরিসংখ্যান মতে, ৮৬ শতাংশ ইলিশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। ইলিশ চর্বিযুক্ত মাছ আর ইলিশে প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড (ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড) রয়েছে। ইলিশ মাছ টুকরো করে লবণে জারিত করে অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায়। এভাবে সংরক্ষিত ইলিশকে ‘নোনা ইলিশ’ বলে। এটা দিয়েও বিভিন্ন সুস্বাদু পদ রান্না করা হয়।
পান্তা ইলিশ, পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ ভাজা এবং শুঁটকি পয়লা বৈশাখের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।
‘মাছে ভাতে বাঙালি’র জীবনে ইলিশই সেরা রসনায় মাছ। মাছের রাজা বা রানি যাই বলা হোক।
ইলিশকে বলা হয় ‘নোনা জলের রুপোলি শস্য’। একসময় বিজ্ঞাপন হতো, ‘মাছের রাজা ইলিশ, বাত্তির রাজা ফিলিপস!’ ইলিশ নিয়ে যুগ যুগ ধরে আমাদের সাহিত্যে কত গান, কবিতা ও ছড়া, গল্প রচিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই! ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি জনপ্রিয় লোকগান এমন : ‘রাজার পালন মাছ ইলিশা রে, / জামাই ভোজনের মাছ ইলিশা রে, / রাঁন্ধনি পাগল মাছ ইলিশা রে। / ছাওয়াল কান্দাইন্যা মাছ ইলিশা রে।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর একটি ছড়া বালক ও শিশু-কিশোরদের মুখে মুখে ফিরত : ‘ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা/ বোয়াল মাছের দাড়ি। / টিক্কা খান ভিক্ষা করে/ শেখ মুজিবের বাড়ি।’ ইলিশে অসংখ্য কাঁটা আছে। নানা রকম ছোট-বড় কাঁটা। বেশ মুশকিলের সে কাঁটাগুলো। গ্রামবাংলায় প্রবাদ শুনেছি : ‘মাছের মধ্যে ইলিশ/ চাকরির মধ্যে পুলিশ।’ পুলিশেরও অনেক কাঁটা আছে, মুসিবতের কাঁটা। সেটা বোঝা যায় পুলিশের হাতে পড়লে! কথায় বলে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ইলশে গুঁড়ি’ কবিতাটির প্রথম লাইন ‘ইলশে গুঁড়ি, ইলশে গুঁড়ি/ ইলিশ মাছের ডিম’ আমাদের শিশুমনকে দোলায়িত করত। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়লেই আমরা নেচে-গেয়ে উঠতাম। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝিতে আছে রাতভর পদ্মা নদীতে ইলিশ ধরা এবং ভোরবেলা জাহাজ ঘাটে ইলিশ কেনাবেচার বর্ণনা। উপন্যাসটির শুরুই হয়েছে ইলিশ ধরার বর্ণনা দিয়ে। ‘বর্ষার মাঝামাঝি। পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মওসুম চলিয়াছে। নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে, মাছের নিষ্পলক চোখগুলোকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতো দেখায়।’ বুদ্ধদেব বসুই ‘ইলিশ’ কবিতাটি অসামান্য : ‘রাত্রিশেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে/ জলের উজ্জ্বল শস্য রাশি রাশি ইলিশের শব/ নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়। / তারপর কলকাতার বিবর্ণ শহরে ঘরে ঘরে ইলিশ ভাজার গন্ধ;/ কেরানির গিন্নির ভাঁড়ার সরস সর্ষের ঝাঁজে। / এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।’
নববর্ষে ইলিশের সংযোগ বেশি দিনের কথা না। ইলিশ যুক্ত হলো, মধ্যবিত্ত বাঙালি লুফে নিল। পয়লা বৈশাখে ইলিশ সংস্কৃতি এ দেশে ছিল না। কিন্তু ছিল না বলেই যে নতুনভাবে গ্রহণ করা যাবে না এমনটা তো নয়। এখন ইলিশ রমনার বটমূল আর টিএসসি ছাড়িয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। যাদের সাধ্য আছে তারা চেষ্টা করে ইলিশ দিয়ে নববর্ষের দিনটিকে উদযাপন করতে। নববর্ষ যে একটি সর্বজনীন উৎসবের দিন এটা এখন জানে শ্রমজীবীরা। এটাও এক ধরনের জাগরণ। মাঝেমধ্যে খবরের কাগজে দেখি, এ দেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ-উৎসবের কথা। ইলিশ আমাদের রাজনীতিতেও যুক্ত হয়ে পড়েছে। তাই বঙ্গভবন ও গণভবনে বিদেশি অতিথিদের জন্য ইলিশ অবধারিত।
