ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ এবং গুরুত্বপূর্ণ। অমুসলিমপ্রধান অঞ্চল হিসেবেই এই স্থান পরিচিত ছিল। এই উপমহাদেশে মুসলিমদের বিজয় শুরু হয় প্রধানত ১২শ থেকে ১৬শ শতাব্দীতে। তবে অষ্টম শতাব্দীতে মুসলমানরা রাজপুত সাম্রাজ্যে (বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে) কিছু কিছু হামলা চালিয়েছিল। দিল্লি সালতানাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলাম উপমহাদেশের বড় অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজি বাংলা জয় করেন যা ছিল তৎকালে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে পূর্ব প্রান্ত। ১৪ শতকে খিলজি বংশের আলাউদ্দিন খিলজি তাঁর সাম্রাজ্যের সীমানা দক্ষিণে গুজরাট, রাজস্থান ও দাক্ষিণাত্য মালভূমি এবং তুঘলক রাজবংশ তাঁদের সীমানা তামিলনাড়ু পর্যন্ত বাড়ায়। মারাঠা সাম্রাজ্য ও ব্রিটিশ রাজত্বের পূর্বে মুসলিম মুঘল সাম্রাজ্য ভারতের অধিকাংশ রাজ্যকে দখল বা দমন করতে সক্ষম হয়। লিখেছেন সাইফ ইমন
জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ আকবর
জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ আকবরকে ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে ধরা হয়। তাঁকে বলা হয় আকবর দি গ্রেট, পৃথিবীর ইতিহাসে মহান শাসকদের অন্যতম হওয়ায় তিনি ‘মহামতি আকবর’ নামেও পরিচিত। মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় এই সম্রাট বাবা সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর ১৫৫৬ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি ১৫৪২ সালের ২৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তখন বৈরাম খাঁর তত্ত্বাবধানে সম্রাট আকবর সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকেন। ১৫৬০ সালে বৈরাম খাঁকে সরিয়ে আকবর নিজেই সব ক্ষমতা দখল করেন। আকবর ভারতবর্ষ ও আফগানিস্তানে তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার চালিয়ে যান। ১৬০৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় সমস্ত উত্তর ভারত তাঁর সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে। আকবরের মৃত্যুর পর ছেলে সম্রাট জাহাঙ্গীর ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করেন। সম্রাট আকবর শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য প্রথমত দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। ১. কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা, ২. প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা। কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রধান ছিলেন স্বয়ং আকবর। অর্থনৈতিক বিভাগ, সমর বিভাগ, বেতন ও হিসাব বিভাগ, বিচার বিভাগ, ডাক বিভাগ, গোয়েন্দা বিভাগসহ কেন্দ্রের অধীনস্থ বিভিন্ন মন্ত্রীদের দায়িত্বেও ছিল বিভিন্ন বিভাগ। বিশাল সাম্রাজ্যকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করার জন্য মোট পনেরটি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি প্রদেশে একজন প্রধান শাসনকর্তা নিযুক্ত হতো। এমন সুপরিকল্পিতভাবে রাজ্য ব্যবস্থাকে পরিচালনা করায় নিজের দূরদর্শিতার প্রমাণ রেখেছেন। আকবরের শাসনামলে গড়ে ওঠা স্থাপত্যগুলো তাঁর স্থাপত্যশৈলী জ্ঞানের পরিচয় দেয়। তখনকার রাজধানী ফতেহপুর সিক্রি ১৯৮৬ সালে পৃথিবীর দর্শনীয় স্থানগুলোর তালিকায় জায়গা পায়। অনেকেই বলেন, আকবরের স্থাপত্যের মাঝে কিছুটা নিজ ধর্মের প্রতি বেশিমাত্রায় টান প্রকাশ পায় কিন্তু হিন্দু কিংবা মুসলমান, দুই ধর্মের নিকট থেকেই এই স্থাপত্যগুলোর উপাদান সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়াও বুলন্দ দরওয়াজা এবং জামে মসজিদের নির্মাণশৈলী করেছে ইতিহাসকে মুখ্য।
শেরশাহ শুরি
