মানুষের জীবনে প্রতিকূলতা শব্দটি বারবার আসে। সেটি অতিক্রম করতে শত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। তেমনই এক অনবদ্য চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন ভারতের স্কুল শিক্ষক এ টি আবদুল মালিক। শিক্ষাদানের গুরুদায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে তাকে নদী সাঁতরাতে হতো। ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছাতে ১৯ বছর ধরে প্রতিদিন নদী সাঁতরে স্কুলে ছোটেন তিনি।
প্রথমটি হচ্ছে বাড়ি থেকে বের হয়ে দুবার বাস বদল করতে হবে, এরপর আবার দুই কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে যেতে হবে। আর এতে সময় লাগবে অন্তত তিন ঘণ্টা। দ্বিতীয় রাস্তাটি হচ্ছে বাড়ি থেকে হেঁটে স্থানীয় কাদালুন্দিপুঝা নদীর তীরে যেতে হয়। আর এতে সময় লাগে ১০ মিনিট। এরপর এই নদী সাঁতরে তীরে উঠে হাঁটতে হয় অন্তত তিন মিনিট। এরপর পৌঁছে যান তার প্রিয় শিক্ষার্থীদের কাছে
তার নাম এ টি আবদুল মালিক। পেশায় শিক্ষক। শিক্ষকতাকে মহান পেশা বলা হয়। আদতেও তাই। সাধারণ মানুষের কাছে শিক্ষকের আলাদা এক মর্যাদা আছে। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। তার হাতেই তৈরি হয় আগামী দিনের মানুষ। শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষক এক আদর্শের নাম। সেই আদর্শ শিক্ষকেরই প্রতিচ্ছবি এ টি আবদুল মালিক। ভারতের এই শিক্ষক এখন সোস্যাল মিডিয়া তো বটেই আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নজর কেড়ে নিয়েছেন। কারণ আর কিছুই নয়। দায়িত্বশীলতার চরম এক উদাহরণ হয়ে উঠেছেন তিনি। ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছাতে ১৯ বছর ধরে প্রতিদিন নদী সাঁতরে পার হন তিনি। স্কুলের শিক্ষক হাজিরা খাতায় নেই এ মহান শিক্ষকের একদিনের অনুপস্থিতি। অবিশ্বাস্য শোনালেও এটাই সত্যি।
১৯৯২ সাল থেকে কেরালার মুসলিম লোয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন তিনি। বাড়ি থেকে তার স্কুলে যাওয়ার রাস্তা রয়েছে দুটি।
প্রথমটি হচ্ছে বাড়ি থেকে বের হয়ে দুবার বাস বদল করতে হবে, এরপর আবার দুই কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে যেতে হবে। আর এতে সময় লাগবে অন্তত তিন ঘণ্টা। দ্বিতীয় রাস্তাটি হচ্ছে বাড়ি থেকে হেঁটে স্থানীয় কাদালুন্দিপুঝা নদীর তীরে যেতে হয়। আর এতে সময় লাগে ১০ মিনিট। এরপর এই নদী সাঁতরে তীরে উঠে হাঁটতে হয় অন্তত তিন মিনিট। এরপর পৌঁছে যান তার প্রিয় শিক্ষার্থীদের কাছে।
এ টি আবদুল মালিক বিভিন্ন সংবাদ মাধমে জানান, প্রতিদিন নদী সাঁতরে স্কুলে যেতে তার সময় ও অর্থ দুটিই সাশ্রয় হয়। এ ছাড়া গাড়িতে যেতে হলে অনেকদিন নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলে পৌঁছানো যায় না। নদীর তীরে পৌঁছে তিনি তার পোশাক এবং অন্যান্য জিনিসপত্র প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে ফেলেন। চোখে পানিরোধক চশমা পরে প্লাস্টিকের সেই ব্যাগ এক হাতে পানির ওপরে ধরে পাড়ি দেন নদী। স্থানীয়দের কাছে এই শিক্ষক পরিচিতি পেয়েছেন জীবন্ত ঘড়ি হিসেবে। তিনি যখন প্রতিদিন পানিতে নামেন তখন ঘড়ির কাঁটা থাকে ঠিক ৯টায়। এরপর নদীর তীরে ওঠে কাপড় পরে পৌঁছান স্কুলে।
এর আগে ৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা তাকে সম্মাননা জানান। যুক্তরাজ্যের একজন মানসিক চিকিৎসক এই শিক্ষকের মহান এই ত্যাগের জন্য একটি নৌকা উপহার দেন। কিন্তু এর আগেই কেটে গেছে ১৯ বছর। ভাবতেও অবাক লাগে তিনি বই-পুস্তক থেকেই শিক্ষা দেননি নিজের কর্ম থেকেও শিক্ষা দিয়েছেন। আর শুধু ছাত্রছাত্রীকে নয়, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে। ভারতের কেরালার মুসলিম লোয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি স্থানীয়দের কাছে বেশ পরিচিত এক মুখ। তা তো হবেনই। নদী সাঁতরে ১৯ বছর ক্লাস নেওয়ার বিরল দৃষ্টান্ত গড়া একমাত্র শিক্ষক তিনি। তার আরেকটি রেকর্ড হলো, এই সুদীর্ঘ সময়ে স্কুলে কোনো অনুপস্থিতি নেই তার। এ ছাড়া ঠিক সময়েই প্রতিদিন তিনি স্কুলে পৌঁছছেন।
ভারতের কেরালা রাজ্যের এ শিক্ষকের নাম এখন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।
কিন্তু কেন সাঁতারের পথই বেছে নিলেন। তিনি নিজেই স্পষ্ট করেছেন সেটি।
‘আসলে এমন বিদঘুটে পথ ছেড়ে স্কুলে যাওয়ার শটকার্ট পথটিই পছন্দসই। এতে বাড়ি থেকে ১০ মিনিটে নদীর পার হওয়া। এরপর নদী সাঁতরে তীরে উঠে হাঁটতে হয় মিনিট তিনেক। পৌঁছে যেতেন স্কুলে। আর এ পথটিই হয়ে ওঠে স্কুলে আসা-যাওয়ার একমাত্র পথ।’
সাঁতরে নদী পার হওয়ার পর নদীর তীরে উঠে কাপড় পরে পৌঁছান স্কুলে। সেখানে হাসিমুখে অপেক্ষায় থাকে তার শিক্ষার্থীরা। মাসিক বেতন যা পান তাতেই খুশি এই শিক্ষক।
আবদুল মালিক মনে করেন, পরিবেশ ও নদীরক্ষায় তার এই কাজ অনেককেই উৎসাহ জোগাবে। এ ছাড়া তিনি মাঝে মাঝেই শিক্ষার্থীদের নিয়েও সাঁতার কাটতে বের হন। এর মাধ্যমে নিজেকেও ফিট রাখা যায় বলেও জানান এই শিক্ষক।
তার এই কর্মের স্বীকৃতিও পাচ্ছেন দেশের বাইরে থেকেও। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি নদী সাঁতরেই ইংলিশ চ্যানেলের সমপরিমাণ (৭০০ কিলোমিটার) দূরত্ব অতিক্রম করেছেন।
বিবিসিতে তার ছবিসহ খবর প্রকাশের পর তাকে নিয়ে হইচই পড়ে যায়। আবদুল মালিক স্কুলে গণিত পড়ান। তিনি গণমাধ্যমে বলেন, আমার গণিত সব সময়ই ভালো লাগে। আবদুল মালিক খুব দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। শিক্ষকতায় খুব ভালো আয় না হলেও মানুষ গড়ার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি খুব দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছি। আমার বাবা খুব অল্প বয়সেই মারা যান। তখন আমার পরিবারের খুব দুর্দশা চলছিল। আমরা আটজনের পরিবার। এই আটজন সদস্যের জন্য খাবার জোগাড় করাই কষ্টসাধ্য ছিল। আমার চাচা আমাদের সাহায্য করেন। তিনি স্থানীয় এক মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব পালন করতেন। আমাকে খুব অল্প বয়সেই কাজের সন্ধানে নামতে হয়। আমার চাচার পরামর্শেই আমি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেই। এখনো আমি তাই করছি।’