দেশের বরেণ্য গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরায়জী। রাজনীতি ও গীতিকবিতা; তাঁর জীবনে দুটোই যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো লেগে আছে। তাঁকে বলা হয় দেশের প্রধানতম অন্তর্ভেদী গীতিকবি। প্রেম ও বিচ্ছেদের আবরণে আধ্যাত্মিক গীতি রচনায় তিনি অদ্বিতীয়। এ গীতিকবির সঙ্গে কথা বলেছেন- পান্থ আফজাল
নতুন দেশে কেমন লাগছে?
আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, তখন ছোট ছিলাম। এবারের যে ঘটনা ছাত্র গণ অভ্যুত্থান, সেটা এত ব্যাপকভাবে মানুষের মনে প্রভাব ফেলেছে, মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেছে এবং বিশেষ করে ছাত্ররা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মৃত্যুকে যে উপেক্ষা করা যায়, মৃত্যুকে যে জয় করা যায়, মানুষের জন্য জীবনকে যে বিলিয়ে দেওয়া যায়-এটাতো একটা অনন্য, অসাধারণ ঘটনা! এ ঘটনা এখন শুধু বাংলাদেশের নয়, এ ঘটনা বিশ্ব রাজনীতিতে আন্দোলন-সংগ্রামের ‘আইকন’ হিসেবে থাকবে। কারণ, এত সহজে মানুষ মৃত্যুকে জয় করে ফেলেছে।
আন্দোলন থেকে আমাদের কী শেখার রয়েছে?
অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। যেমন জনগণই সবচেয়ে বড় শক্তি, আপনি যতই পরাক্রমশালী হন না কেন। আর আমার জীবন শুধু নিজের জন্য নয়, আমার জীবন মানুষের জন্য, দেশের জন্য। এই যে দৃষ্টিভঙ্গি জাগ্রত হচ্ছে সেইটা আমাদেরকে একটা উন্নত সমাজের দিকে নিয়ে যাবে। কারণ, আমার চোখের সামনে অন্যায় ঘটবে, হত্যাকান্ড সংঘটিত হবে, দেশটা রসাতলে চলে যাবে, আইনের শাসন থাকবে না, গুম হবেন কিন্তু প্রতিবাদ থাকবে না- সেটা কিন্তু আর মানবিক সমাজ থাকবে না। আমাদের মূল উদ্দেশ্যটা- মানুষ মাত্রই হচ্ছে ক্রমাগত মানুষ হওয়া। শুধু অর্থবিত্ত দিয়ে বেঁচে থাকাই তো মানুষ হওয়া নয়। বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য হচ্ছে- আপনি মানব সমাজের কী প্রয়োজনে লেগেছেন? যে ঐশ্বরিক একটা জীবন লাভ করলাম সেটার কাজটা কী হচ্ছে? আমি যদি মানবতার পক্ষে না দাঁড়াই, সত্যের পক্ষে না দাঁড়াই সেই জীবন তো অমর্যাদারকর জীবন। দেখুন আমাদের মুগ্ধকে, ‘পানি লাগবে পানি?’। তাঁর মৃত্যু ঘটেছে কিন্তু তার যে মূল্যবোধ আমাদের মধ্যে বিস্তার করে দিয়েছে সেটাকে এমন কোনো শক্তি নাই যে ফেরাতে পারবে। তাই আমরা যে কাজটাই করি নাটক লিখি, গান লিখি বা যাই করি সেটার মধ্যে সত্যের সঙ্গে বসবাস থাকতে হবে। সেটার সঙ্গে নৈতিকতার বসবাস থাকতে হবে। আমাদের সমাজ হয়ে পড়েছে অর্থবিত্তের সমাজ, যেটা কখনো হওয়া উচিত নয়। সমাজ হতে হবে জ্ঞাননির্ভর সমাজ। জ্ঞান হচ্ছে এমন এক অমূল্য সম্পদ, যেটা দেখা যায় না। নৈতিকতা, ভালোবাসাও কিন্তু দেখা যায় না। এগুলোই অনন্য সম্পদ। সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আপনি বেঁচে থাকার উপায়কে বড় করবেন নাকি বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যকে বড় করবেন। আমরা যেন সবাই উন্নত জীবনের চর্চা করি।
যতদূর জানি, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন...
আমি তো নৈতিকভাবেই পরিপূর্ণভাবে যুক্ত ছিলাম। আর প্রথমেই পত্রিকায় লিখেছিলাম এর সাংবিধানিক দিক নিয়ে। আবু সাঈদ যেদিন মারা যায় তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেছি, এ প্রজন্মের বীর আবু সাঈদ। তারপর মুগ্ধকে নিয়ে লিখেছি। সাঁজোয়া যান নিয়ে লিখেছি, রিয়াকে নিয়ে লিখেছি। তারপর বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের ব্যানারে রাস্তায় অবস্থান করেছি। তারপর গণমানুষকে অন্যায়ের প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছি, বক্তৃতা দিয়েছি, রাজপথে গিয়ে মানুষের অবস্থান স্বচক্ষে দেখেছি। মানুষের ভিতরে শক্তিকে প্রত্যক্ষ করেছি।
এখন কেমন রাষ্ট্র চান?
সেই রাষ্ট্র চাই, যেই রাষ্ট্রের প্রতিটা মানুষ তার আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। আমরা সেই রাষ্ট্র চাই, যেই রাষ্ট্রের প্রতিটা মানুষ সাম্য মানবিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, প্রতিটা নাগরিক যেন সামাজিক সুবিচার পায়। এমন রাষ্ট্র চাই যেখানে কুঁড়েঘর থাকবে না, রাজপ্রাসাদও থাকবে না।