জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর দেশজুড়ে নানা পরিবর্তনের জোয়ার এসেছে। রাষ্ট্র পুনর্গঠনের নানা উদ্যোগ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। একই সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রথম পর্যায়গুলোও দেখা যাচ্ছে। এমনই একটা ক্ষেত্র উচ্চশিক্ষা। মেধা বৈষম্যের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া এ বিপ্লবের অন্যতম দাবি ছিল শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রকে মেধার ভিত্তিতে পুনর্গঠন করা, যেন মেধাই হয় শিক্ষা আর চাকরিতে প্রবেশের এবং পেশাগত পদোন্নতির মূল নিয়ামক।
বিগত দিনগুলোতে ব্যাপকভিত্তিক দলীয় রাজনীতিকরণের ফলে নানা ধরনের প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য কোটা পদ্ধতি উচ্চশিক্ষা এবং পেশাগত উচ্চপদের যাওয়ার পথে মেধাকে অবমূল্যায়ন করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা এবং আমলাতন্ত্রের নানা শাখার যে কোনো একটিতে নজর দিলেই এ হতাশাজনক অবস্থা টের পাওয়া যায়। এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, যেখানে ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তি করা ব্যতীত শিক্ষকতার পদে নিয়োগ পাওয়া যেত। আর যারা কোনোভাবে নিয়োগ ম্যানেজ করে ফেলত তাদেরও অবিরাম লেজুড়বৃত্তি করে যেতেই হতো চাকরিতে টিকে থাকা এবং পদোন্নতি পাওয়ার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে মুক্তবুদ্ধি চর্চা আর গঠনমূলক সমালোচনার স্থান হওয়ার কথা, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে সংকীর্ণ দলীয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ফলস্বরূপ, জাতীয় রাজনীতিতে বা জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ইস্যুতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে কোনো ধরনের গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যেত না। এর বদলে দেখা যেত ক্ষমতাসীনদের প্রতি নির্লজ্জ চাটুকারিতা। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্র ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে পরিচালিত হতো। এ কারণেই নিজেদের বিবেক বিসর্জন দিয়ে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন এবং সেইসঙ্গে শিক্ষক ও পেশাজীবী নেতৃত্ব স্বৈরাচারের পক্ষ নিয়ে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে নেমেছিল।
নতুন বাংলাদেশ হবে মেধাভিত্তিক এবং সব নাগরিকের অংশগ্রহণের জন্য উন্মুক্ত। আর এ জনআকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন সম্ভব কেবল একটা মেধাভিত্তিক সমাজ গঠনের মধ্য দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মেধাভিত্তিক করে পুনর্গঠনের প্রথম পদক্ষেপ হবে এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে উচ্চতর জ্ঞান উৎপাদনে সক্ষম পেশাগত বুদ্ধিজীবী প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা। জুলাই বিপ্লবের পর উচ্চশিক্ষায় নতুন নেতৃত্ব আসছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলাতে উপাচার্য এবং উপউপাচার্য পদে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে পেশাগত মেধাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়েই নেতৃত্বের জন্য মনোনীত অধ্যাপকদের অবস্থান নিজ নিজ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মানে তুলনামূলকভাবে সর্বোচ্চ। আরও একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, নতুন নেতৃত্বের সম্পর্কে তাদের ছাত্রছাত্রীদের উচ্চ ধারণা। সামাজিকমাধ্যমে নতুন এসব উপাচার্য ও উপউপাচার্যদের নিয়ে তাদের ছাত্রছাত্রীদের উচ্ছ্বাস ও আশাবাদ থেকেই বোঝা যায়, আগের নেতৃত্বের সঙ্গে তাদের গুণগত পার্থক্যটা। আগে উপাচার্যের পদে নিয়োগ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হাতে কুক্ষিগত ছিল বলে নেতৃত্বে থাকা অধ্যাপকরা তাদের পেশাগত দায় জলাঞ্জলি দিয়ে স্বৈরাচারের পদলেহনে অনেকে বাধ্য হতেন, আবার কেউ কেউ ব্যক্তিস্বার্থের লোভে স্বৈরাচারের পায়ে মাথানত করতেন। কিন্তু নতুন নেতৃত্বকে দেখা যাচ্ছে ছাত্রবান্ধব এবং বিভিন্ন জাতীয় ও পেশাগত ইস্যুতে গঠনমূলক সমালোচনায় অংশ নিতে। অর্থাৎ, তারা শুধু পেশাগত যোগ্যতাতেই উপযুক্ত নন, একইসঙ্গে সামাজিক ও মানবিক দায় নিতেও সক্ষম।