শেরশাহ ভারতবর্ষের সম্রাট ও শুর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন বিহারের অন্তর্গত সাসারামের জায়গিরদার হাসান খান শুরের পুত্র। ১৪৭২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম। তাঁর প্রকৃত নাম ফরিদ। অল্প বয়সে গৃহত্যাগ করে তিনি বিহারের সুলতান বাহার খান লোহানির অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। তাঁর সাহস ও বীরত্বের জন্য বাহার খান তাঁকে ‘শের খান’ খেতাবে ভূষিত করেন। বাহার খানের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র জালাল খানের অভিভাবক হিসেবে শের খান কার্যত বিহারের সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করেন। বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে সামরিক সুবিধাজনক স্থানে অবস্থিত চুনার দুর্গ তাঁর অধিকারে আসে। তাঁর ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে জালাল খানের অন্য অমাত্যবর্গ শের খানের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন। এঁদের দুরভিসন্ধিতে প্ররোচিত হয়ে জালাল খান শের খানের আধিপত্য থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু শের খান ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে সুরজগড়ের যুদ্ধে মাহমুদ শাহ ও জালাল খানের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। এ বিজয়ের ফলে বিহারের ওপর তাঁর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে শের খান বাংলা আক্রমণ করে সুলতান মাহমুদ শাহকে পরাজিত করেন। কিন্তু মুঘল সম্রাট হুমায়ুন বাংলা অভিমুখে অগ্রসর হলে শের খান বাংলা ত্যাগ করেন। ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে চৌসার যুদ্ধে (বক্সারের কাছে) হুমায়ুনকে পরাভূত করে তিনি ‘শাহ’ উপাধি গ্রহণ এবং বাংলা পুনর্দখল করে খিজির খানকে এর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। পরের বছর পুনরায় হুমায়ুনকে পরাজিত ও ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করে দিল্লির সিংহাসন অধিকার করেন। মাত্র পাঁচ বছরের স্বল্পকালীন শাসনে শেরশাহ সাম্রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বিধান করে প্রশাসনকে পুনর্বিন্যাস করেন। তিনি তাঁর সাম্রাজ্যকে ৪৭টি সরকারে এবং প্রতিটি সরকারকে কয়েকটি পরগনায় বিভক্ত করেন। এ প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বাংলায় ১৯টি সরকার ছিল। প্রতিটি সরকারে ‘শিকদার-ই-শিকদারান’ (মুখ্য শিকদার) ও ‘মুনসিফ-ই-মুনসিফান’ (মুখ্য মুনসিফ) খেতাবধারী দুজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হতো।
আহমদ শাহ দুররানি
আহমদ শাহ আবদালি কিংবা আহমদ শাহ দুররানি বললে উপমহাদেশীয় শক্তিমান সুলতান বোঝায়। কিন্তু আফগানিস্তানে তিনি আহমদ শাহ বাবা কিংবা বাবা-ই-আফগান নামে বেশি পরিচিত। আধুনিক আফগানিস্তানের তিনিই জনক। ১৭৪৭ সালে আফগান লয়া জিরগার অনুমোদন নিয়ে তিনি যখন রাজা হলেন, তখনকার প্রথা অনুযায়ী ‘শাহ দুর-ই-দুরান’ খেতাব গ্রহণ করেন। এর মানে ‘বাদশাহ, মুক্তার সেরা মুক্তা’। নিজের নামের আবদালির স্থলাভিষিক্ত হলো দুররানি। কান্দাহার তাঁর রাজধানী। আফগানিস্তানের দুররানি রাজবংশের সূচনা তাঁকে দিয়েই। আহমদ শাহ যুবক বয়সে আফসারিদ রাজ্যের সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং অতিশিগগিরই তিনি ৪ হাজার আবদালি পশতুন সৈন্যের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান। ১৭৪৭ সালের জুনে পারস্যের নাদের শাহ আফসার মৃত্যুবরণ করলে আহমদ শাহ খোরাসানের আমির হন। তাঁর পশতুন উপজাতি ও তাঁদের জোটকে নিয়ে তিনি পূর্ব দিকের মুঘল ও মারাঠা সাম্রাজ্য, পশ্চিম দিকের পারস্যের আফসারিবাদ সাম্রাজ্য ও উত্তর দিকে বুখারার খানাত পর্যন্ত তাঁর সীমানা নির্ধারণ করেন।
দিল্লি সালতানাত
কুতুবউদ্দিন আইবেক
কুতুবউদ্দিন আইবেক ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা শাসক। দিল্লি সালতানাতের এই প্রখ্যাত সুলতান মধ্যযুগীয় একজন তুর্কী শাসক ছিলেন। যিনি দিল্লির প্রথম সুলতান এবং দিল্লি সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সুলতান হিসেবে ১২০৬ থেকে ১২১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাত্র চার বছর শাসন করেন। দানশীলতার জন্য তাকে ‘লাখবখশ’ বলা হতো। তিনি প্রচুর অর্থ-সম্পদ গরিব প্রজাদের মধ্যে দান করে গেছেন। ১২১০ সালে পোলো খেলার সময় ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে তিনি মারা যান।
তুর্কি আফগান
মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি অন্যতম শক্তিমান শাসক ছিলেন। তিনি বখতিয়ার খিলজি নামেও পরিচিত। তিনি ছিলেন ঘুরি রাজবংশের একজন তুর্কি-আফগান সেনাপতি ও প্রাথমিক দিল্লি সুলতানাতের সৈনিক ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম মুসলিম যিনি ল²ণ সেনকে পরাজিত বাংলা ও বিহার জয় করেছিলেন। পূর্ব ভারতে তাঁর সময়ে ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বলা হয়, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে বাংলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তিনি ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্মকে দুর্বল করে তুলেছিলেন।
খিলজি রাজবংশ
আলাউদ্দিন খিলজি
আলাউদ্দিন খিলজি ছিলেন খিলজি বংশের দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক। যিনি দিল্লিতে বসে ভারতীয় উপমহাদেশে খিলজি শাসন পরিচালনা করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন ভারতীয় ইতিহাসেও আলেকজান্ডারের মতো একজন শক্তিশালী কারও কথা উল্লেখ করা থাকুক। তাই তিনি নিজেকে দ্বিতীয় আলেকজান্ডার (সিকান্দার-এ-সানি) হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তোলেন। তিনি নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করেন এবং জুমার খুতবার আগের বয়ানে নিজের কৃতিত্ব বর্ণনার আদেশ দেন। আলাউদ্দিন খিলজি ছিলেন জালালুদ্দিন খিলজির ভাগ্নে এবং জামাতা।
মুঘল সাম্রাজ্য
মুহাম্মদ বাবর
সম্রাট বাবর উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুরো নাম মির্জা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর। তাঁর জন্ম ১৪৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। মধ্য এশিয়ার প্রখ্যাত এই মুসলমান সম্রাটের জন্মস্থান উজবেকিস্তান। তিনি তৈমুর লঙ্গ-এর সরাসরি বংশধর এবং মাতার দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। তিনি মির্জা ওমর সাঈখ বেগের পুত্র, এবং তৈমুরী শাসক উলুগ বেগের প্রপৌত্র ছিলেন। তিনি পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লির লোদি রাজবংশের সুলতান ইবরাহিম লোদিকে পরাজিত করে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র মির্জা হুমায়ুন সিংহাসনে আরোহণ করেন। পানিপথের যুদ্ধে তিনিই প্রথম কামানের ব্যবহার করেছিলেন এই উপমহাদেশে।
মুঘল সাম্রাজ্য
মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব
মুঘল সম্রাজ্যের অন্যতম আলোচিত সম্রাট ছিলেন আওরঙ্গজেব। আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম আবুল মুজাফফর মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব নামে ডাকা হতো তাঁকে। বাহাদুর আলমগীর ও বাদশাহ গাজী, প্রথম আলমগীর নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৪৯ বছর মুঘল সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রায় সম্পূর্ণ ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছিলেন।
ঘুরি সাম্রাজ্য
মুহাম্মদ ঘুরি
মুহাম্মদ ঘুরি একজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ এবং দূরদর্শী রাষ্ট্র পরিচালক ছিলেন। তিনি ভারতের শোচনীয় রাজনৈতিক অবস্থা অনুধাবন করেছিলেন। তাই এখানে তিনি একটি স্থায়ী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। সুলতান মাহমুদ ভারতীয় উপমহাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চাননি। তিনি এ দেশে এসে বিভিন্ন যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন বটে, কিন্তু পরে স্বরাজ্যে ফিরে যান। পাঞ্জাব বিজয় ছাড়া তাঁর অন্য কোনো অভিযান স্থায়ী ফল লাভ করেননি। এ ব্যাপারে মুহাম্মদ ঘুরির নীতি ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তিনি রাজ্য জয় করে উপমহাদেশে তাঁর বিজয়কে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য ছিল ভারতে স্থায়ীভাবে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত করা। কাজেই এ দেশে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি তাঁর সব শক্তি নিয়োগ করেছিলেন। কয়েকবার পরাজয় সত্ত্বেও তিনি কখনো বিমর্ষ বা হতোদ্যম হননি, বরং দ্বিগুণ উৎসাহ পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বিজয় মুসলমানদের জাতীয় গৌরব বৃদ্ধি করেছিল। নিজের তত্ত্বাবধানে তিনি একদল সুদক্ষ শাসকশ্রেণি গড়ে তুলেছিলেন। তাঁরা তাঁর বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন।