শিরোনাম
রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

আমাদের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু সব সময় প্রাসঙ্গিক

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

আমাদের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু সব সময় প্রাসঙ্গিক

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কিছু লিখতে বসে ৪৬ বছর আগের একটি ঘটনা মনে পড়েছে। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ ৭৩ জাতি (NAM) শীর্ষ সম্মেলন চলছে। বাংলাদেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। একটি স্বৈরাচারী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একজন গণতান্ত্রিক নেতা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন, সেই নেতাকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন শীর্ষ সম্মেলনে আগত অন্যান্য নেতা।

বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কক্ষে ঢুকতেই অনেক নেতা তার দিকে ছুটে আসেন। আমার সাংবাদিক জীবনের এটা সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। সম্মেলনের তখন চা-বিরতি হয়েছে। রাষ্ট্রনায়করা একটা বিরাট হলঘরে পানীয় হাতে পরস্পরের সঙ্গে গল্প করছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে তাদের কয়েকজন গোল হয়ে দাঁড়ালেন। ভারতের শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এগিয়ে এসে সবাইকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মিসরের আনোয়ার সাদাত, লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফি, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, সাবেক যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো ও কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো। এবং এ বৃত্তের বাইরে, একটু বাইরেই দাঁড়িয়েছিলেন সৌদি আরবের কিং ফয়সল। সম্ভবত আরও দু-একজন ছিলেন। তাদের কথা মনে নেই।

দীর্ঘ ৪৬ বছর পর নিজের চোখে দেখা এ ঘটনাটির কথা মনে পড়ল এ কারণে যে, সেদিন জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যেসব রাষ্ট্রনেতাকে দেখেছিলাম, তাদের মধ্যে এখন আর কেউ বেঁচে নেই। এদের মধ্যে মার্শাল টিটোই একমাত্র স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন, যদিও তার অখণ্ড সমাজতান্ত্রিক যুগোস্লাভিয়া আর নেই। মার্কিন সিআইএর চক্রান্ত তাকে রক্তাক্ত ও বিভক্ত করেছে। আর উল্লিখিত বেশির ভাগ রাষ্ট্রনেতাকেই সিআইএর মদদপুষ্ট চক্রান্তে একে একে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে। ওই বছরেরই জুলাই মাসে হত্যা করা হয় সৌদি আরবের কিং ফয়সলকে। তিনি এক বছরের মধ্যে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের দখলমুক্ত করে পবিত্র আল-আকসা মসজিদে নামাজ পড়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। সিআইএ ও ইসরায়েলের মোসাদের যুক্ত চক্রান্তে তিনি তার পরিবারের এক সদস্যের হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর শীর্ষ বৈঠকের সেদিনের বৃত্তের নেতাদের বিভিন্ন সময় একে একে হত্যা করা হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করানো হয়েছে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা। আনোয়ার সাদাতকে হত্যা করানো হয়েছে চরমপন্থি মুসলিম ব্রাদারহুডের জঙ্গিদের দ্বারা। যদিও বলা হয়, ইয়াসির আরাফাত রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এখন জানা যাচ্ছে, মোসাদের চরেরা তার শরীরে স্লো পয়জনিংয়ের ব্যবস্থা করেছিল। অতিসম্প্রতি তথাকথিত আরব বসন্তের নামে লিবিয়ার গাদ্দাফিকে হত্যা করা হয়েছে।

গত শতকে পৃথিবী দুই শক্তি শিবিরে বিভক্ত ছিল। একদিকে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তি জোট। অন্যদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শক্তি শিবির। এই দুই শিবিরেরই আগ্রাসন থেকে বিশ্বের সদ্য স্বাধীন উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ভারতের নেহরু, মিসরের নাসের ও সাবেক যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে গঠিত হয় জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এ সম্মেলনকে বিরূপ চোখে দেখেনি। কিন্তু পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শিবির গোড়া থেকেই এই জোটনিরপেক্ষতাকে সুনজরে দেখেনি। এই জোট ভাঙার চেষ্টা করেছে।

নেহরু ও নাসেরের মৃত্যুর পর মনে হয়েছিল, ন্যাম বা নিরপেক্ষ জোট নেতৃত্বের অভাবে ভেঙে যাবে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শিবির এই সম্ভাবনায় খুশি হয়েছিল। কিন্তু ন্যাম ভেঙে যায়নি। নেহরু ও নাসেরের মৃত্যুর পর নেহরুর শূন্যস্থান পূর্ণ করেন ইন্দিরা গান্ধী। মার্শাল টিটো তো বেঁচেই ছিলেন। নাসেরের শূন্যস্থান পূর্ণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সের ন্যাম সম্মেলনেই একটা কথা অনেকের মুখে উঠে এসেছিল? এই নিরপেক্ষ জোটের নেতৃত্ব এখন ইন্দিরা-মুজিব-টিটোর। এ সম্মেলনেই ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে থাকলে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতা তো বটেই; বিশ্বনেতা হিসেবেও স্বীকৃত হতেন। এ সত্যটা তিনি জীবিত থাকতেই উপলব্ধি করে বিশ্বশান্তি পরিষদ তাকে জুলিও কুরি পদক প্রদানের সঙ্গে ‘বিশ্ববন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করেছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরের বছর পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে যে বিশ্বশান্তি সম্মেলন হয়, তাতে বিশ্বের স্বাধীনতা ও শান্তির অগ্রদূত হিসেবে হো চি মিনের বিশাল প্রতিকৃতির পাশাপাশি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি।

বঙ্গবন্ধু হত্যা, ইন্দিরা হত্যা ও টিটোর মৃত্যুর পর নেতৃত্বশূন্যতায় ন্যাম দুর্বল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের পাল্টা সুপার পাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়নেরও বিপর্যয় ঘটে। এ সময়টা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য স্বর্ণযুগ। হিটলারের মেইন ক্যাম্পের অনুসরণে আমেরিকায় জর্জ বুশের নেতৃত্বে নিওকন নামধারী নব্য ফ্যাসিবাদীরা ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ তৈরি করে, যার মূল কথা বিশ্বে তাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শক্তি শিবির নেই। ন্যাম দুর্বল ও নেতৃত্বহীন। তারই সুযোগে বিশ্বময় চলছে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ও ধনবাদের অবাধ আগ্রাসন।

এ বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেও চলছে নানা অবস্থায় টানাপড়েন। ধনবাদ-আশ্রিত বিশ্বসন্ত্রাস ধর্মের মুখোশে আত্মপ্রকাশ করেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকায় স্বাধীনতা ও শান্তির যে জোয়ার প্রবাহিত হয়েছিল, তা আজ আবার নব্য সাম্রাজ্যবাদীদের থাবায় অবরুদ্ধ। ঈগলের রক্তচঞ্চু ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা মধ্যপ্রাচ্যে। বাংলাদেশেও তা অভিশপ্ত ছায়ার বিস্তার ঘটাতে চায়। এ সময়ে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব আরও বেশি প্রয়োজন ছিল। তার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম, শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ বাংলাদেশের মানুষকে শান্তি ও স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পারত।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা চেষ্টা করছেন বিশ্বের পরিবর্তিত ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও পিতার স্বদেশ ও বিদেশনীতিকে আঁকড়ে থাকতে। চারদিকে তিনি শত্রুবেষ্টিত। তবু লড়াই করছেন। জোটনিরপেক্ষ ন্যামকে তিনি শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। এ জন্য একবার ন্যাম সম্মেলনের আয়োজনও করেছিলেন ঢাকায়। এ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব ও প্রভাব দুই-ই বাড়ত। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই সময় শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। বিএনপি ও খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে ন্যাম সম্মেলনের সব আয়োজন বাতিল করে দিয়ে পশ্চিমা প্রভুদের মনোরঞ্জন করেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রেরণা বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় শেখ হাসিনাকে অনেক বেশি সাহসী করে তুলেছে। বঙ্গবন্ধু কিসিঞ্জারের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করেছিলেন। শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক ও মার্কিনি চাপ দুই-ই অগ্রাহ্য করার সাহস দেখিয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসের ব্যাপারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে মার্কিন চাপের কাছে মাথা নত করেননি। বর্তমানে আইএস দমনের নামে বাংলাদেশে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি মেনে নিতেও হাসিনা সরকার রাজি হয়নি।

বঙ্গবন্ধু আমেরিকার চাপ উপেক্ষা করে কিউবার কাছে পাট বিক্রি করেছিলেন। ফিদেল কাস্ত্রোর দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আক্রান্ত লিবিয়ার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে প্রতীকী সাহায্য হিসেবে টি ব্যাগ পাঠিয়েছিলেন গাদ্দাফিকে। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম বঙ্গবন্ধুকে তার আদর্শ নেতা ঘোষণা করে তাকে সোনার কালিতে ছাপানো একখণ্ড কোরআন শরিফ উপহার দিয়েছিলেন।

শেখ হাসিনা সম্ভবত পিতৃপদাঙ্ক অনুসরণ করেই একক সুপার পাওয়ারের যুগেও আমেরিকার কর্তৃত্ববাদের কাছে মাথা নত করেননি। তার পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য এখানেই যে, ভারতের সঙ্গে মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক শক্তিশালী করার সঙ্গে সঙ্গে নয়া চীনের সঙ্গেও অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা বাড়িয়ে তুলেছেন। অবশ্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সূচনা করে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই।

যুবনেতা থাকাকালেই তিনি দেশের এক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে পঞ্চাশ দশকের গোড়ায় চীন সফরে যান এবং মাও জে দংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময়ই চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। এই বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হয় পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে (শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী) চৌ এন লাই যখন পাকিস্তান সফরে এসে ঢাকায় আসেন এবং ঢাকায় এক বিরাট নাগরিক সংবর্ধনা সভায় ভাষণ দেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন ভূ-রাজনীতির কারণে নয়া চীন যদিও এ যুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়; কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অবস্থার বাস্তবতা মেনে নিয়ে গোপনে ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালায়। জানা যায়, মিসরের প্রেসিডেন্ট সাদাত যখন চীন থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে ঢাকায় যাত্রাবিরতি করেছিলেন, তখন চৌ এন লাইয়ের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে লেখা একটি গোপন চিঠি বহন করে এনেছিলেন।

একুশ শতকে পৃথিবী এখন অনেক বদলে গেছে। বিশ শতকের পৃথিবী এখন নেই। বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকেও তাই তার স্বদেশ ও বিদেশনীতি অনেক বদলাতে হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দুটি মৌলিক নীতি থেকে তিনি সরে আসেননি। একটি হলো সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান, আরেকটি হলো বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের কাছে নতজানু না হওয়া। সম্ভবত এই দুটি আদর্শের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ টিকে থাকবে এবং বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু দিন দিন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন।

লেখক : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক সাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর