শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

যত দোষ-নন্দ না আনন্দ ঘোষ

হানিফ সংকেত

যত দোষ-নন্দ না আনন্দ ঘোষ

শিল্পকর্ম : শিল্পী শাহাবুদ্দিন

আমরা কথায় কথায় একটা কথা প্রায়শই বলি, ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ অর্থাৎ নন্দ বাবুর মন্দ ভাগ্যকে দোষ দিতেই যেন আমাদের আনন্দ। রোষ দেখিয়ে দোষ খোঁজার এই নন্দ ঘোষ কিন্তু কোনো বিশেষ ব্যক্তি নন। আমরা যখন যেখানে-যাকে-যেভাবে-যা বলে পারি দোষারোপ করি। আর সব দোষ গিয়ে পড়ে ওই অভাগা নন্দ বাবুর ওপর। আমরা জানি, কেউ ভোলে কেউ ভোলে না। তবুও যেটা ভোলা ভালো নয় সেটা ভুলেই আমরা ভুল করি। আবার কেউ কেউ আছেন, ভুলেও ভুল কাজটি নির্ভুলভাবে করতে ভোলেন না। তাই কথায় কথায় অনেকেই নন্দলালকে টেনে আনেন। আজকাল টেলিভিশন নামক যন্ত্রটিও যেন নন্দ ঘোষ হয়ে গ্যাছে। এই যন্ত্রটিকে আঁতেল জাতীয় সমালোচকরা একসময় বলতেন, ‘বোকা বাক্স’। অবশ্য তখন দেশে এত টেলিভিশন ছিল না। সব ঝড় যেত দেশের একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশনের ওপর। তখন এত টক শো-এর প্রচলনও ছিল না। এখন তো নানান ধরন-গড়ন ও বরণের টক শো চোখে পড়ে। আগে ছিল বসে বসে, এখন হেঁটে হেঁটেও টক শো হয়। একটি চ্যানেলে দেখলাম উপস্থাপক মাঝে মাঝে শুয়ে শুয়েও টক শো উপস্থাপনা করছেন, সেলিব্রেটি টক শো। অদ্ভুত আঙ্গিকের সব অনুষ্ঠান অদ্ভুত তার পরিবেশনা। যেহেতু যাবতীয় সমালোচক এবং বুদ্ধিমানরা এখন টক শোর ‘টকার’ হয়ে পড়েছেন তাই টেলিভিশনকে এখন গণহারে আর ‘বোকা বাক্স’ বলতে শোনা যায় না। যদিও চ্যানেলের সংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়া চ্যানেলের অনুষ্ঠানের কাঙ্ক্ষিত কোনো মান বৃদ্ধি হয়নি। তবে অধিকাংশ চ্যানেলের কর্তা ব্যক্তিদের জীবন-মানের বেশ উন্নতি হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, তারা নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী যখন তখন নানান উছিলায় টিভি পর্দায় চেহারা দেখাতে পারেন। কখনো একা, কখনো সপরিবারে। মানহীন অনুষ্ঠান এবং বিজ্ঞাপন নির্যাতনের পাশাপাশি এসব কারণেও দর্শকরা দেশীয় চ্যানেলের ওপর বিরক্ত। তাই রিমোট নামক যন্ত্রটির আদর এবং কদর দুটোই বেড়ে গেছে। পাশাপাশি টিভি দর্শকদের সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। তবে সেটা দেশি চ্যানেল কিংবা দেশি অনুষ্ঠান দেখার জন্য নয়— দেশি চ্যানেলে বিদেশি সিরিয়াল কিংবা বিদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখার জন্য। এসব সিরিয়াল আমাদের দর্শকদের ‘কী জাদু করিল’ তা বোঝা মুশকিল। অথচ এসব সিরিয়াল আমাদের সমাজকে, দর্শককে, সংস্কৃতিকে কলুষিত করছে ভীষণভাবে। সংসার ভাঙা-কলহ-বিবাদ-কূটনামি এবং যতরকম অশালীন, অশোভন এবং অবৈধ সম্পর্ক আছে সব ব্যাপারেই তারা সগর্বে ধারণা দিয়ে থাকে। আর আমাদের এখানে এক ধরনের বিকৃত রুচির দর্শক তা দেখে আনন্দ পান। কিন্তু এর ফলে যে আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে, ভাই-বোন-ভাবী-ননদ-মামা-চাচা-খালা এমনি অনেক পারিবারিক সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে কেউ গভীরভাবে ভাবছেন বলে মনে হয় না। এ প্রসঙ্গে পল্লীকবির একটি কবিতার কথা মনে পড়ে—