নতুন উপাচার্যরা যেহেতু তাদের মেধা ও পেশাগত দক্ষতার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেতৃত্বে এসেছেন, ফলে তাদের কোনো স্বৈরাচারের পদলেহন করার জন্য কাঠামোগত চাপ নেই। একইসঙ্গে পেশাগতভাবে তারা গবেষণা, প্রকাশনা ও শিক্ষাদানে নিষ্ঠার কারণেই তাদের নেতৃত্বে মেধার পরিচর্যা ও বিকাশের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনগুলো পরিপুষ্ট হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। এ প্রেক্ষিতে আমি একটা সুনির্দিষ্ট দিকে নজর দিতে বলি। সেটা হলো- বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ। বিগত দেড় দশকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতার পদে নিয়োগের যে ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল সেটাকে এক ধরনের বর্ণভেদ প্রথাও বলা যায়। মেধার বদলে দলীয় লেজুড়বৃত্তিকে প্রধান মাপকাঠি হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। শিক্ষা ও গবেষণায় উৎকর্ষকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতাসীন দল এবং তার অধীনে ক্ষমতাবান শিক্ষক নেতাদের প্রতি আনুগত্য ব্যতীত শিক্ষকতার পদে যাওয়া ছিল কল্পনারও অতীত। এর ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে অংশ নিত শিক্ষক নিয়োগে প্রভাবশালী দলীয় ও শিক্ষক নেতাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের অসুস্থ প্রতিযোগিতায়। নিয়োগ পাওয়ার পরও ক্ষমতার পদলেহন চলতেই থাকত, যেহেতু সেটাই ছিল পদোন্নতিসহ আর সব সুযোগ-সুবিধা লাভের একমাত্র উপায়। ফলে এমনকি বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষকতায় এসেও অনেকেই গবেষণা ও প্রকাশনার পথ ছেড়ে ক্ষমতার লেজুড়বৃত্তিকেই মূল কাজ হিসেবে বেছে নিতেন।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানে পড়েছি। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থেকেছি। নিজের ব্যাচে মেধার ভিত্তিতে প্রথমদিকে ছিলাম। জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ছিল বিধায় সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়ে ক্লাসে এবং ক্লাসের বাইরে পড়াশোনা করছিলাম। শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় আবেদনও করেছিলাম। এটুকু ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপট বলার কারণ হলো এটা বোঝানো যে, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে আমার আলাপটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।
আমি দেখেছি যে, শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন প্রকাশের আগে বিভাগের একটা কমিটিতে (সিনিয়র অধ্যাপকরা থাকেন, সব শিক্ষক নয়) আলোচনার ভিত্তিতে পদের সংখ্যা নির্ধারণ করে ডিনের অফিসে চিঠি দেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় বিভাগীয় প্রধান এবং তার আশপাশে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা শিক্ষকদের মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা। এ পর্যায়ে অনার্স আর মাস্টার্স পরীক্ষার ফলাফল ছাড়া সম্ভাব্য প্রার্থীদের তুলনা করার আর কোনো নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি নেই। কিন্তু সেই ফলাফলও আবার তাদের নিজেদের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ, যেহেতু তারা নিজেরা প্রায়শই ফলাফলকে প্রভাবিত করেন। এর ফলে ক্ষমতাবান শিক্ষকের ব্যক্তিগত পছন্দ/অপছন্দই হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষক নিয়োগের প্রকৃত মাপকাঠি।
