আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন : নিশ্চয় যারা আল্লাহর নামে কৃত অঙ্গীকার এবং নিজেদের প্রতিজ্ঞা সামান্য মূল্যে বিক্রি করে, পরলোকে তাদের কিছুই প্রাপ্য থাকবে না, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাবেন না এবং তাদের পরিশুদ্ধও করবেন না। বস্তুত তাদের জন্য তো রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি (সুরা আলে ইমরান-৭৭)।
এই আয়াতের শানে নজুল প্রসঙ্গে ইমাম ওয়াহেদী (রা.) বলেন : একবার একখন্ড জমির অধিকার নিয়ে দুই লোকের মধ্য বিরোধ দেখা দিলে মীমাংসার জন্য তারা রসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে হাজির হন। বিবাদী যখন স্বীয় দাবির স্বপক্ষে শপথ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে, এমনি সময় আল্লাহ পাক আয়াতটি নাজিল করেন। ফলে তাকে শপথ থেকে বিরত রাখা হয় এবং জমির ওপর বাদীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন : যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে অপরের সম্পদ হস্তগত করার জন্য অসত্য কসম করে, আল্লাহর সাক্ষাতে সে আল্লাহকে রাগান্বিত অবস্থায় দেখবে (বোখারি, মুসলিম, আবু দাউদ ও তিরমিজি)।
হজরত আশআস (রা.) বলেন : উল্লিখিত আয়াত আমার সম্পর্কেই অবতীর্ণ হয়েছিল। একখন্ড জমি নিয়ে জনৈক ইহুদি ও আমার মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। আমি তাকে নিয়ে রসুল (সা.)-এর কাছে বিচার প্রার্থী হলে তিনি আমাকে বললেন : তোমার দাবির স্বপক্ষে সাক্ষী প্রমাণ আছে কি?’ আমি বললাম : না, ইয়া রসুলুল্লাহ!
তখন তিনি ইহুদিকে বললেন : তুমি কসম করে বল, উক্ত জমি তোমার। আমি আরজ করলাম : ইয়া রসুলুল্লাহ! কসম করার সুযোগ পেলে সে তো মিথ্যা কসম করে আমার জমি নিয়ে যাবে। এ সময় আল্লাহপাক আয়াত অবতীর্ণ করেন।
আয়াতে যে সামান্য মূল্যের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে, পার্থিব ক্ষুদ্রস্বার্থ, যার জন্য মানুষ অহরহ অসত্য শপথ করে থাকে। ‘তাদের কোনো প্রাপ্য নেই’ অর্থাৎ পরকালে তারা কিছুই পাবে না। ‘আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না’ এর মর্ম হচ্ছে- সুখকর কোনো কথা বলবেন না। আর ‘তাদের দিকে তাকাবেন না’ এর অর্থ হলো- করুণার দৃষ্টি ফেলবেন না। আর তাদের পরিশুদ্ধও করবেন না এর মর্মার্থ হচ্ছে- আল্লাহ তাদের পাপ মার্জনা করবেন না এবং তাদের জন্য মঙ্গলজনক কিছু করবেন না। (কারণ বান্দার অধিকার খর্ব করলে আল্লাহ মার্জনা করেন না)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন : আমি শুনেছি রসুল (সা.) বলেছেন : যে লোক নিজের নয় জেনেও কারও সম্পদ আত্মসাতের জন্য কসম করে, কেয়ামতের দিন সে আল্লাহকে তার ওপর রাগান্বিত অবস্থায় দেখতে পাবে। অতঃপর রসুলুল্লাহ (সা.) পবিত্র কোরআনের আয়াতটি পাঠ করলেন, নিশ্চয় যারা আল্লাহর নামে কৃত অঙ্গীকার এবং নিজেদের প্রতিজ্ঞা সামান্য মূল্যে বিক্রি করে... (বোখারি ও মুসলিম)।
হজরত আবু উমামা (রা.) বলেন : আমরা রসুল (সা.)-এর দরবারে বসা ছিলাম। তিনি বললেন : যে লোক নিজের শপথ দ্বারা কোনো মুসলমানকে বৈধ অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত এবং জান্নাত হারাম করে দেন। এক ব্যক্তি আরজ করল, ইয়া রসুলুল্লাহু! তা যদি খুবই সামান্য বিষয় হয়? তিনি বলেন, যদি একটা গাছের কাটা ডালও হয় তবুও। (মুসলিম, নাসায়ি)।
হাফসা বিন মায়সারা বলেন : এ হাদিসটি কতটা শক্ত (নির্ভরযোগ্য)?’ আবুজর (রা.) বললেন : আল্লাহর কিতাবে কি উল্লেখ হয়নি? নিশ্চয় যারা আল্লাহর নামে কৃত অঙ্গীকার এবং নিজেদের প্রতিজ্ঞা সামান্য মূল্যে বিক্রি করে...। হজরত আবুজর (রা.) বর্ণনা করেন : নবী পাক (সা.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন তিনজনের সঙ্গে আল্লাহপাক কথা বলবেন না। তাদের পবিত্র (পাপমুক্ত) করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। এ কথা তিনি তিনবার বললেন।
হজরত আবুজর (রা.) বললেন : ইয়া রসুলুল্লাহ! সেই চরম ক্ষতিগ্রস্ত ও ভাগ্যাহত লোকগুলো কারা? রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন : যে লোক পায়ের গিরার নিচে কাপড় পরে, যে দান বা অনুগ্রহ করে পরে খোটা দিয়ে লজ্জা দেয় এবং যে অসত্য শপথ করে পণ্য দ্রব্য বিক্রি করে (মুসলিম, তিরমিজি ও আবু দাউদ)।
রসুল (সা.) আরও বলেন : কবিরা গুনাহ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার স্থির করা, মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া, আত্মহত্যা করা এবং অসত্য কসম খাওয়া (সহিহ বোখারি)।
অসত্য শপথের মাধ্যমে মিথ্যা অনুমোদন করাকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘ইয়ামিনে গামুস’ অর্থাৎ নিমজ্জিতকারী কসম বলা হয়। কারণ (মিথ্যা কসম) কসমকারীকে পাপকার্যে কারও মতে পরিণামে জাহান্নামে নিমজ্জিত করে ফেলে বিধায় নামকরণ করা হয়েছে।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