হামাস যোদ্ধারা গত বছরের ইসরায়েলের অভ্যন্তরে অতর্কিত আক্রমণ চালাল। ফলে ৩৮০ জন ইসরায়েলি সেনাসহ নিহত হলো আরও ১ হাজার ২০০ বেসামরিক নাগরিক। হামাসের সদস্যরা ২৫০ জন ইসরায়েলি নাগরিককে ধরে নিয়ে গেল। তারপর থেকে ইসরায়েল সরকার গাজায় যে বর্বর হামলা ও সীমাহীন নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে তার এক বছর পার হয়েছে। অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রায় ৮ দশক ধরে ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর বর্বর আক্রমণ ও গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। জোর করে জমি ও বসতি দখল করে আসছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর পরবর্তী সময়ে তা আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করল। বলে রাখা ভালো হামাসের অতর্কিত হামলার সূচনা না হলেও ফিলিস্তিনের ভাগ্যে যা ঘটার তাই কিন্তু ঘটে চলছিল। ইসরায়েল নানা অজুহাতে ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকার বরাবরই হরণ করে আসছিল। ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে একটি সম্প্রসারিত ইহুদি রাষ্ট্র কায়েম এবং ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করার কৌশল ইসরায়েল বরাবরই গ্রহণ করে আসছিল। দুনিয়ার তাবৎ আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে ইসরায়েল ফিলিস্তিনে যে বর্বরতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো দৃষ্টতা দেখিয়ে চলছে মানব ইতিহাসে এর কোনো নজির নেই। আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের সরাসরি সমর্থন ও উসকানিতে ইসরায়েল এই বর্বরতা চালানোর সাহস পেয়েছে। দুঃখের বিষয়, জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসরায়েলের বর্বরতা থামাতে হয় নীরব থেকেছে, না হয় তেলআবিবকে সাহায্য করেছে।
এক বছরে কী হারাল ফিলিস্তিন : বিগত এক বছরে ফিলিস্তিনের যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তার সঠিক বর্ণনা দেওয়া সত্যিই কঠিন। ইতিহাসের এক জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে ফিলিস্তিনে। গাজাসহ আশপাশের অনেক এলাকা একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এই সময়ে ইসরায়েল গাজা ভূখণ্ডের ৪০ হাজার স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, ইসরায়েলের ভয়াবহ বিমান ও স্থল হামলায় প্রায় ৪২ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ১৩ হাজারই শিশু। এক হিসাব মতে, এক বছরে হামাসের ৮ জন ব্রিগেড কমান্ডার, ৩০ জন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ও ১৬৫ জন কোম্পানি কমান্ডার নিহত হয়েছেন। আল-জাজিরার হিসাব মতে, গাজায় এক বছরে ৮৫ হাজার টন বিস্ফোরক ফেলা হয়েছে। ফলে গাজার প্রায় ৭৫ শতাংশ স্থাপনা ও ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। বাড়িঘর ধ্বংসের সংখ্যা ৮০ হাজারের মতো বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাব মতে, অন্তত ৪ কোটি টন ইটপাথরের ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়েছে গাজায়। জাতিসংঘের ধারণা এই ধ্বংসস্তূপ সরাতে ১৫ বছর সময় লাগবে এবং ৫০ থেকে ৬০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ হবে। জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংকের এক হিসাব মতে, গাজায় যে অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে তার আর্থিক মূল্য হবে ১ হাজার ৮৫০ কোটি ডলার। ইসরায়েলি হামলায় ৬০০টির বেশি মসজিদ, ৩টি গির্জা, ২০০ সরকারি ভবন এবং ১২২টি বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। গাজা শহরের সব সেনিটারি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে। গাজায় অব্যাহত বিমান ও স্থল হামলায় ১৯ লাখ অধিবাসী বাস্তচ্যুত হয়েছে। যেখানে ১৪১ বর্গমাইল আয়তনের গাজার অধিবাসীর সংখ্যা আগে ছিল ৩০ লাখ। ইসরায়েলি বর্বরতা ও ধ্বংসযজ্ঞের ফলে গাজা ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। বাগানের পর বাগান ধ্বংস হয়েছে। গাজার বর্তমানে এলাকাটির ৮০ শতাংশ মানুষ বেকারত্বের শিকার। জাতিসংঘ মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘গাজায় দুর্ভিক্ষ অনিবার্য। একবার সেখানে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে মানুষের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে পড়বে।’
যুদ্ধে ইসরায়েলের কী ক্ষতি হলো : গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের ক্ষতি ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। বিপুল জনশক্তি ক্ষয় থেকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ নানা দিক থেকে ইসরায়েল এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে। দেশটির সেনাবাহিনীর তথ্য মতে, যুদ্ধের এক বছরে ৭২৬ জন সেনা নিহত হয়েছে তার মধ্যে ৩৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায়। তবে হামাস ও বিশেষ কয়েকটি গণমাধ্যমের ধারণা এই সংখ্যা অনেক বেশি হবে। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে হামাস ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নাগরিককে হত্যা ও ২৫০ জনকে জিম্মি করেছিল। এই এক বছরে ৪ হাজার ৫৭৬ জন সেনা আহত হয়েছে বলে তেলআবিব ঘোষণা করলেও হামাসের হিসাবে এই সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। কেননা, ইহুদিবাদী ইসরায়েল সর্বক্ষেত্রে মিথ্যা ও প্রতারণামূলক তথ্য দিয়ে সত্যকে আড়াল করতে সিদ্ধহস্ত। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সদস্য ১ লাখ ৫০ হাজার। আর রিজার্ভ বাহিনীর সদস্য সাড়ে তিন লাখ, যার ৮২ শতাংশ পুরুষ এবং ১৮ শতাংশ নারী। তাদের বয়স ২০ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। সামরিক বাহিনীর সদস্যের ঘাটতি পড়ার কারণে ইতোমধ্যে রিজার্ভ বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছে ইসরায়েল।
এক বছরের যুদ্ধে ইসরায়েলের অর্থনীতি নিদারুণ সংকটের মধ্যে পড়েছে। ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে দেশটির অর্থনীতি ২০ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ফলে জিডিপি কমেছে ৩ শতাংশ। প্রতিদিন ইসরায়েলকে যুদ্ধের জন্য ব্যয় মেটাতে ২০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হচ্ছে। হামাস, হিজবুল্লাহ এবং হুতি বিদ্রোহীদের অব্যাহত হামলার মুখে দেশটির বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার নাগরিককে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। তাদের অনেককে হোটেলেও রাখতে হচ্ছে। এ জন্য ব্যয় হচ্ছে প্রচুর অর্থ। প্রচুর ব্যয় মেটাতে দেশটি আরও ৪৫ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে বলে ঘোষণা করেছে। তবে এই বিপুল অর্থ বাইরে থেকে আনতে হবে। যদিও এই বিপুল খরচের মাত্র ১৪ বিলিয়ন দিয়েছে দেশটির পরম বন্ধু আমেরিকা। অর্থনীতির এই বেহাল অবস্থার মধ্যে আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা ইসরায়েলের রেটিংকে অবনমন করেছে। যেখানে ২০২৩ সালে রেটিং ছিল ‘এ প্লাস’ সেটি এখন করা হয়েছে ‘এ মাইনাস’। ফলে দেশটিতে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বলা আবশ্যক, ইসরায়েল একটি টুরিজমের দেশ। প্রতি বছর গড়ে টুরিজম থেকে আয় হয় ৫ বিলিয়ন ডলার। সেটি এখন প্রায় শূন্যের কোটায় এসে দাঁড়িয়েছে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইসরায়েলের ভাবমূর্তি নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়েছে। বিশ্বের দেশে দেশে দেশটির বর্বরতা ও হিংস্রতা নিয়ে চরম নেতিবাচক প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে। ফলে শুধু মুসলিম বিশ্বেই নয়, খোদ আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। আমেরিকা ও পশ্চিমের দেশগুলোর অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ইসলায়েলের বর্বরতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। এই বিক্ষোভ দীর্ঘ মেয়াদে তেলআবিরের জন্য একটি অশনিসংকেত বলে বিষেশজ্ঞরা মত দিয়েছেন। বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে আমেরিকার সহযোগিতা ও সমর্থনে ইসরায়েল কতিপয় মুসলিম দেশের সঙ্গে শান্তি ও বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পন্ন করেছিল। যেটি ‘আব্রাহাম চুক্তি’ নামে পরিচিতি। এর আওতায় মিসর, আমিরাত, বাহরাইন ও সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত ছিল। গাজা যুদ্ধের ফলে সেটি আপাতত থমকে গেছে। শুধু থমকেই যায়নি, বরং অনেকে সেই চুক্তি থেকে সরে গেছে, যা ইসরায়েলের জন্য চরম নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে। এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা গাজায় চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হত্যাযজ্ঞের জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করেছে, যেটিকে সমর্থন দিয়েছে মিসর।
উল্লেখ্য, মিসর হলো আব্রাহাম চুক্তিতে সই করা প্রথম দেশ। তা ছাড়া ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব ব্যক্ত করে তার কার্যক্রমের নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছে।
এমতাবস্থায় গাজা যুদ্ধ অবসানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ইসরায়েল গাজাকে একেবারে নিঃশেষ করে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইসরায়েল হামাসকে নির্মূল করতেও বদ্ধপরিকর। তবে এক বছরের লড়াইয়ে হামাসের শক্তিকে ইসরায়েল কোনোক্রমেই নিস্তেজ করতে পারেনি। বরং হামাস আরও শক্তিশালী হয়ে সামগ্রিক আক্রমণ চালাচ্ছে এবং তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। দুনিয়াব্যাপী হামাসের প্রতি সমর্থন বেড়েছে। আর তাদের সাহসী লড়াই ও প্রতিরোধের জন্য প্রশংসিত হয়েছে।
ইসরায়েলের নিরাপত্তার অহংকার ‘আয়রন ডোম’ এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। হুতি, হামাস, হিজবুল্লাহ ও মাঝেমধ্যে ইরানের চতুর্মুখী আক্রমণের মুখে ইসরায়েলের জনগণের এখন বেহাল অবস্থা। প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর অবিরাম মিসাইল হামলা এবং গোলার ভয়ে ইসরায়েলের নাগরিকরা প্রায় প্রতিদিন কয়েকবার বাংকারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। এটা দেশটির নাগরিকদের জন্য অস্বস্তিকর এবং চরম ভীতিকর বৈকী! তাই দেশের নাগরিকরা প্রতিনিয়ত প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও তার সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। শুধু তাই নয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা পর্যন্ত হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুতির আক্রমণের ভয়ে বাংকারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক অনেক বিশ্লেষকের মতে, ইসরায়েল একটি দুর্ভাগ্যজনক পতনের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। সামনের দিনগুলো সেদিকেই যাবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, আন্তর্জাতিক ভাষ্যকার ও ব্যাংকার