‘মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি

মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি

মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়’

সত্যিই এই মায়া মমতায় জড়াজড়ি করে থাকার যে দৃশ্য তা আজ খুব একটা দেখা যায় না। আর এই সবকিছুর জন্যই দায়ী এই টেলিভিশন নামক যন্ত্রটি অর্থাৎ বোকা বাক্স। এবার একটু পুরস্কারে আসা যাক।

আগে টেলিভিশন নাটক বা চলচ্চিত্রের জন্য এখনকার মতো দেশি-বিদেশি এত পুরস্কারের রেওয়াজ ছিল না। পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য এত প্রতিযোগিতাও ছিল না। আগে প্রধান বিষয় ছিল ছবিটি ক’ সপ্তাহ চলল, কতজন দর্শক দেখল? আর এখন অনেকের কাছে মুখ্য বিষয় ছবিটি কটি পুরস্কার পেল? আজকাল কোনো কোনো ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান যেভাবে গণহারে পুরস্কার পাওয়া শুরু করেছে তাতে পুরস্কার প্রাপ্তির যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

ইদানীং কিছু কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেখা যায় সেই সব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার যারা তাদের জীবদ্দশায় শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসাসহ নানান ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন, তাদের নামে পুরস্কার প্রবর্তন করে-বিভিন্ন ব্যক্তিকে প্রদান করছেন। তবে এসব পুরস্কার অপাত্র, সুপাত্র না কুপাত্রে প্রদত্ত হচ্ছে সেটা অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারই বিবেচ্য বিষয় নয়।

তাদের বিবেচ্য বিষয় হলো তথাকথিত এসব পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে আত্মস্বার্থ সিদ্ধির পথ নির্মাণ। মিডিয়ার প্রভাবকে কাজে লাগাতে ইদানীং অনেক প্রতিষ্ঠানকেই এমনি অপাত্রে পুরস্কার প্রদান করতে দেখা যাচ্ছে। ফলে এসব পুরস্কার যেমন বিতর্কিত হচ্ছে তেমনি প্রবর্তিত পুরস্কারগুলো যাদের নামে দেওয়া হয় তাদেরও সম্মানহানি ঘটছে। এভাবে পুরস্কার নামক শব্দটিকে কলঙ্কিত না করে যদি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে খুঁজে খুঁজে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত প্রচারবিমুখ নিঃস্বার্থ মানুষদের পুরস্কৃত করা হতো তাতে তারা যেমন উৎসাহিত হতেন তেমনি অন্যরাও জনকল্যাণমূলক কাজে অনুপ্রাণিত হতেন। এরকম অনেক গুণী মানুষকেই আমরা ‘ইত্যাদি’তে তুলে ধরেছি। যারা কাজ করেন তাদের দায়বোধ থেকে, কোনো কিছু প্রাপ্তির আশায় নয়। যেমন বরগুনার জয়দেব দত্ত-যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে সিডরের সময় ৫০০০ লোকের জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রেখেছিলেন। নওগাঁর ৯০ বছর বয়স্ক গহের আলী, যিনি চাল-ডালের সঙ্গে তালের আঁটি ভিক্ষে করে সরকারি রাস্তার দু’পাশে প্রায় ১৮ হাজারেরও বেশি তাল গাছ লাগিয়েছেন। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার ৯০ বছরের বৃদ্ধ পলান সরকার, যিনি এই বৃদ্ধ বয়সেও মাইলের পর মাইল হেঁটে বই পড়ার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। গত ২৯ বছরে ‘ইত্যাদি’তেই এমনি অনেক উদাহরণ রয়েছে।

