শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অমলিন রোকেয়া : মলিন জন্মভিটা

তুহিন ওয়াদুদ

অমলিন রোকেয়া : মলিন জন্মভিটা

মলিন পড়ে আছে বেগম রোকেয়ার জন্মভিটা ও স্মৃতিকেন্দ্র

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন একাধারে প্রাবন্ধিক-কবি-দার্শনিক-ঔপন্যাসিক। তার বহুমুখী পরিচয়ের আন্তঃসম্পর্ক তার প্রগতিবাদী চেতনা। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান নারী মুক্তির পথরেখা সৃষ্টিতে তার ঐতিহাসিক অবদানের কাছে সময় ঋণী। তিনি কুসংস্কারের আবরণ তুলে শিক্ষাকে আভরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। অন্ধ শাস্ত্রানুগত্যের বিরুদ্ধেও তার প্রতিবাদী লেখনী ছিল সক্রিয়। চরম রক্ষণশীল ব্যবস্থায় তিনি ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন পরম প্রগতিশীলতার। প্রচলিত তন্ত্রের বিরোধিতা করে, মানবতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকেই তিনি নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। মুসলমান পুরুষেরাই যখন ছিল অন্ধের নিগড়ে বন্দী, তখন বাংলার মুসলমান নারীরা ছিল দুই স্তর পাঁচিলের ভিতর। অবরুদ্ধ সমাজের অভ্যন্তরে থাকা অবরোধবাসিনীদের নিয়েই তার প্রধান প্রচেষ্টা, সমাজ পরিবর্তনের মুখ্য নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। শুধু জাতীয় পরিপ্রেক্ষিত মূল্যায়নে তিনি বিশেষ নন, বরং বিশ্ববীক্ষা বিশ্লেষণেও তিনি সবিশেষ। অথচ এই অনন্য সমাজসংস্কারকের জন্মভিটা, তার স্মৃতিকেন্দ্র রয়েছে অযত্নে। 

রোকেয়া সাখাওয়াত ১৮৮০ সালে ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার বসতবাড়ির স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রথমবারের মতো উদ্যোগ গ্রহণ করে ‘নারী কল্যাণ সংস্থা’। সেটাও তার মৃত্যুর প্রায় ৩৫ বছর পর এবং বর্তমান সময়ের চেয়েও অর্ধশত বছর আগে। নারী মুক্তির আর এক পথিকৃত্ কবি সুফিয়া কামাল তখন ছিলেন নারী কল্যাণ সংস্থার সভাপতি। তার উদ্যোগে ১৯৬৭ সালে নারী কল্যাণ সংস্থা ৪ জানুয়ারি বসতভিটা সংলগ্ন ৩৩ শতক জমি ক্রয় করে। একই দিনে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বৈমাত্রেয় ভাই মশিউজ্জামান সাবের চৌধুরী ৩০ শতক জমি দান করেন ‘নারী কল্যাণ সংস্থার’ নামে। দানপত্রে তিনি উল্লেখ করেন ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতিসৌধের পাঠাগার নির্মাণের জন্য নিম্নবর্ণিত সম্পত্তি আমি আল্লাহর ওয়াস্তে এই দানপত্রের দ্বারা দান করিলাম।’ ১৯৭৪ সালের দিকে আরও ৪২ শতক জমি দান করেন। স্থানীয় নূরজাহান নামের আর একজন আট শতক জমি দান করেন। সুফিয়া কামাল চেয়েছিলেন জন্মভিটা-সংলগ্ন একটি ডাকবাংলো স্থাপন করা। যাতে দর্শনার্থীরা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বাড়ি দেখতে এসে, প্রয়োজনে রাত যাপন করতে পারেন। সে সময়ে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বাড়িটি ভগ্ন অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই যেন পরবর্তী প্রজন্মের নারী হিসেবে সুফিয়া কামালের মতো বিদগ্ধজনরা এগিয়ে এসেছিলেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পাকিস্তান সরকারের কাছে এই আশা করা বাতুলতা মাত্র। রোকেয়া সাখাওয়াতের দর্শন ছিল আধুনিক এবং বিজ্ঞানমনস্ক। সেখানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দর্শন ছিল অতীতমুখী-যুক্তিবিমুখ। ১৯৬৭ সালের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল হতে থাকে। দেশের শান্তিকামী অধিকার সচেতন মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আরও সংগঠিত হতে থাকে। আসে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। সেই পথ ধরে নির্বাচন। সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে দেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। পরিণতিতে ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে লাল-সবুজের পতাকার এক নতুন ভৌগোলিক সীমানা লাভ করে বাংলাদেশ। ফলে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও এই কালখণ্ডে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছরই ১৯৭২ সালের ১৮ জুন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মভিটায় রোকেয়ার একটি স্মৃতিস্মারক স্থাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় পল্লী ও সমবায় মন্ত্রী মতিউর রহমানের স্ত্রী আনু রহমান সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে ‘নারী কল্যাণ সংস্থার’ সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আয়শা জাফর। এ বছরই স্থাপিত হয় ডাকবাংলোর কাজ। তার মেয়ে ওয়াজেদা জাফর এই একতলা ভবনটির স্থপতি ছিলেন।

