দেশের সিনেমা হলের মতো এখন পর্যাপ্ত পরিমাণ ও মানসম্মত ছবির অভাবে লোকসান গুনে খুঁড়িয়ে চলছে সিনেপ্লেক্সগুলো। সিনেপ্লেক্স মালিকদের সাফ কথা- ছবির অভাব পূরণ না হলে অচিরেই তারা সিনেপ্লেক্সগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন। এ বিষয়ে কয়েকজন সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের বক্তব্য তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
এক বছরের মধ্যে কোনো সিনেপ্লেক্স ও হল থাকবে না
মির্জা খালেক, কর্ণধার, লায়ন সিনেমাস, ঢাকা
দুই ঈদ ছাড়া আর ছবি পাওয়া যায় না, বাকি সময় যে ছবিগুলো মুক্তি পায় সেগুলোকে ছবি বলা যায় না, এক কথায় অখাদ্য। তিনি বলেন, লায়ন সিনেমাস-এর বয়স এখন প্রায় ৯৫ বছর, ভাবছিলাম অন্তত ১০০ বছর পূরণ করে ভাবব কী করব। তবে বর্তমান অবস্থায় আর মনে হয় না টিকিয়ে রাখতে পারব। ইতোমধ্যে চিন্তা ভাবনা করছি বন্ধ করে দেব। কারণ, হল চালাতে অন্তত মাসে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ আছে। কমপক্ষে গত তিন মাসে মোট ১৫/১৬ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে, তা থেকে ছবির পরিবেশকের অংশ ও ভ্যাট বাদ দেওয়ার পর হয়তো ৭/৮ লাখ টাকা টিকেছে। ১০ লাখ টাকা হিসাবে তিন মাসে খরচ ৩০ লাখ টাকা থেকে ৭/৮ লাখ বাদ দিলে অন্তত ২২ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। ইতোমধ্যে ভারতীয় যে কয়টি ছবি মুক্তি পেয়েছিল তার মধ্যে কেবল ‘জওয়ান’ ছবিটি ভারতের সঙ্গে একই দিন মুক্তি দেওয়া হয়। বাকি একটি ছবিও সময়মতো মুক্তি দেওয়া হয়নি, তাই কাঙ্ক্ষিত ব্যবসা করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকারের মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে আর হয়তো হিন্দি ছবি আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে না। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি দেশি ছবি দিয়ে হল টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। কারণ পর্যাপ্ত ও মানসম্মত দেশি ছবি নিয়মিত পাওয়া যায় না। হিন্দি ছবি আসবে বা আসছে ভেবে দেশের বেশ কিছু উদ্যোক্তা নতুন সিনেপ্লেক্স তৈরির জন্য পরিকল্পনা করছিলেন, ইতোমধ্যে বেশ কিছু মিনিপ্লেক্স চালুও হয়েছে আর বেশকিছু নতুন হওয়ার কথা রয়েছে। এখন হিন্দি সিনেমা আসবে না, তাই অধিকাংশ লগ্নিকারক পরিকল্পনা স্থগিত করেছেন। তাছাড়া অনেক সিঙ্গেল স্ক্রিনের মালিক হল আধুনিকায়নের যে পরিকল্পনা নিচ্ছিলেন সেগুলোও হয়তো আর হবে না। আগামীতে যেসব দেশীয় ছবি রমজানের আগ পর্যন্ত মুক্তি পাবে বলে শোনা যাচ্ছে, আমি নিশ্চিত একটি ছবিও দর্শক টানতে পারবে না। কারণ এ ছবিগুলো মানসম্মত নয় বিধায় অতটা দর্শক আগ্রহ তৈরি করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। আর দর্শক চাহিদামতো ছবি না পেলে আমি এ অচলাবস্থার উত্তরণের পথ দেখছি না। গত কয়েক বছর ধরে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প মাত্র একজন নায়কের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে। তার ওপরই ভিত্তি করে শুধু বড় বাজেটের ছবি তৈরি হচ্ছে, এক নায়কের ওপর নির্ভর করে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প টিকতে পারে না। কী ছবি তৈরি হবে, কীভাবে তৈরি হবে, দর্শক কী ধরনের ছবি দেখতে চায়, বড় বাজেটের ছবি নির্মাণ করার জন্য নতুন পুঁজি কীভাবে আনা যায়, শিল্পী আনা যায়- এসব বিষয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন। এখন থেকে এসব কাজ শুরু করলে হয়তো অচলাবস্থা থেকে এ শিল্পের উত্তরণ করা যাবে। তবে অনেক সময়ের ব্যাপার আর এই সময় এর মধ্যে সিনেমা হল টিকে থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। হল যদি না থাকে তাহলে সিনেমা তৈরি করে কী হবে? তাই আমি মনে করি বছরে অন্তত ১০টি হিন্দি ছবি আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। চলচ্চিত্রের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা ৫০ বছরের। আমার অভিজ্ঞতা বলে, এভাবে চললে এক বছরের মধ্যে আর কোনো সিনেপ্লেক্স এবং সিনেমা হল খুঁজে পাওয়া যাবে না।
দেশি-বিদেশি পর্যাপ্ত মানসম্মত ছবি চাই
মেসবাহউদ্দিন আহমেদ, হেড অব মিডিয়া, স্টার সিনেপ্লেক্স, ঢাকা
পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্মত ছবি আমরা সারা বছর ধরে পাই না। দেশীয় ছবি এখন হয়ে পড়েছে ঈদকেন্দ্রিক। সিনেপ্লেক্স ও সিনেমা হলের জন্য এটি খুবই দুঃখজনক। কারণ শুধু ঈদের ছবি দিয়ে সারা বছর সিনেমা হল বা সিনেপ্লেক্স কীভাবে চালানো সম্ভব। সিনেপ্লেক্স ও সিনেমা হল বাঁচাতে সারা বছর দেশি-বিদেশি ভালো কন্টেন্ট চাই। আমরা এখন হলিউডের সিনেমা দিয়ে কোনোভাবে সারভাইব করছি। কিন্তু হলিউডের চেয়ে মানসম্মত দেশি ছবি পেলে আশানুরূপ দর্শক মেলে। তাই সিনেপ্লেক্স ও সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে দেশি-বিদেশি মানসম্মত কনটেন্টের বিকল্প নেই। তা না হলে সিনেপ্লেক্স বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। এটি খুবই দুঃখজনক ব্যাপার যে, কমপক্ষে গত প্রায় ৩ মাসে দর্শকমনে সাড়া জাগানোর মতো কোনো ছবিই আমরা পাইনি। একেকটি শোতে ৫/১০ জন দর্শক এলে তা দিয়ে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর এত বড় ব্যয় কীভাবে নির্বাহ করা সম্ভব। আমরা পুরোপুরি লোকসানের কবলে পড়ে গেছি। এভাবে সিনেপ্লেক্স টিকিয়ে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয় একথা বার বার বলতে আমি বাধ্য হচ্ছি। আমি মনে করি আমাদের দেশের সিনেপ্লেক্স ও সিনেমা হল, এক কথায় চলচ্চিত্র শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে দেশি-বিদেশি যে কোনো ভালো মুভি পর্যাপ্ত পরিমাণে আমাদের প্রয়োজন। এখন বিশ্বায়নের যুগ, তাই এ সময়ে কোনো দেশের ছবি আমদানি বন্ধ করা উচিত নয়। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই এক দেশের ছ্িব বর্তমানে অন্য দেশে প্রদর্শিত হচ্ছে। তাই এ বিশ্বায়নের যুগে আমাদের দেশে অন্য কোনো দেশের ছবি আমদানি বন্ধ করে দেওয়া অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি। আর একটা কথা না বললেই নয়, বিদেশি ছবি প্রদর্শনের ফলে সিনেপ্লেক্সের প্রতি দর্শক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এটি ধরে রাখতে হলে বিদেশি ছবির বিকল্প নেই। তবে আগে মানসম্মত পর্যাপ্ত পরিমাণে দেশি ছবি আমরা চাই। ‘হাওয়া’, ‘পরাণ’, ‘গলুই’, ‘প্রিয়তমা’, ‘তুফান’-এর মতো দর্শকপ্রিয় ছবি আমরা নিয়মিত চাই। আর যদি না পাই তাহলে আমাদের স্টার সিনেপ্লেক্সের শাখা দেশব্যাপী বাড়ানোর যে পরিকল্পনা নিয়েছিলাম তা বাধ্য হয়েই বাতিল করতে হবে। কারণ লোকসান গুনে কেউ কোনো ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারে না। আবারও বলছি এ দুরাবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো- দেশি-বিদেশি মানসম্মত পর্যাপ্ত ছবি নিয়মিত আমাদের পেতে হবে।
কনটেন্টের অভাবে সিনেপ্লেক্স টিকিয়ে রাখা যাবে না
ফারুক আহমেদ, পরিচালক, সিলভার স্ক্রিন, চট্টগ্রাম
সিনেপ্লেক্স চালু রাখার মতো মানসম্মত সিনেমার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অনিবার্যভাবে এ শিল্প রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে যাবে। কমপক্ষে গত তিন মাসে দেশীয় যেসব ছবি পেয়েছি সেগুলো দিয়ে সিনেপ্লেলেক্সের ব্যয় নির্বাহ করা কোনভাবেই সহায়ক ছিল না। বেতন, ফ্লোর ভাড়া কোনোভাবেই জোগাড় করা যাচ্ছে না। শুধু ভারতীয় সিনেমাই নয় পাকিস্তানি সিনেমাসহ সারা দুনিয়ার যে কোনো ছবি আমদানির সুযোগ থাকতে হবে। নতুবা এ শিল্প বাঁচানো যাবে না। আমাদের ভালো নির্মাতারা উৎসবকেন্দ্রিক সিনেমা বানান। দুই ঈদের ছবি দিয়ে সারা বছর হল চালানো অসম্ভব। তাই সরকার অনতিবিলম্বে এ শিল্পে প্রণোদনার ব্যবস্থা না করলে পুরো সেক্টর কলাপস করবে।
সিনেপ্লেক্স বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই
ইউনুস রুবেল, কর্ণধার মধুবন সিনেপ্লেক্স, বগুড়া
সিনেপ্লেক্স চালু রাখার মতো মানসম্মত ও পর্যাপ্ত কনটেন্ট কয়েক বছর ধরে পাচ্ছি না। এ অবস্থায় সিনেপ্লেক্স বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। গত চার মাসে কোনো ছবি না থাকায় সিনেপ্লেক্স ও সিনেমা হল বন্ধ ছিল। নভেম্বরে শাকিব খানের ‘দরদ’ ছাড়া কোনো দেশীয় ছবি মুক্তি পায়নি। কিন্তু ছবিটি ব্যবসাসফল হয়নি। ‘স্ত্রী-২’ নামে একটি ভারতীয় হিন্দি ছবি ভারতে মুক্তির অনেক পরে আমাদের দেশে মুক্তি পাওয়ায় সিনেপ্লেক্সগুলো ব্যবসা করতে পারেনি। সারাদেশের সিনেপ্লেক্সসহ সব সিনেমা হল বিশাল দেনায় পড়েছে। এ বিষয়টি আমরা সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। তারপরেও যতদূর জেনেছি, হিন্দি সিনেমা আমদানিতে চলচ্চিত্রের একজন লোক অন্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হয়েও নিজের প্রভাব খাটিয়ে হিন্দি সিনেমা আমদানিতে বাধা দিয়েছে। উনি আমাদের মূল ধারার চলচ্চিত্র মেকার নন। বাংলাদেশের সিনেমা হল থাকল বা না থাকল উনার কিছু যায়-আসে না। আমরা প্রদর্শক সমিতির জরুরি সভার আয়োজন করব। সিনেমা হল ও সিনেপ্লেক্সের দুরবস্থার বিষয়টি সরকারকে বোঝাতে চেষ্টা করব। সরকার যদি ওই উপদেষ্টার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়, তাহলে যে যার মতো হল বন্ধ করে দেব। সিনেপ্লেক্সগুলো কোনোভাবেই টিকতে পারবে না। সিঙ্গেল স্ক্রিনগুলো এক সময়ের অশ্লীল সিনেমাগুলো চালাবে। সিনেপ্লেক্সগুলো বন্ধ হয়ে গেলে আর বিগ বাজেটের ছবি কোনো প্রযোজক বানাবে না। বর্তমানে চলচ্চিত্রের পুঁজি তোলার অন্যতম অবলম্বন সিনেপ্লেক্স। আর সিনেপ্লেক্স না থাকলে এ শিল্পে ধস নামবে।