এই প্রচার-সর্বস্বতার যুগেও এরা কেউই হতে চাননি কোনো প্রচার মাধ্যমের অতি ব্যবহূত মুখ। কাজ করেছেন এবং করে চলেছেন নীরবে-নিভৃতে। ফুল ফুটলে তার সুবাস ছড়াবেই। তাই এদের কারও আত্মপ্রচারের প্রয়োজন হয়নি। মানুষের ভালোবাসাই তাদের পুরস্কার। শুধুমাত্র এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই নয়-দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাদের গর্ব বাংলা একাডেমির পুরস্কারও ক্রমান্বয়ে বিতর্কিত হয়ে উঠছে। অনেকের অভিযোগ, এই পুরস্কারও ইদানীং গুণ বিচারী না হয়ে, হয়ে উঠছে সম্পর্ক বিচারী।

অনেকটা অপাত্রে কন্যা সম্প্রদানের মতো-অপাত্রে পুরস্কার প্রদান। এই সম্পর্ক বিচারীরা যখন পুরস্কার পান-তখন অন্যরা হাসেন, যেই হাসিটা এরা দেখতে পান না। কারণ অজ্ঞ লোকেরা বিজ্ঞ সেজে বসে থাকলে-কে হাসল, আর কেন হাসল সেটা বোঝা তার জন্য কঠিনই বৈকি। ঊনবিংশ শতাব্দীর এক ইংরেজ প্রাবন্ধিক বলেছিলেন, ‘নলেজ ইজ পাওয়ার’ অর্থাৎ জ্ঞানই ক্ষমতা বা শক্তি। এই ক্ষমতা চার প্রকার। এক. সবচেয়ে ক্ষমতাবান-যে জানে সে জানে। দুই. মোটামুটি ক্ষমতাবান-যে জানে সে জানে না। তিন. সুপ্ত ক্ষমতাবান-যে জানে না সে জানে। চার. লুপ্ত ক্ষমতাবান-যে জানে না সে জানে না।

আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই এই ৪র্থ বর্গের। কারণ আমরা যতই আপনাকে বড় বলে বড় হয়ে যাই, লাইন-ধাইন করে, ম্যালা কিছু পাই তাদের সবাই চেনেন এবং তাদের সম্পর্কে সবাই জানেন। সমস্যা হচ্ছে, এই জাতীয় লোকেরা জানে না যে সে জানে না।

