পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবিপ্রবি) শিবির সন্দেহে তিন শিক্ষার্থীকে মারধরের পর পুলিশে দিয়েছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
ওই তিন শিক্ষার্থীরা হলেন- লোক প্রশাসন বিভাগের ৯ম ব্যাচের ও কুষ্টিয়ার মিরপুরের গোলাম রহমান জয়, ইংরেজী বিভাগের ১০ ব্যাচের ও পার্শ্ববর্তী আটঘরিয়া উপজেলার ষাটগাছা গ্রামের আবুল কালাম আজাদের ছেলে আসাদুল ইসলাম এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১১ তম ব্যাচের ও নাটোর জেলার বরাইগ্রাম উপজেলার নগর গ্রামের রেজাউল করিমের ছেলে আজিজুল হক। তারা তিনজন শহরের বাসষ্ট্যান্ড ও অনন্ত এলাকায় বাসা ভাড়া করে বসবাস করেন।
পাবিপ্রবি প্রক্টর ড. কামাল হোসেন জানান, মঙ্গলবার (০৪ এপ্রিল) দিবাগত রাতে আনুমানিক সাড়ে ১২ টার দিকে বঙ্গবন্ধু হলের বাবুর্চি কাম সুপারভাজার পলাশ ফোন করে বিষয়টি আমাকে অবহিত করেন। আমি তাৎক্ষনিক ছাত্র উপদেষ্টা ড. নাজমুল ইসলাম, হল প্রভোষ্ট ওমর ফারুককে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি। হলে গিয়ে দেখি সব ছাত্র রুম থেকে বের হয়ে এসে চিৎকার চেচামেচি করছেন। আমি তাৎক্ষনিক ভাবে পাবনা সদর থানার ওসিকে অবহিত করি। তিনি দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে সব ছাত্রকে যার যার রুমে পাঠিয়ে দিয়ে ওই তিন শিক্ষার্থীকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
তিনি আরও বলেন, ওই তিন শিক্ষার্থী শিবিরকর্মী কিনা আমরা নিশ্চিত হতে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, শিক্ষার্থীদের কথা না শুনে প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে শিবির হলেই যে তাকে বিনা কারণে মারধর করতে হবে, এমনটাতো হতে পারে না। অপরাধ করলে আইন আছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আছে, পুলিশ আছে, তারাই দেখবেন। ছাত্রলীগ বা সাধারণ ছাত্র মারধর করবেন, এটা কোনও ভাবেই হতে পারে না। আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে সাথে সাথেই একটি কক্ষে নিয়ে ওই তিন শিক্ষার্থীকে রক্ষা করি।
পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কৃপা সিন্ধু বালা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, রাত দেড়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর স্যার ফোন করে পুলিশের সহায়তা চান। তিনি জানান ক্যাম্পাসে শিবিরের কর্মী আটক করা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। তার ফোন পেয়ে আমরা সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখতে পাই, তিন শিক্ষার্থী রক্তাক্ত অবস্থায় রয়েছেন। পরে আমরা তাদের সেখান থেকে উদ্ধার করে পাবনা জেনারেল হাসপাতাল নিয়ে আসি। সেখানে তাদের চিকিৎসা চলছে। তদন্ত সাপেক্ষ তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, আমারা ওই তিন শিক্ষার্থীর নিজ নিজ থানায় ফোন করে তাদের পরিবার জামায়াত-শিবির বা জঙ্গি সংশ্লিস্ট কোনও রাজনীতির সাথে জড়িত কিনা খোঁজখবর নিয়েছি। আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারি নাই যে তারা এ ধরনের রাজনীতির সাথে জড়িত রয়েছেন কিনা। তিন ছাত্রের মধ্যে একজনের বাবা ইজি বাইক চালক, কৃষক ও আরেকজনের মা-বাবা অসুস্থ শয্যাশায়ী।
এ বিষয়ে পাবনা সদর থানার এসআই জসিম উদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাসে গিয়ে বঙ্গবন্ধু হলের ১২৭ নং রুম থেকে ওই তিন শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করা হয়। তাদেরকে বেদম পেটানো অবস্থায় পাওয়া যায়, সাথে সাথে তাদের উদ্ধার করে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে প্রাথামিক চিকিৎসা দেয়া হয়। তিনজনের মধ্যে একজনের অবস্থা আশংকাজনক হলে তাকে ভর্তি করে অন্য দুই জনেকে থানা হেফাজতে নিয়ে আসা হয়। এসময় তাদের নিকট একটি ডায়েরী পাওয়া যায়, সেখানে তেমন কিছুই লেখা নেই।
এদিকে থানা হেফাজতে দুই শিক্ষার্থী আসাদুল ইসলাম ও আজিজুল হকের সাথে কথা বললে তারা নিজেদেরকে শিবিরকর্মী নয় দাবি করে বলেন, আমাদের মুখে দাড়ি আছে এটা ঠিক। তবে আমরা শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত নই। রমজান মাস নামাজ কালাম সবাই পড়ে, আমাদের ক্ষেত্রে একই রকম।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তারাবির নামাজের পর ভুক্তভোগী তিন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে আড্ডা দিচ্ছিল। এসময় ছাত্রলীগ কর্মী আপেল, শেহজাদ, তোফিকসহ ১০-১২ জন তাদের কাছে এসে শিবির কিনা জানতে চান। পরে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা শহীদ মিনার থেকে হলে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফরিদুল ইসলাম বাবুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদেরকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের তিনটি রুমে নিয়ে স্ট্যাম্প, রড, হকিস্টিক, প্লাসসহ দেশীয় অস্ত্র দিয়ে নির্যাতন করা হয়। হাতুড়ি, জিআই পাইপ, তালা দিয়েও মারধর করেন।
এ ঘটনার পর থেকে ক্যম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুউল্লহকে দেখা যায়নি বলে দাবী সাধারণ শিক্ষার্থীদের। তবে তার মুঠোফোনেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। পাবিপ্রবি ছাত্রলীগ সভাপতি ফরিদুল ইসলাম বাবু নিজে এবং তার সংগঠনের কেউ এ ঘটনার সাথে জড়িত নয় দাবি করে বলেন, কারা ওই তিন শিক্ষার্থীকে মারপিট করেছে আমরা জানি না। তবে তারা যে শিবিরকর্মী এতে কোনও সন্দেহ নেই।
এক শিক্ষার্থীর বাবা আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমি ভ্যান চালয়ে জীবন জীবিকা চালাই। আমরা রাজনীতি বুঝি না। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছি। এখন যদি শিবির বলে মারধরকরে, এর চেয়ে দুঃখের আর কিছুই নেই। আমার এলাকায় গিয়ে খোঁজখবর নিলেই এর সত্যতা পাবেন আপনারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা নাজমুল হোসেন বলেন, প্রক্টর ড. কামাল হোসেনের মাধ্যমে খবর পেয়ে আমি ক্যাম্পাসে এসেছিলাম। পরে ওই শিক্ষার্থীদের আটক অবস্থায় দেখি। তাদের কাছে থেকে শিবিরের রিপোর্ট বই, ব্যক্তিগত ডায়েরী এবং কিছু মোবাইল ও সিম উদ্ধার করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট ডা. মো. ওমর ফারুক বলেন, প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টার ফোন পেয়ে হলে এসে ওই শিক্ষার্থীদেরকে দেখতে পাই। তারা হলের শিক্ষার্থী নয়, ক্যাম্পাসের বাহিরে থাকে। তারা নিজেরা শিবির বলে স্বীকারোক্তি দিলে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
এ বিষয়ে পাবনা পুলিশ সুপার (এসপি) আকবর আলী মুনসী বলেন, খবর পেয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর নির্যাতিতরা যদি অভিযোগ দেয়, তাহলে তদন্ত করে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