বিভাগীয় প্রধানের পাশাপাশি অনুষদের ডিন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্যও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেইসঙ্গে সিন্ডিকেটের প্রতিনিধি এবং বিষয়ের বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে একজন সিনিয়র অধ্যাপক। চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়া দেখে বোঝার উপায় নেই যে, বিশেষ বিশেষ চাকরিপ্রার্থীর পক্ষে তদবির করা ছাড়া নিয়োগ কমিটিতে এ সদস্যদের প্রকৃত কাজ কী? এক্ষেত্রে আমি পিএইচডি ছাত্র এবং এখন শিক্ষক হিসেবে আমেরিকার দুটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতার আলোকে অনুমান করছি যে, ডিনের মূল কাজ হলো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় উল্লিখিত পদগুলো আসলেই দরকারি কিনা, তাদের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার মতো রিসোর্স বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে কিনা, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা ঠিকঠাক মতো অনুসরণ করা হয়েছে কিনা ইত্যাদি। বিষয়ের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকের কাজ হলো বাছাই প্রক্রিয়ায় প্রার্থীদের তুলনামূলক যোগ্যতাগুলো ঠিকঠাক মতো যাচাই-বাছাই করা হয়েছে কিনা, মনোনীত প্রার্থী যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন কিনা ইত্যাদি। নিয়োগ কমিটির প্রধান হিসেবে উপউপাচার্য মূলত অলংকারিক, যিনি কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতার সঙ্গে আরও ডজনখানেক প্রার্থীর অভিজ্ঞতা থেকে আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি যে, শিক্ষক নিয়োগের কমিটিতে সদস্যদের ভিন্ন ভিন্ন দায়দায়িত্ব নিয়ে আমি যে কথাগুলো বললাম, এ নিয়ে অধিকাংশ নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক ও সেসব পদে আবেদনকারীদের অভিজ্ঞতা পৃথক। বিদ্যমান অবস্থায় প্রত্যেক সদস্যই নিজেদের পছন্দের প্রার্থী ঠিক করে নিয়েই তারপর অন্যদের সঙ্গে আলাপে বসেন। ফলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হলে আগ্রহী ছাত্রছাত্রীরা প্রথমে খোঁজ নেয় নিয়োগ কমিটিতে কে কে থাকবেন এবং এরপর তাদের দুয়ারে ধরনা দেওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামে। কয়েক মাস থেকে বছরব্যাপী এ নিয়োগ প্রক্রিয়া একটা নামসর্বস্ব ভাইভা বোর্ডে গিয়ে ঠেকে, যেখানে কয়েক মিনিটের একটা প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রার্থীদের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয় নিয়োগ বোর্ডের। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে নিয়োগবঞ্চিত প্রার্থীরা নানা মুখরোচক গল্পকাহিনি শেয়ার করেন পরিচিতদের মধ্যে। কেউ কেউ শেয়ার করেন সামাজিকমাধ্যমেও। তবে নিয়োগপ্রাপ্তরা সাধারণত নিশ্চুপ থাকেন তাদের ভাইভা বোর্ডের অভিজ্ঞতা নিয়ে। যে দুই-চারজন কিছু কিছু শেয়ার করেন, সেগুলো আদতে বিশ্বাসযোগ্য হয় না।
মেধার ভিত্তিতেই নিয়োগ হওয়ার কথা উচ্চশিক্ষার স্তরে মেধার পরিচর্যায় নিয়োজিত শিক্ষকদের। কিন্তু তাদের মেধার মূল্যায়নে ভালো ফলাফল আর মানসম্মত প্রকাশনার মতো স্বীকৃত মাপকাঠি বাদ দিয়ে বাস্তবে নিয়োগ কমিটির সদস্যদের ব্যক্তিগত পছন্দ/অপছন্দকে শিক্ষক বাছাইয়ের মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর ফলে প্রায়শই দেখা যায় যে, আবেদনকারীদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে যোগ্যতম প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নিয়োগ কমিটি প্রভাবশালী সদস্যের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালিয়ের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। প্রথমত মেধার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পরীক্ষিত এবং স্বীকৃত প্রার্থীরা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী প্রাপ্য পদে ঢোকার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। তুলনামূলক কম যোগ্য প্রার্থীরা শুরু থেকেই জানে যে, তারা নিয়োগ পেয়েছে কারও বিশেষ অনুকম্পায়, মেধার জোরে নয়। ফলে সেই অনুকম্পাকেই তারা ধরে রাখতে সচেষ্ট হয় শিক্ষকতার পদে থাকতে এবং পদোন্নতি পেতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিজের পড়াশোনা ও গবেষণাকে সর্বদা এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টার বদলে ক্ষমতাবান শিক্ষক বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখাই তার জন্য বাস্তবে বেশি জরুরি এবং লাভজনক হয়ে পড়ে। এ প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্কের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমশ হয়ে ওঠে এক ধরনের জমিদারি ব্যবস্থার মতো, যেখানে ক্ষমতাসীনের চাটুকারিতার মাধ্যমে নিয়োগ, পদোন্নতি, ক্ষমতার ভাগাভাগি চলে। আর কার্যত জ্ঞানের উৎপাদনের পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের এক্সপার্ট হিসেবে গড়ে তোলার মূল কাজটুকুই গৌণ হয়ে পড়ে। অতএব, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্রমাবনতির মূলে আছে এ ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থা।
নতুন বাংলাদেশে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের জন্য উচ্চশিক্ষা সংস্কার করতে হবে। আর এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সংস্কার দিয়ে শুরু করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানচর্চার মানের ক্রমাবনতির মূল কারণই হলো অস্বচ্ছ এবং তদবিরভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থা। অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করেছি কীভাবে এ ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ থেকে শিক্ষকদের ক্ষমতার প্রতি অনুগত দাসত্বের দিকে ঠেলে দেয়। এ বিষয়টা কোনো বিশেষ ব্যক্তির না। বরং কাঠামোগত। নিয়োগ কমিটির কোনো সদস্য বা কোনো বিশেষ প্রার্থী ইচ্ছা করলেই এ কাঠামোগত ব্যবস্থার বাইরে যেতে পারেন না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে শীর্ষস্থানীয় কারও পক্ষেও এ পদ্ধতির বাইরে গিয়ে কাউকে নিয়োগ দেওয়া দুরূহ; আবার একইভাবে বিশ্বের অন্যতম নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি এবং স্বনামধন্য জার্নালে গবেষণা-প্রকাশনা থাকার পরও কোনো প্রার্থীর পক্ষে তদবির ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি পাওয়া অসম্ভব।
যেহেতু সমস্যার গোড়াটা নিয়োগ প্রক্রিয়ার কাঠামোর মধ্যে, অতএব সংস্কার করতে হবে কাঠামোরই। শিক্ষক নিয়োগ কমিটিকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যেন সেখানে কোনো সদস্যের পক্ষেই ব্যক্তিগত প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ না থাকে। কেউ ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে কোনো প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে না পারলে প্রার্থীরা তাদের কাছে ধরনা দেওয়া বাদ দিয়ে তাদের মেধার মূল্যায়নের জন্য ভালো ফলাফল আর মানসম্মত গবেষণা-প্রকাশনার দিকে মনোযোগ দেবেন। এর ফলে ব্যক্তিগতভাবে তারা নিজেদের জ্ঞান ও গবেষণা সক্ষমতার মানোন্নয়নে সর্বদা সচেষ্ট হবেন। ফলে তারা নিজেরা যেমন নিজ নিজ বিষয়ে এক্সপার্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন, সেই সঙ্গে তাদের ছাত্রছাত্রীরাও উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং গাইডেন্স পাবে। ক্রমশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসগুলো হয়ে উঠবে মুক্ত ও উন্নত জ্ঞানচর্চার সূতিকাগারে। শুধু মেধার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়াকে লক্ষ্য হিসেবে স্থির করতে হবে। এরপর দেশের বাইরে প্রতিবেশী এবং দূরবর্তী দেশগুলোর উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে দেখতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া। বিশেষ করে নজর দিতে হবে বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনামূলক দেশগুলোতে, আর সেইসঙ্গে এমন দেশগুলোর দিকে, যাদের মডেল হিসেবে অনুসরণ করা যেতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের এ যুগে বাইরের বিশ্বে শিক্ষক নিয়োগ সম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহ করা কোনো সমস্যাই নয়। দরকার শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী সংস্কারে সদিচ্ছার।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় (কাতার ক্যাম্পাস) পিএইচডি গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লস অ্যাঞ্জেলেস