উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরাম সীমান্ত দিয়ে প্রায় প্রতিদিন আসছে পাহাড়ি ঢল। ভাসিয়ে নিচ্ছে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির নিম্নাঞ্চল। এরই মধ্যে প্লাবিত হয়েছে রাঙামাটি পাঁচ উপজেলা। আর খাগড়াছড়িতে পানিবন্দি আছে আট উপজেলা। একই অবস্থা অন্য পার্বত্য জেলা বান্দরবানের ১৮ ইউনিয়নে। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, তিন পার্বত্য জেলা মিলে পানিবন্দি আছে ৩ লাখের বেশি মানুষ। শুধু বসতঘর, ভিটেমাটি নয়, পানিতে তলিয়েছে পাহাড়বাসীর আয়-রোজগারের অন্যতম মাধ্যম নিজেদের ফসলি জমি। বানের পানিতে ভেসে গেছে দোকানপাট, বিদ্যালয়, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ গবাদি পশু-পাখি। সব হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব পাহাড়ের বানভাসিরা। দুর্গমতার কারণে মিলছে না পর্যাপ্ত ত্রাণসহায়তাও। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা রাঙামাটি ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা মিজোরামে টানা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় প্রায় প্রতিদিন নামছে পাহাড়ি ঢল। তাতেই বৃদ্ধি পাচ্ছে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের পানি। পানিতে ভরপুর কাচালং, মাচালং ও চেঙ্গি নদী। তাই হ্রদতীরবর্তী এলাকাগুলো প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িবাসী। ডুবে গেছে বেশ কিছু আশ্রয় কেন্দ্র। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে বানভাসিদের।
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার মানিক মিয়া বলেন, ‘বন্যার কারণে স্থানীয়দের বাড়িঘর ডুবেছে। ডুবেছে আশ্রয় কেন্দ্রও। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই কোথাও। অন্যদিকে মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করা যাচ্ছে না।’ তথ্যমতে সম্প্রতি টানা বৃষ্টি আর সীমান্তের পানিতে খাগড়াছড়ির আট উপজেলার ২৭ ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ৩৩ হাজার ৫২২। ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ১ লাখ ১০ হাজারের বেশি। ৯৯ আশ্রয় কেন্দ্র খোলা থাকলেও মানবেতর দিন কাটছে আশ্রিতদের। এরই মধ্যে আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষ। আশ্রিত গবাদি পশুর সংখ্যা ১ হাজার ৮৩৪। বানভাসিদের সহায়তায় মেডিকেল দল আছে ১৮টি। এ ছাড়া সহায়তায় মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনীও।
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিরিন আক্তার বলেন, ‘উপজেলায় প্রায় ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দির তথ্য আমাদের কাছে আছে। তবে প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। তাই তালিকার হিসাবও বাড়তে পারে। সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে খোলা থাকলেও মানবেতর জীবন যাপন করছে অনেকে।’
খাগড়াছড়ির চেঙ্গি নদীর পানি কমে যাওয়ায় লোকজন বাড়িঘরে যাওয়া শুরু করেছে। দীঘিনালায় মাইন নদের পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। পৌর শহরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত আশ্রয় কেন্দ্রে যেসব পরিবার ছিল তারা এখন নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে গিয়ে ঘর পরিষ্কার কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। পলিমাটিতে ঘর কাদায় একাকার হয়ে গেছে। ফলে চরম দুর্ভোগের মধ্যে তাদের কাজ করতে হচ্ছে। আকস্মিক বন্যায় এখানে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষক মাঠে গিয়ে দেখে তাদের ফসল আর নেই। পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। পৌর শহরের অধিকাংশ এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ নেই। জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করছেন কর্মীরা। দফায় দফায় এখানে চারবারের বন্যায় বহু পরিবার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের বাড়িঘর স্রোত নিয়ে গেছে। সেনাবাহিনী, জেলা প্রশাসন, পৌর প্রশাসন ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে শুকনো ও রান্না করা খাবার বিতরণ করেছে। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান বলেন, ‘এ জ্বালার পাঁচ উপজেলা বন্যায় হয়েছে। আমরা এখনো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারিনি। পানি কমে গেলে নির্ধারণ করব।’ তিনি আরও জানান, পুরো জেলায় ৪০০ মেট্রিক টন ও খাগড়াছড়ি পৌরসভার জন্য ১২ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য প্রদান করা হয়েছে। সেনাবাহিনী দীঘিনালায় ও খাগড়াছড়িতে বিভিন্ন বাড়িঘরে গিয়ে পানিবন্দিদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা চালায়। বিজিবি রামগড়ে উদ্ধারকাজ চালিয়েছে। পানি কমে গেলেও এখানকার সড়কগুলো বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।