পরিশেষে দুটি ঘটনা উল্লেখ করেই এ লেখা শেষ করব। গত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে প্রচারিত ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানটি আমরা করেছিলাম দিনাজপুর জেলায়। অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমি, বন্ধু অ্যান্ড্রু কিশোর এবং বিশিষ্ট চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন বুলুকে নিয়ে আমরা একটি বেসরকারি বিমানে সৈয়দপুর গিয়েছিলাম এবং অনুষ্ঠান শেষে ফিরেছিও সেই বিমানে। ফিরতি তারিখটি ছিল সম্ভবত ১৯ ডিসেম্বর। ফেরার দিন প্রায় ঘণ্টাখানেক আগেই সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম। স্থানীয় গাড়ি চালক আমাদের সরাসরি ভিআইপি টার্মিনালে নামিয়ে দিল। আমরা ভিআইপি টার্মিনালের ভিআইপি বিশ্রাম কক্ষে ঢুকে দেখলাম পুরো কক্ষ পূর্ণ। বসার জায়গা নেই। শুধু এক পাশে তিনটি সোফা শূন্য। অর্থাৎ কেউ সেখানে বসেননি। তবে সোফার পাশে এক স্থানে লেখা রয়েছে, ‘এই আসন ৩ (তিন)টি মাননীয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং তাদের পদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি মহোদয়ের জন্য’। আমরা খালি সোফা দেখে বসতে যাব এমন সময় সোফার পাশের এই লেখাগুলো আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাই বসতে গিয়েও বসলাম না এবং অন্যরা কেন বসেননি সেটাও বুঝতে পারলাম। কঠিন সংকটে পড়লাম। বসতেও পারছি না আবার পরিচিত মুখ বলে বাইরে গিয়ে হাঁটাহাঁটিও করতে পারছি না। কক্ষের অনেকগুলো চোখ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ বিব্রতকর অবস্থা। কক্ষের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিটিও ইতস্তত করছে। অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এমন সময় কক্ষের অন্য একটি সোফায় বসা এক ভদ্রলোক হঠাৎ এগিয়ে এসে আমাদের বললেন, ‘আপনারা বসুন’। ভাবলাম তিনি কর্তৃপক্ষের কেউ কিনা, কিন্তু না-আমাদের মনের ভাব বুঝতে পেরে তিনি নিজেই বললেন, ‘আমি একজন সাধারণ যাত্রী, আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন দেখে খারাপ লাগছে, তাই বললাম’। আমরা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে কক্ষের বাইরে এলাম। নিজেদের মধ্যেই ছোটখাট একটা টকশো করলাম-আমাদের পদমর্যাদা নিয়ে অর্থাৎ আমরা কোন ক্যাটাগরিতে পড়ি? এর মধ্যে অ্যান্ড্রু কিশোর জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত একজন শিল্পী। আমিও দুটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। মর্যাদার দিক থেকে এসব স্থানে আমাদের অবস্থান কী বুঝতে পারছি না। নানাবিধ জটিল প্রশ্ন মাথায় উঁকি দিচ্ছিল। ইতিমধ্যে আমাদের খবর পেয়ে এয়ারপোর্ট ম্যানেজার ছুটে এলেন। তিনিও বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেন। কারণ একটিই, ‘তিনটি শূন্য সোফা ও সাদা কাগজে কম্পোজ করা পদমর্যাদার ব্যাখ্যা’। এয়ারপোর্ট ম্যানেজার অত্যন্ত বিনয়ী এবং অমায়িক। তিনি আমাদের এয়ারপোর্টের দোতলায় আর একটি ভিআইপি কক্ষে নিয়ে গেলেন যেখানে কেউ নেই। তিনি আমাদের আপ্যায়নও করলেন। তার ব্যবহারে আমরা মুগ্ধ হলাম। তবে মন থেকে পদমর্যাদা সম্পর্কিত জটিলতা মুহূর্তের জন্যও গেল না। কারণ এয়ারপোর্ট ম্যানেজার যাই করেছেন সেটা আমাদের ভালোবেসে ব্যক্তিগত উদ্যোগে করেছেন। সরকারি বিধি অনুযায়ী করেননি। কারণ সরকারি অফিসে বিধি মানুক চাই না মানুক ফাইলে লেখা হয়, ‘বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিন’। এই ধরনের আইন নিয়ে তারা নিজেরাও বিব্রত। জানতে চাইলাম, ভিআইপিরা এলে নিশ্চয়ই কর্তৃপক্ষ আগে থেকে অবগত হন এবং আগাম খবর জানলে সোফাগুলো দখল করে রাখা যায়। কিন্তু কোনো ভিআইপি নেই তারপরও সোফাগুলো খালি রাখার এই অদ্ভুত ব্যবস্থা কেন? বুঝতে পারছি আমাদের প্রশ্ন শুনে তারাও বিব্রত হচ্ছেন। যাই হোক এয়ারপোর্টে নিরাপত্তা কর্মচারী থেকে শুরু করে কারিগরি এবং প্রশাসনিক বিভাগের প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ আমাদের ঘিরে ধরে উচ্ছ্বাস এবং ভালোবাসা প্রকাশ করলেন। পাশাপাশি ওই শূন্য সোফার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। একজন জানালেন, হঠাৎ করে কেউ বসে পড়লে ভিআইপি এলে তাকে ওঠানোটা বিব্রতকর, তাই ওটা খালিই রাখি। সুন্দর যুক্তি। কিন্তু এই যুক্তিতে আমাদের সংকট মুক্তি হলো না। আর সে সংকট হচ্ছে শিল্পীর পদমর্যাদার সংকট। একজন বললেন, ওই ভিআইপি কক্ষে যাদের জন্য সোফা পেতে জায়গা সংরক্ষণ করা হয়েছে একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের পর তারা কেউই আপন পদমর্যাদায় থাকবেন না কিন্তু একজন শিল্পীর পদমর্যাদা আমৃত্যু থাকবে। কিন্তু তাতে কী? সোফা শূন্য রাখার বিধানে কোনো পরিবর্তন হবে? তবে শূন্য সোফা আর লেখা দেখে যতটুকু ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম ফেরার সময় এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলাম।

বিমান ঢাকায় অবতরণের পূর্বে আবারও জটিলতা। এই জটিলতার জটে পড়ে এবার শুধু ক্ষুব্ধ নয়-ভীতও হলাম। শুধু আমরা তিনজনই নয়, বিমানের সব যাত্রীরই একই অবস্থা। কারণ হচ্ছে-হঠাৎ করে বিমানে ঘোষণা করা হলো বিমান অবতরণে দেরি হবে। অর্থাৎ ডিলে হবে। এখানেও সেই ভিআইপি সমস্যা। তবে এই ভিআইপি আকাশে নয়, নিচে। এয়ারপোর্টে ভিআইপি মুভমেন্ট হচ্ছে। তাই ডিলে হবে। মুভমেন্ট শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিমান নামতে পারবে না। আকাশে থাকতে হবে। কিন্তু কেউ জানে না, কতক্ষণ বিমানকে আকাশে থাকতে হবে? তাই যাত্রীরা অজানা আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করছেন-কেউ বলছেন, বিমানে পর্যাপ্ত তেল আছে কিনা? তেল ফুরালে কী হবে? সবাই ভিআইপির নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত কিন্তু এতগুলো যাত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে কারও যেন মাথাব্যথা নেই। অথচ ভিআইপি নিচে আছেন আমরা তো আকাশে। যাত্রীদের মন্তব্যগুলো শুনছিলাম এবং অপ্রকাশ্য শঙ্কায় ভিতরে ভিতরে ঘামছিলাম। এর মধ্যে একজন নারী যাত্রীর কান্নার শব্দ পেলাম। যাই হোক ১৫-২০ মিনিট পরই বিমান অবতরণ করল। কিন্তু এই ১৫ মিনিট অনেকের কাছে ১৫ বছর মনে হয়েছে। যাদের হার্টের সমস্যা কিংবা উচ্চ রক্তচাপ আছে এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের শারীরিক বিপর্যয় ঘটা অস্বাভাবিক নয়। ভাগ্য ভালো কিছু হয়নি। যদি হতো-তার দায়-দায়িত্ব কে নিত? কিছুদিন পরপরই তো পত্রিকার পাতায় দেখা যায় ‘অল্পের জন্য রক্ষা’। বিমানের একজন ক্রুকে দেখলাম একজন যাত্রীকে পানি দিচ্ছেন। তিনি সম্ভবত অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আর একজন যাত্রী উত্তেজিত হয়ে একজন কেবিন ক্রুকে বললেন-আপনারা ভূমিতে ভিআইপির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন আর এত হাজার হাজার ফুট উঁচুতে আমাদের নিয়ে আপনাদের কোনো চিন্তাই নেই, আমাদের জীবন কি জীবন না?

ক্রু জবাব দিলেন, ভিআইপি মুভমেন্ট হলে নামা যায় না। এটাই সিস্টেম।

আসলেই তো ওরা কী করবে? এখানেও বিধান। সবকিছুই বিধি মোতাবেক হচ্ছে।

এক্ষেত্রেও শূন্য সোফা আর পদমর্যাদার ব্যাখ্যার মতো কোনো গ্রহণযোগ্য সদুত্তর পাওয়া যায়নি। কারণ যারা উত্তর দেবেন তারা তো ভিআইপি কিংবা ভিভিআইপি-আমাদের সমাজে তাদের কোনো সমস্যা নেই। ফলে দোষটা যে নন্দ ঘোষদের দেওয়া যেত তারা তো আনন্দেই আছেন।

 

লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়ন কর্মী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর