৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, মন্ত্রী ও এমপিরা আত্মগোপনে চলে যান। এর মধ্যে অনেকেই অবৈধভাবে সীমান্ত পথে পাড়ি জমিয়েছেন ভারতে। কেউ অবস্থান করছেন কলকতা, কেউ নয়াদিল্লি, কেউ শিলংয়ে। আবার কেউ পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে, কানাডা, সিঙ্গাপুর, বেলজিয়াম। একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, এর মধ্যে এক ডজন শীর্ষ নেতা বর্তমানে কলকাতায় অবস্থান করছেন। এর মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে মন্ত্রী, এমপি এবং সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারাও রয়েছেন।
জানা গেছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ভারতে অবস্থান করছেন। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরায় দেখা মিলেছে আসাদুজ্জামান খানসহ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকে। তাঁরা কলকাতার ইকো পার্কে প্রকাশ্যেই ঘুরছেন-এমন চিত্র দেখা গেছে টেলিভিশন চ্যানেলে। আসাদুজ্জামান খান ছাড়াও সেখানে সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, তাঁর স্ত্রী যুব মহিলা লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও এমপি অপু উকিল ও হাজি সেলিমের ছেলে সাবেক এমপি ইরফান সেলিমকে দেখা গেছে।
গণমাধ্যমে ভিডিওটি প্রচারের পর থেকেই এ নিয়ে দেশজুড়ে চলছে আলোচনা। যার নির্দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নজিরবিহীন দমনপীড়ন চালানো হয়েছে, সেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কীভাবে দেশ ছেড়ে পালালেন, এ বিষয়ে গতকাল বক্তব্য দিয়েছেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক (মুখপাত্র) লে. কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস। তিনি বলেন, ‘সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারতে অবস্থানের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আপনারা টিভিতে দেখে যা জানেন, আমিও সেভাবেই জানি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে এ রকম কোনো তথ্য নেই। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বৈধভাবে গেছেন নাকি অবৈধভাবে সে সম্পর্কে র্যাবের কাছে কোনো তথ্য নেই। এখানে র্যাবের কোনো ধরনের উদাসীনতা বা গাফিলতির বিষয় নেই। আমাদের যে দায়িত্ব ও কর্মপরিধি সে অনুযায়ী সর্বোচ্চ কাজ করে যাচ্ছি।’
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, যেসব নেতা দেশ ছেড়েছেন তার অধিকাংশই কলকতায় অবস্থান করছেন। তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আবদুর রহমান, দলের প্রভাবশালী নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণালকান্তি দাস, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ও কার্যনির্বাহী সদস্য নির্মল কুমার চ্যাটার্জি, সাবেক এমপি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। এ ছাড়া কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও তাঁর মেয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তাহসিন বাহার এবং ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীও ভারতে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি মার্কেটে ঘুরতে দেখা গেছে নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমানকে।
এ ছাড়া ভারত হয়ে যুক্তরাজ্যে গেছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের অপসারিত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। সিলেট-৩ আসনের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব, সাবেক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সুনামগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রণজিৎ সরকার, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিধান কুমার সাহা।
৫ আগস্টের পর দেশ ত্যাগ করে বেলজিয়ামে গেছেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ কানাডায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আরও বেশ কয়েকজন নেতার দেশ ছাড়ার গুঞ্জন রয়েছে। তবে তাঁদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ৩ আগস্ট রাতে পরিবারসহ দেশ ছাড়েন। তিনি ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুর যান। তাঁর পরিবার পৃথক ফ্লাইটে যায় লন্ডনে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও আন্দোলনের সময় সপরিবার সিঙ্গাপুরে চলে যান। সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি। এ ছাড়া দেশত্যাগী নেতাদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ, যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মাইনুল হোসেন নিখিল, ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান। তাঁরা কোথায় অবস্থান করছেন সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, কেন্দ্রীয় নেতা, এমপি, মন্ত্রী ছাড়াও অধিকাংশ ব্যক্তি দেশ ছাড়ার জন্য ভারত সীমান্ত বেছে নিয়েছেন। সেখান থেকে নানা গন্তব্যে চলে যাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের পারাপারের কাজে বিভিন্ন সীমান্তে গড়ে উঠেছে একাধিক চক্র। এ চক্রের সদস্যরা প্রভাবশালীদের পার করে দিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এ চক্রের হাতেই ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না নিহত হয়েছেন ভারতের সীমান্তে। এ ছাড়া সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক বেশ কজন সংসদ সদস্য ও জেলা পর্যায়ের নেতা, সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত সহকারীসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্তরা।