 

 

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বসতবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাষ্ট্রীয় চেষ্টা ছিল খুবই ক্ষীণ। ‘নারী কল্যাণ সংস্থার’ চেষ্টার পর সরকারিভাবে বড় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ১৯৯৭ সালে। তবে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম-মৃত্যু দিবস ৯ ডিসেম্বর ঘটা করে পায়রাবন্দে উদযাপন শুরু হয় ১৯৯৪ সাল থেকে। ১৯৮৮ সালের দিকে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বসতভিটার ঘরটিও ভেঙে পড়ে। বর্তমানে মূল বাড়িটির খানিকটা দেয়াল এবং ইটের খুঁটির ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট রয়েছে। সেই ভিটায় রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা রফিকুল ইসলাম কিছু বৃক্ষরোপণ করেছেন। সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস, রাজনীতিবিদ মতিয়া চৌধুরীও বৃক্ষরোপণ করেছেন।

১৯৯৭ সালে রংপুর জেলা পরিষদের উদ্যোগে সেখানে একটি দ্বিতল কুটিরশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। ২০০১ সালে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। সেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ২৫টি সেলাই মেশিন এখনো পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।

১৯৯৭ সালে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রাবন্দে আসেন এবং ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। সেই প্রকল্পের আওতায় সেখানে জাদুঘর, গ্রন্থাগার, একটি সেমিনার কক্ষ, একটি মিলনায়তন, একটি প্রকল্প প্রধানের বাংলো, কর্মচারীদের জন্য দুটি কোয়ার্টার, একটি গেস্ট হাউস এবং একটি নামাজ ঘর স্থাপন করা হয়। এখানে বিভিন্ন প্রকাশনা ও ফেলোশিপ প্রদানের ব্যবস্থা রাখারও কথা ছিল। সেটি আর হয়ে ওঠেনি। প্রকল্পে ১৪ জন জনবল নিয়োগ দেওয়া ছিল। ২০০৪ সালে প্রকল্পটি বাংলা একাডেমির কাছে ন্যস্ত করা হয়। ২০০৬ সাল পর্যন্ত চলে প্রকল্প। এরপর ক্ষমতায় আসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। প্রকল্পটি পরিচালিত হয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে, বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার  বিকেএমই-এর মাধ্যমে পোশাক শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করে। ২০০৮ সালে রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে ন্যস্ত করা হয় নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। যারা চাকরি করতেন তাদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হওয়ার কথা ছিল। যখন নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন চাকরিজীবীদের সমস্যা দূরীকরণ সাপেক্ষে মন্ত্রণালয় পরিবর্তনের কথা বলা হয়। কিন্তু চাকরিজীবীদের সমস্যা সমাধান না করেই মন্ত্রণালয় পরিবর্তন করা হয়। তখন ক্ষতিগ্রস্ত চাকরিজীবীরা হাইকোর্টে রিট করেন। চলতি বছর মে মাসে হাইকোর্ট বাদীর পক্ষে রায় ঘোষণা করে। সরকার চাইলেই এখন রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রটির যথাযথ ব্যবহার করতে পারে। প্রকল্পের অধীনে গড়ে ওঠা ভবনগুলো বেশ অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। সরকার বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে স্মৃতিকেন্দ্রটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিতে পারে।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলার মুসলিম নারীদের বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছেন। অথচ তার বাড়ি, তার বাড়িতে পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠা ডাকবাংলো, কুটিরশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এমনকি রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র কোনোটিরই প্রকৃত পরিচর্যা করা সম্ভব হয়নি। প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর এলেই জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রে তিন দিনব্যাপী মেলা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। রংপুরে তার নামে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার নামে গড়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন কখনোই নামের সামনে ‘বেগম’ শব্দটি যুক্ত করেননি। তারপরও তার নামের সামনে ‘বেগম’ যুক্ত করে তার প্রতি বরং অবজ্ঞাই প্রকাশ করা হয়। অসচেতনভাবে আমাদের দেশে অনেক বোদ্ধাজন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নামের সামনে বেগম যুক্ত করেছেন। শুধু তাই নয়, তার নামে রাষ্ট্রীয়ভাবে যে পদক দেওয়া হয় সেটি ‘বেগম রোকেয়া পদক’ নামেই দেওয়া হয়। মহান এই লেখকের নাম শুদ্ধ করে ব্যবহার করাই বাঞ্ছনীয়।

ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে জন্ম নিয়ে বিংশ শতকের প্রথমার্ধেই প্রয়াত হন। এই সময়ে বাংলার নারীরা ছিল পোশাকে এবং চেতনায় অবগুণ্ঠিত। পোশাকের অবগুণ্ঠন কিছুটা খুললেও চেতনার অবগুণ্ঠন খুলতে এখনো ঢের বাকি। সে জন্য আমাদের রোকেয়া চর্চা বাড়াতে হবে। রোকেয়া চর্চার সবচেয়ে বড় পাদপীঠ হয়ে উঠতে পারে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র।

সর্বশেষ খবর