মানুষের জানমাল ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় জনগণকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড করা হয়েছে। দেশবাসীকে অনুরোধ করব, ক্ষতিটা কার, নিশ্চয়ই জনগণের। এখানে তো জনগণকেই রুখে দাঁড়াতে হবে, এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে, জনগণকেই সোচ্চার হতে হবে।
গতকাল বিকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এডিটরস গিল্ডের নেতৃত্বে সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় সরকারপ্রধান জানান, মানুষের জানমালের রক্ষায় কারফিউ না দেওয়ার বিকল্প ছিল না। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার একটা ধারণা ছিল এ ধরনের একটা আঘাত আসতে পারে। আন্দোলনকারীদের একদিন জাতির কাছে জবাব দিতে হবে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে দাবি তারা করেছিল কোটা সংস্কারে, যতটুকু চেয়েছিল তার থেকে অনেক বেশি দিয়েছি। যখন তাদের দাবি মেনে নেওয়া হলো, তারপরও তারা এই জঙ্গিদের সুযোগ করে দিল কেন? কোটা আন্দোলনকারীদের কিন্তু জাতির কাছে একদিন এই জবাব দিতে হবে। কেন মানুষের এত বড় সর্বনাশ করার সুযোগ করে দিল। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের বিষয়ে সরকারের সহানুভূতিশীল মনোভাবের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সব সময় তাদের সঙ্গে সহানুভূতি দেখিয়েছি। তাদের সব সময় নিরাপদ রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু যে সব ঘটনা ঘটেছে এটা কখনো ক্ষমা করা যায় না।
দেশবাসীকে সব ধরনের সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ, পোশাক তৈরি করা হলো কালো প্যান্ট, সাদা শার্ট; ফলস (ভুয়া) আইডি কার্ড, পেছনে ব্যাগের মধ্যে কী আছে, পাথর আর অস্ত্র ধারালো। মসজিদে অস্ত্র নিয়ে ইমামকে মাইকিং করতে বাধ্য করা, এই যে জঙ্গিবাদের একটা বীভৎস চেহারা আজকে সবার সামনে চলে এলো এটার বিরুদ্ধে জাতিকে, সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি তো চাইনি আমাদের গণতান্ত্রিক ধারায় এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটুক, আমাদের কারফিউ দিতে হোক। একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশে এটা আসুক, তা আমাদের কাম্য ছিল না। কিন্তু আজকে না দিয়ে কোনো উপায় ছিল না। না দিলে আরও যে কত লাশ পড়ত তার হিসাব নেই। তিনি বলেন, সত্যিকথা বলতে কী দীর্ঘ সংগ্রামের পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত ছিল, দেশে উন্নতিও করতে পেরেছিলাম। মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে যে উন্নয়ন করেছি আর কে পেরেছে এর আগে। তিনি বলেন, দেশের সর্বনাশটা করল, যারা আজকে গণমানুষের আর্থসামাজিক উন্নতির জন্য, তাদের আয় বৃদ্ধি, তাদের চলাচলের সুবিধার জন্য, তাদের জীবন মান উন্নত করার জন্য যতগুলো স্থাপনা তৈরি করেছি, সবই তারা আঘাত করেছে, সব তারা ভেঙে দিয়েছে।
বিগত বছরগুলো গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকা এবং স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা জঙ্গিবাদ দমন করে দীর্ঘসময় একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছি। সেই জায়গাটায় আজকে চরম একটা আঘাত দিল। শেখ হাসিনা তার পূর্বানুমানের কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমি জানতাম যে ইলেকশন করতে দিবে না। তারপরও আমরা ইলেকশন করে ফেলেছি। সরকার গঠন করতে পেরেছি। আমার একটা ধারণা ছিল এ ধরনের একটা আঘাত আবার আসবে। কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে অনেক বড় ষড়যন্ত্র ছিল জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, এটা যে একটা বিরাট চক্রান্ত সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। ... এই যে লোক চলে আসা, এবার আমরা কিন্তু আগে থেকে খবর পেয়েছি লোক ঢুকবে। গোয়েন্দা দিয়ে সব হোটেল, কোথায় থাকতে পারে সেগুলো কিন্তু নজরদারিতে আনা হয়েছে। কিন্তু ওরা সেখানে ছিল না; এরা চলে এসেছে ঢাকার ঠিক বাইরের পেরিফেরিতে (সংলগ্ন এলাকায়)।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব বাংলাদেশ থেকে শিবির-জামায়াত এরা কিন্তু এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদলের ক্যাডাররাও কিন্তু সক্রিয় ছিল। যতগুলো ঘটনা ঘটেছে এরাও (বিএনপি) কিন্তু সক্রিয় ছিল। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আরেকটা জিনিস খেয়াল করবেন তখনেি কিন্তু লাশ পড়েনি। কিন্তু স্টেট ডিপার্টমেন্টের (যুক্তরাষ্ট্রের) বক্তব্যে এসে গেল যে লাশ পড়েছে। তো লাশের খবর তাদের কে দিল? তাহলে লাশ ফেলার নির্দেশটা কে দিয়েছে? এটাও খবর নেওয়া দরকার। এবং তারপর কিন্তু লাশ পড়তে শুরু করল।
কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সহিংসতায় মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বাংলাদেশ টেলিভিশন, দুর্যোগ ভবন, সেতু ভবন, বিআরটিএ, ডাটা সেন্টারে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন) এভাবে কেন সুযোগটা সৃষ্টি করে দিল সেই জবাবটাও জাতির কাছে তাদের দিতে হবে। আমরা তো বার বার তাদের সঙ্গে বসলাম। প্রজ্ঞাপন সেটাও করা হলো। তাদের কোনো দাবি পূরণ করা ছাড়া রাখিনি। গণমাধ্যমগুলোকে সঠিক সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে গুজব প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, এটা ঠিক অনেকে গুজবে কান দেয়। কান নিয়ে গেছে চিলে, ওটার পেছে ছোটে, কানে হাত দিয়ে দেখল না কান আছে কি না। মিথ্যাচারের হাত দেখে মানুষকে রক্ষা করেন, মানুষ যাতে সঠিক তথ্য জানতে পারে সেভাবে সংবাদগুলো পরিবেশন করুন।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি এর সুফলও মানুষ পেল, কুফলও মানুষ পেল। আপনাদের কাছে যা তথ্য আছে আপনারা তা ব্যাপকভাবে প্রচার করে জনমত সৃষ্টি করুন। মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান। স্বাগত বক্তব্য দেন এডিটরস গিল্ডসের প্রেসিডেন্ট মোজাম্মেল হক বাবু। এ অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন, সিনিয়র সাংবাদিক আবেদ খান, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন এমপি, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম, বাংলাদেশ জার্নালের সম্পাদক শাহজাহান সরদার, ডিবিসি টেলিভিশনের এডিটর ইন চিফ মঞ্জুরুল ইসলাম, ঢাকা জার্নালের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, নাগরিক টেলিভিশনের হেড অব নিউজ ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব দীপ আজাদ, আমাদের সময়ের নির্বাহী সম্পাদক মাইনুল আলম, ডিবিসি টেলিভিশনের নিউজ এডিটর জায়েদুল আহসান পিন্টু, বাংলা ট্রিবিউনের সম্পাদক জুলফিকার রাসেল, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের হেড অব নিউজ আশিষ সৈকত, একাত্তর টিভির হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদ, অ্যানার্জি অ্যান্ড পাওয়ারের সম্পাদক মোল্লাহ আমজাদ হোসেন, কিংস নিউজের হেড অব নিউজ নাজমুল হক সৈকত এবং আরটিভির হেড অব নিউজ মামুনুর রহমান খান প্রমুখ।