বিদেশিদের কাছে ইলিশের কদর অনেক। অন্য দেশের রাজ্যপ্রধান, সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সৌজন্যে বাক্সবন্দি করে উপঢৌকন হিসেবে ইলিশ পাঠানোর রেওয়াজও আছে। ইদানীং ইলিশ বেচাকেনা হয় ওজন দরে, কেজি হিসেবে। একসময় বিক্রি হতো পিস, জোড়া বা হালি হিসেবে। ইলিশ কেটে বিক্রি করতে দেখেছি ছেলেবেলায়। সেটা খুবই ভালো। যারা গোটা কিনতে পারত না তারা ভাগ কিনে নিত। শুনেছি সুপারশপগুলো থেকে প্রয়োজন মতো কেনা যায়। কিন্তু দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত ভয়ে এসব শপের দিকে তাকায়ও না। ইলিশ এখন দরিদ্র তো বটেই, মধ্যবিত্তেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সামুদ্রিক, চানপুরী ও পদ্মার ইলিশের ভিন্ন ভিন্ন দাম! যে-মাছটি যত বড় তার দাম ততই বেশি। কমবেশি দু-হাজার। তাই ঝিলিক দেওয়া ইলিশ পাতে নেওয়ার সাধ্যি গরিবের নেই। তাদের দৌড় ‘জাটকা’ পর্যন্ত। এখন পুকুরে চাষ করা নকল ইলিশও পাওয়া যায়। নাম তা চন্দনা, নামখানা মন্দ না। আগেই বলেছি প্রসবের সময় হলে গর্ভবতী ইলিশ বর্ষাকালে সমুদ্র্রে পতিত নদীর মোহনা পেরিয়ে ঝাঁকে-ঝাঁকে, লাখে-লাখে চলে আসে মিঠা পানিতে। ওরা হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করে চলে আসে পদ্মা-মেঘনায়। চলে যায় যমুনা-গঙ্গা পর্যন্ত। এই নদীগুলো যেন ইলিশের বাপের বাড়ি। এ দেশের আবহমানকালের ঐতিহ্য মেয়ে সন্তান প্রসবের জন্য আসেন বাপের বাড়ি। এরাও যেন আসেন বাপের বাড়ি। ছানা-পোনা জন্ম দেন ওদের নানাবাড়িতে। ডিমে প্রাণসঞ্চার হলে শরতে চলে যায় স্বামীগৃহে, সমুদ্রে।
দেশের অধিকাংশ মানুষের বরাতে না-জুটলেও তারা বাজারে-বন্দরে দেখতে পায় চকচকে ঝকঝকে ইলিশ! তাকিয়ে তাকিয়ে খানদানি মাছ দেখেন আর হাহুতাশ করেন। ইলিশের রূপ আছে, স্বাদ-গন্ধ, খাদ্যগুণও বিস্তর। কেবল তাই নয়; বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশের আছে সাংবিধানিক স্বীকৃতি। শত শত টন রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যমও এই ইলিশ।
সূক্ষ্ম কাঁটাযুক্ত বলে ইলিশ বিদেশিরা খেতে অপারগ। কিন্তু ইলিশের স্বাদ তারাও জেনে গেছে। তাই ভিনেগারে চুবিয়ে রেখে কাঁটা নরম করে রান্না করা হয় তাদের জন্য। একে বলে ‘বোনলেস ইলিশ’। কাঁটার ইংরেজি যে কবে থেকে বোন হলো কে জানে। অসামান্য সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন ভোজনরসিক। বেহেশতের খাদ্য-তালিকায় শর্ষে-ইলিশ নেই বলে স্বর্গে যেতে অমত প্রকাশ করেছেন তিনি।
বিগত সরকারের আমলে প্রতি বছর দুর্গাপূজার আগে ৪ হাজার টন ইলিশ পাঠানো হতো ভারতে। এবারও ভারতের পক্ষ থেকে ইলিশ পাঠানোর আবদার করে বাংলাদেশের কাছে চিঠি এসেছে। তবে এবার ভারতে কোনো ইলিশ যাবে না বলে জানিয়েছিলেন অন্তর্র্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেছিলেন, ‘এবারের দুর্গোৎসবে বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ অন্য নাগরিকরা যেন ইলিশ খেতে পারে, সেটি নিশ্চিত করা হবে। ভারতের চেয়ে দেশের জনগণকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে।’
আমি সরকারের এই সিদ্ধান্তকে মনে মনে সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। আমাদের ইলিশ আমরা আগে খাব এটাই সংগত। খাওয়ার পর যদি উদ্বৃত্ত থাকে তবেই দেওয়ার প্রশ্ন। কিন্তু আজ এই লেখা যখন লিখছি, তার আগেই সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে ৩ হাজার টন ইলিশ ভারতে রপ্তানি করা হবে। তা পাঠানোই যখন হবে আগেভাগে এসব কথার দরকার কী? তবে এটাও শুনছি, আগে পাঠানো হতো উপঢৌকন হিসেবে, এবার পাঠানো হচ্ছে রপ্তানি পণ্য হিসেবে।
সমস্যা হচ্ছে ইলিশ ভারতকে না দিলেও দেশের সাধারণ মানুষ খেতে পারত না অত্যন্ত চড়া দামের জন্য। ইলিশের দাম যদি কমানো না যায় তাহলে ইলিশ ভারতকে দেওয়া হোক বা না হোক তাতে কিছু আসবে যাবে না। দরিদ্র জনগোষ্ঠী আগেও ইলিশ খেতে পারেনি, এখনো পারবে না। তাই সবার আগে দরকার দাম কমানোর জন্য চোরাচালান রোধ করা, সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া, চাঁদাবাজি বন্ধ করা, বাজার মনিটরিং করা। অর্থাৎ যে মাছটি জাতীয় মাছ তা যেন সবার পাতে পড়ে এটাই আমাদের চাওয়া।
লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক