ভয়ংকর অ্যামাজন
বিচিত্র অ্যামাজনে রয়েছে বিচিত্র প্রাণীও। অভিযাত্রীদের মধ্যে যারা বেঁচে ফিরেছেন, তারা বলেছেন, এ জঙ্গলে আছে বিষাক্ত পানি। আছে মানুষখেকো সাপ। ফুটন্ত নদী, যার পানি নিচ থেকে টগবগিয়ে ফুটছে। অ্যামাজন বনে সত্যিই রয়েছে ফুটন্ত নদী। এ রহস্যময় নদীর পানির তাপমাত্রা ৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর পানি এত গরম যে তাতে মানুষ মারা যেতে পারে। অ্যামাজনের অ্যানাকোন্ডা নিয়েও নানা রকমের কল্পকাহিনি রয়েছে। বাস্তবে এরা মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আকারের এই সাপ অ্যামাজনের আতঙ্ক বলেই জানেন সাধারণ মানুষ। অ্যামাজনের গ্রিন অ্যানাকোন্ডার ওজন প্রায় ১৫০ থেকে ২২৭ কেজি। লম্বায় ২৭ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। দৈত্যাকার প্রাণীটি রাতে শিকারে বের হয়। তবে সাপটির তেমন বিষ নেই। এ ছাড়া অ্যামাজনে আছে ব্ল্যাক কেইম্যান কুমির। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কুমির এটি। দৈর্ঘ্যে ৯ থেকে ১৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। ওজন প্রায় ৪০০ কেজি। অ্যামাজনের নদীতে রয়েছে গোলাপি ডলফিন। সাড়ে ৮ থেকে সাড়ে ৯ ফুট লম্বা গোলাপি ডলফিন। এদের মস্তিষ্কের আয়তন মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে বেশি। অ্যামাজনে রয়েছে পিরানহা। ছোটখাটো হলেও মাংসাশি পিরানহা খুবই হিংস্র।
অ্যামাজনের জঙ্গলে গাছের প্রজাতির সংখ্যার তালিকা তৈরি করতে ৩০০ বছর লেগে যাবে। এরই মধ্যে জাদুঘরে রাখা ৫ লাখের বেশি উদ্ভিদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত গাছের প্রায় ১২ হাজার প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আরও প্রায় ৪ হাজার বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের দেখা মিলতে পারে পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত অ্যামাজনে। অ্যামাজনে আছে মাংসখেকো গাছ। এ গাছের আঠায় প্রজাপতি, ফড়িংয়ের মতো ছোট প্রাণীরা আটকে যায়। তখন গাছের পাতা ঢেকে গিলে নিতে শুরু করে। অ্যামাজনে শুধু ভয়ংকর প্রাণী আর গাছের দেখাই মিলবে না, মিলবে চোখ ধাঁধানো ফুল এবং ফুলগাছেরও। তেমনি একটি গাছ ‘লবস্টার ক্ল ফ্লাওয়ার’। এ ফুলটি লম্বায় দেড় থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। একেকটি পাতা ৬ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত প্রসারিত হয়। এ ছাড়া অ্যামাজনে ৩ হাজারের বেশি প্রজাতির অর্কিড রয়েছে। আছে রাবার গাছ। অ্যামাজন জঙ্গলের রাবার গাছগুলো একেকটা ১০ তলা দালানের সমান উঁচু হয়ে থাকে।
গভীর অ্যামাজনের বাসিন্দা এরা। কখনো আধুনিক সভ্যতার দেখা পাননি। বিমান থেকে ছবি তোলার সময় বর্শা, তির উঁচিয়ে বিমানকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেন তারা
তারা জানে না এ বনের বাইরে আছে আরেক দুনিয়া
অ্যামাজনের অধিবাসীরা আধুনিক সভ্যতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। কেউ কেউ তো বলেন, অ্যামাজনের গহিনে মানুষখেকো মানুষের বসবাস রয়েছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি থাকলেও এটা সত্যি, মানুষের অজানা অনেক নৃগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে অ্যামাজনে। অ্যামাজনের বলিভিয়া অঞ্চলে পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্থ হার্টের মানুষ বসবাস করেন। ধারণা করা হয়, অ্যামাজনে প্রায় ৪০০-এর বেশি আদিবাসী গোত্রে ভাগ হয়ে অন্তত ২ লাখ মানুষের বসবাস। এদের সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায়নি। কিছু নৃগোষ্ঠী যাযাবর প্রকৃতির। মোট ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। তারা বেশির ভাগ ব্রাজিলীয়। এ ছাড়া পর্তুগিজ, স্প্যানিশ ইত্যাদি ভাষায়ও কথা বলেন এসব আদিবাসী। এ ছাড়াও এদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। অনেকের পরনে এখনো কোনো কাপড় নেই। আলোচিত হয়েছে ব্রাজিলের অ্যামাজন জঙ্গলে সন্ধান পাওয়া এক আদিবাসী গোত্রের। ব্রাজিল সরকারের ধারণা, দেশটির অ্যাকরি রাজ্যের দুর্গম গভীর অরণ্যে বাস করা এই মানবগোষ্ঠীর লোকসংখ্যা প্রায় ২০০। ব্রাজিল সরকার তাদের দিকে সুনজর না দিলেও ছোট্ট গোষ্ঠীটি সভ্য মানুষের অরণ্য ধ্বংস, মাইনিং, গবাদি পশু পালন, মাছ ধরা, অবৈধ শিকারসহ স্বেচ্ছাচারিতার বলি হয় কি না সেদিকেও খেয়াল রাখছে। তারা অ্যামাজন অরণ্যের পেরুর সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় বসবাস করেন। গোত্রটির নাম ‘আনকন্টাকটেড’। তারা জঙ্গলে বিভিন্ন পশুপাখি শিকার করে জীবন কাটান। আধুনিক সভ্যতা কিংবা অ্যামাজন জঙ্গলে তাদের এলাকার বাইরের রাজ্য সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। ব্রাজিলের আক্রে রাজ্যের জিনানে নদীর অববাহিকায় বিমানে একদল ফটোগ্রাফার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় তাদের দেখতে পান এবং ছবি তোলেন। এসব ছবিতে দেখা যায় আদিবাসীরা বিমান দেখে ঘাবড়ে গেছেন এবং সবাই একসঙ্গে বর্শা উঁচিয়ে বিমানকে ভয় দেখাচ্ছেন। এমন আদিবাসী গোত্রের কথা প্রায়ই জানা যায়। সত্যি বলতে, অ্যামাজনের আদিবাসীদের উৎপাত করতে চান না কেউ। তারা নিজেদের মতোই বনে বসবাস করছেন যুগের পর যুগ।
৯ দেশজুড়ে দুর্গম এক বন
এখানকার আর্দ্রতা থাকে ৭৭ থেকে ৮৮ শতাংশ। যে কারণে অল্পতেই হাঁপিয়ে যান বনে প্রবেশকারীরা। অ্যামাজনকে রেইন ফরেস্ট বলা হয় এখানকার আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত (বর্ষা মৌসুমে) এবং গরম আবহাওয়ার কারণে
পৃথিবীর মানচিত্রে সবুজে ঘেরা সবচেয়ে বড় অংশটি অ্যামাজনের। যা প্রায় ৯টি দেশজুড়ে বিস্তৃত। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের উত্তর ভাগে ছড়িয়ে আছে জঙ্গলটি। বনের প্রায় ৬০ শতাংশই আবার ব্রাজিলের অধীনে। ব্রাজিল ছাড়াও পেরু, কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলা, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফ্রেঞ্চ গায়ানা অ্যামাজন বিস্ময়ে ডুবে রয়েছে। ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত এ বনের অনেক স্থানেই এখনো মানুষের পা পড়েনি। দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় ৪০ শতাংশই হলো এ দুর্গম অ্যামাজন জঙ্গল। পৃথিবীজুড়ে রেইন ফরেস্টের যত আয়তন, তার অর্ধেকটাই এ অ্যামাজন। বিস্ময়কর এ বনের আয়তন যেমন বিশাল তেমনি বিশাল এ বনের প্রাণী ও উদ্ভিদ-বৈচিত্র্য। রেইন ফরেস্ট অ্যামাজনে মাত্র দুটি ঋতু রয়েছে। গ্রীষ্ম ও বর্ষা। গরমপ্রধান এ বনে ছয় মাস গ্রীষ্ম ও বর্ষা থাকে। এ বনে গুমোট গরম আবহাওয়া কখনোই সরে যায় না। প্রায় সব সময় ৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা থাকায় এ বনে পথচলা খুবই কষ্টের। এ ছাড়া এখানকার আর্দ্রতা থাকে ৭৭ থেকে ৮৮ শতাংশ। যে কারণে অল্পতেই হাঁপিয়ে যান বনে প্রবেশকারীরা। অ্যামাজনকে রেইন ফরেস্ট বলা হয় এখানকার আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত (বর্ষা মৌসুমে) এবং গরম আবহাওয়ার কারণে।