শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিশ্ব রাজনীতি ও গণমাধ্যমের ভূমিকা

জয়ন্ত ঘোষাল

বিশ্ব রাজনীতি ও গণমাধ্যমের ভূমিকা

অলঙ্করণ : শাকীর

গোটা দুনিয়াজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। আসলে বিশ্ব অর্থনীতিই আজ বড় ত্রস্ত বিধ্বস্ত এক সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছে। যে দেশ যে অবস্থানেই থাক না কেন, আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রভূত ক্ষমতাশালী দেশও আজ বেকারি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। লন্ডনে ব্রেকিস্টের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার আর্থসামাজিক কারণগুলো আজ সহজেই বোধগম্য। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে গ্রিক ট্র্যাজেডির নমুনা দেখছি আমরা। গ্রিস দেশের আর্থিক সংকট সামগ্রিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতিকে বিপাকে ফেলে দেয়। আর্থিক সংকট তীব্র হলে এ চরাচরে তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া প্রক্ষোভ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে যায়। স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে লন্ডনের বিবাদ বাড়ার পেছনেও তাই আসল কারণ হলো অর্থনৈতিক অসাম্য। সেই আর্থিক অসাম্য রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আসে। একই কারণে আজ ইউরোপের ঐক্যও ভাঙতে বসেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদ বাড়ছে।

আমেরিকায় যেভাবে ট্রাম্প বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসীন হন তা দেখেও বিশ্ববাসীর মনে হচ্ছিল আমেরিকার মানুষও নিরপত্তার অভাবে ভুগছেন। তাই তাদের মনে হয়েছিল, এ সংকটে আমেরিকার জন্য প্রয়োজন একজন রক্ষণশীল স্বদেশি টাইপ প্রেসিডেন্ট। আমেরিকাকে এখন ইমিগ্রেশন নিয়ে সোচ্চার হতে হবে। বহিরাগতদের তাড়িয়ে আমেরিকাকে শুধু আমেরিকানদের জন্য করতে হবে। এমনকি আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের পর্যন্ত সেভাবে আর আমেরিকায় স্বাগত জানানোর প্রয়োজন নেই। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য বিদেশিদের যে ভিসা দেওয়া হয় আমেরিকায় তা নিয়েও কড়া নীতি নেওয়া হচ্ছে। H-1 ভিসা নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সংঘাত তো চলছে অনেক দিন থেকেই।

বিশ্বের এ প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র তথা দক্ষিণ এশিয়ার উঠোনেও এসে আছড়াচ্ছে সেই ঝড়। চীনের ড্রাগনের নিঃশ্বাসকে অবশ্য আজ ভারত কেন আমেরিকাও ভয় পায়। তবে একথা অনস্বীকার্য যে পৃথিবীর সমসাময়িক ইতিহাসে চীনের আর্থিক অগ্রসরতা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তবে চীনের যে আক্রমণাত্মক বাণিজ্য নীতি তাও কিন্তু টিকে আছে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর বাজারে। চীনের মৌল বাণিজ্য নীতি হলো- অন্যের দেশের বাজার দখল কিন্তু নিজের পণ্য তুলনামূলকভাবে সস্তা কারণ যে দেশে উৎপাদন হার খুব উন্নত এবং শ্রমিক সস্তা। আর অন্যদিকে নিজের দেশে অন্যের পণ্য ঢুকতে না দেওয়া। যাকে অর্থনীতিতে বলে প্রোটেকশানিজম। কিন্তু আমেরিকা এবং চীন এ দুই দেশের বাণিজ্যিক পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বড়ই জটিল। কারণ একথা যেমন সত্য যে চীন যদি আমেরিকা থেকে তার সব বিনিয়োগ এ মুহূর্তে প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে আমেরিকার অর্থনীতি শেষ হয়ে যাবে, আবার অন্যদিকে সেটা করলে চীনের অর্থনীতিও শেষ হয়ে যাবে তখন চীনও মার্কিন বাজারের ওপর ভয়াবহভাবে নির্ভরশীল।

ভারতের সঙ্গে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের পারদ ওঠে এবং নামে এবং এক্ষেত্রেও চীন এক মস্ত বড় নির্ধারণ শক্তি হয়ে উঠেছে। চীন যেভাবে মিয়নামার ভুটান এমনকি নেপাল-শ্রীলঙ্কার পরিকাঠামো উন্নয়নের নামে বিপুল অর্থ জোগাচ্ছে তাতে ভারতের সঙ্গে সে দেশগুলোর রাজনৈতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে। চীন অবশ্য বাংলাদেশেও তার সখ্য বাড়াতে তৎপর, তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি এব্যাপারে বিশেষ পরিপক্ব ও সচেতন। দেশটা ছোট হলেও ৭১ সালে জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশ যেসব ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে তাতে ঘা খেয়ে আজ নেক বেশি সাবধানী ও পরিপক্ব।

অর্থনীতির এই নয়া সাম্রাজ্যবাদী চেহারা বিশ্বের নানা প্রান্তে হিংসাকে ছড়াতে সাহায্য করছে। একটা সময় ছিল পৃথিবীতে শক্তিশালী দুটি মেরু। একদিকে আমেরিকা আর অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সে ছিল ঠাণ্ডাযুদ্ধের সময়। তারপর? ঠাণ্ডাযুদ্ধের সময় অতিবাহিত হলো। অভিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেল। যাকে বলা হয় ভল্কানাইজেশন। এরপর পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা দেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। পৃথিবীর ইতিহাসে একে বলা হয়েছিল Poly Centrism কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে চীন-রাশিয়া-পাকিস্তান একটা নতুন অক্ষ তৈরি হচ্ছে যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই চ্যালেঞ্জ করতে চাইছে। পুতিন রাশিয়াকে আবার মস্ত সাবিত করতে চাইছে দুনিয়ার সামনে। আর এটা এমন এক সময় যখন সামগ্রিকভাবে সংবাদ মাধ্যম অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর। এখন নিমিষে সংবাদ বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলে যাচ্ছে যা অতীতে ভাবাই যেত না।

তাই আজ যখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয় আজ যখন উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন করে ঝগড়া বাঁধে, আজ যখন লন্ডনের সঙ্গে ইউরোপের বিবাদ হয় তখন সংবাদ নিমিষে গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে ছড়িয়ে যায়। আর শুধু তো খবর নয়, হোয়াটসঅ্যাপ থেকে, ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম আরও কতরকমের প্ল্যাটফর্ম। আগে ছিল সংবাদপত্র তার সম্পাদকীয় স্তম্ভ। বিশ্বযুদ্ধের সময় সংবাদপত্রের ভূমিকা চিরস্মরণীয়। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলা সংবাদপত্র পত্রিকার ভূমিকা ঐতিহাসিক। তখন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আসেনি কিন্তু এরপর যখন ঢাকায় শাহবাগের আন্দোলন দেখলাম তখন গোটা পৃথিবীতে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া তা কভার করল। ব্লগারদের গুরুত্বও তো বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক আজ অতি সহজে অনুধাবন করতে পারেন। আবার ব্লগারদের প্রভাব সমাজে পড়ে তার বড় প্রমাণ হলো তাদের ওপর পালটা প্রত্যাঘাত হানছে। এমনি হত্যা করছে উগ্রপন্থিরা।

আসলে আমার আজ মনে হয় সংবাদমাধ্যম বৃক্ষটি আজ নানাভাবে বিস্তার লাভ করেছে। তার অনেক শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে। আবার একটি মাধ্যম অন্য আর একটি মাধ্যমের সঙ্গে সংবাদ জগতে পরিপূরক।

আর এ গতিশীল সংবাদমাধ্যম আছে বলেই গোটা দুনিয়ায় এত সন্ত্রাসবাদী সংঘাত থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্র টিকে আছে। ট্রাম্প যেমন নানান কীর্তিকা  করে চলেছেন আবার এও দেখছি প্রায় প্রতিদিন একটা করে বই প্রকাশ হচ্ছে ট্রাম্পের অরাজকতা নিয়ে। আর সাহসের সঙ্গে সেসব বই লিখে চলেছেন মার্কিন সাংবাদিকরাই।

তাই আজকের দুনিয়ায় যেমন একনায়কতন্ত্র যুদ্ধবাজরা আছেন ঠিক সেভাবে এ চূড়ান্ত অব্যবস্থার মধ্যেও মানুষ টিকিয়ে রেখেছে গণতন্ত্রকে। আর তার জন্যই প্রয়োজন সংবাদমাধ্যমকে। 

লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর