জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ তারেক চৌধুরীর বিরুদ্ধে গবেষণা জালিয়াতি ও সহকর্মীর সঙ্গে অশোভন আচরণের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
আজ বৃহস্পতিবার অভিযোগকারী ও বিভাগটির অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব বিষয় নিশ্চিত করেছেন। এর আগে, গত বছরের ২৩ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার বরাবর লিখিত অভিযোগ পত্র জমা দেন তিনি।
অভিযোগ পত্রে বলা হয়, ২০১১ সালে দর্শন বিভাগের একাডেমিক জার্নাল কপুলা (Copula) থেকে ‘ঈশ্বরের স্বরূপ প্রসঙ্গে ধর্মীয় ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি: একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন অধ্যাপক মুহাম্মদ তারেক চৌধুরী। ওই প্রবন্ধটিতে তিনি অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম এর পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস ‘থেলিস থেকে হিউম’ গ্রন্থের ৩৩, ৩৪, ৬৩, ৬৪, ১০৪, ১০৫, ১৩০, ১৩১, ১৪২, ১৪৩, ২৫১, ২৬৯, ২৯৬, ৪৩৮, ৪৫০, ও ৪৫১ পৃষ্ঠা থেকে ১৩ শ ৪৩ শব্দ জালিয়াতি করেছেন। যা তার মূল প্রবন্ধের প্রায় ১৯ শতাংশ। যেখানে নিয়মানুযায়ী একটি গ্রন্থ থেকে মাত্র ২ শতাংশ নেওয়া যায়। অথচ, তারেক চৌধুরী এই গবেষণা প্রবন্ধটি ব্যবহার করে বিভাগের অধ্যাপক পদে পদোন্নিত লাভ করেন বলে দাবি করেন অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ।
এছাড়া, তারেক চৌধুরী তার ওই প্রবন্ধে অধ্যাপক অর্জুন বিকাশ চৌধুরী রচিত মডার্ন বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড থেকে ২০০৩-২০০৪ সালে প্রকাশিত ভারতীয় দর্শন গ্রন্থের ১১৬-১১৭ পৃষ্ঠা থেকে ৭২ শব্দ এবং প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্ত রচিত ব্যানার্জি পাবলিশার্স থেকে ২০০৭ সালে প্রকাশিত ‘পাশ্চাত্য দর্শনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আধুনিক যুগ’ গ্রন্থের ৯৮-১০২ পৃষ্ঠা থেকে ৩৭৯ শব্দসহ প্রায় ২ হাজার ২ শব্দ চুরি করেছেন বলে অভিযোগ পত্রে বলা হয়েছে। যা শতকরা হিসাবে ২৯ শতাংশ। এছাড়া, তিনি প্রবন্ধটিতে ১৮৫ শব্দ কোট (quote) করেছেন।
অভিযোগ পত্রে আরও দাবি করা হয়, অধ্যাপক মুহাম্মদ তারেক হিন্দু ধর্মে বর্ণিত ঈশ্বরের গুণাবলী সম্পর্কে লিখছেন ১৫৪ পৃষ্ঠায়। এই সব তথ্য রাধাগোবিন্দ নাথ থেকে যা ই. সি. ডিমোক (E.C. Dimock) রচিত দ্য প্লেস অব দ্য হিডেন মুন (The Place of the Hidden Moon) গ্রন্থের ফুট নোটে ১৩২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে। পুরো প্রবন্ধে আরও যেসব বিষয় অধ্যাপক তারেক চৌধুরী লিখেছেন তার উৎস নির্দেশে ব্যর্থ হয়েছেন বলে অভিযোগ পত্রে বলা হয়। অধ্যাপক তারেক সেসবও চুরি করে থাকতে পারেন বলে দাবি করেন অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ।
এছাড়াও অভিযোগ পত্রে অধ্যাপক মুহাম্মদ তারেকের বিরুদ্ধে বিভাগের সহকর্মীদের সঙ্গে অশোভন ও অশিক্ষিতসুলভ আচরণ করার অভিযোগ তোলা হয়। এতে বলা হয়, বিভাগের গবেষণা সেমিনারে এমফিল-পিএইচডি গবেষকদের ‘চোর’ বলে রায় দেন অধ্যাপক তারেক চৌধুরী। এমনকি ২০২১ সালে এক সভায় বিভাগের আরেক শিক্ষক মোহাম্মদ উল্লাহকে ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ বলে ব্যঙ্গ করেন অধ্যাপক তারেক। এছাড়া, তিনি বিভিন্ন সময় মোহাম্মদ উল্লাহকে ‘বেয়াদব’সহ নানা আক্রমণাত্মক কথা বলেন। সর্বশেষ, তিনি গত বছরের ২০ মার্চ দর্শন বিভাগের সেমিনার কক্ষে অধ্যাপক ফরিদ আহমেদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন বলে অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অভিযোগ পত্রে আমার সবগুলো দাবি সত্য। শুধু তাই নয়, উনার আরো একটি প্রবন্ধে ৬০ শতাংশ লেখা কপি করার তথ্য পাওয়া গেছে। যা ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়েছে, এটা অভিযোগ পত্রে না থাকায় এখন বলতে চাচ্ছি না। উনি একজন শিক্ষক হয়ে কিভাবে আরেকজন শিক্ষককে মারতে যেতে পারেন? শুধু মোহাম্মদ উল্লাহ নয়, আমার সাথেও অশোভন আচরণ করেছেন তিনি। অথচ, আমি তারও শিক্ষক। একান্ত নিরুপায় হয়ে নিরাপত্তাহীনতা থেকে আমি এই অভিযোগ দাখিল করেছি। প্রশাসন এখন যা ব্যবস্থা নেওয়ার নিবে।
দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, ফরিদ আহমেদ স্যারের দেওয়া অভিযোগ পত্রে আমার বিষয়ে কিছু কথা লেখা আছে সেগুলো সত্য। আমার সাথে বিভিন্ন সময়ে অশোভন আচরণ করেছেন অধ্যাপক তারেক চৌধুরী। বাকি বিষয়ে আমি জানি না। প্রশাসন যদি এবিষয়ে আমার কোন বক্তব্য জানতে চায় তাহলে আমি তাদেরকে সহযোগিতা করবো।
তবে অধ্যাপক ফরিদ আহমেদের তোলা অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও বিদ্বেষপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক মুহাম্মদ তারেক চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমার যে প্রবন্ধটির বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে তা প্রকাশের সময় এডিটরের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ফরিদ। যদি কোন জালিয়াতি থাকতো তাহলে প্রকাশের সময় কেন তিনি অনুমতি দিলেন। আর অভিযোগ পত্রে তিনি বারবার লিখেছেন আমি এতো এতো (শব্দের সংখ্যাকে ইঙ্গিত করে) শব্দ চুরি করেছি কিন্তু শব্দ-তো কখনো চুরি হয় না। শব্দ কি আমি বানাবো? একজন লেখকের গ্রন্থের শব্দের সাথে আমার লেখা শব্দের মিল থাকতেই পারে। আর উনি যেসব বাংলা প্রবন্ধ থেকে চুরি করা হয়েছে বলে দাবি করছেন আমি সেসব থেকে লিখি নাই। আমার প্রবন্ধের তথ্যসূত্র ছিল ইংরেজি ভাষার লেখা থেকে নেওয়া। আমি সেগুলোকে রেফারেন্স হিসেবে দেখিয়েছি। ওনার অভিযোগ ভিত্তিহীন।
সহকর্মীর সঙ্গে অশোভন আচরণের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক তারেক চৌধুরী আরও বলেন, আমি যদি কোন সহকর্মীর সঙ্গে অশোভন আচরণ করি তাহলে অভিযোগ তো ওই সহকর্মীর করার কথা। কিন্তু অধ্যাপক ফরিদ কেন অভিযোগ করলেন? আবার তিনি বলেছেন তার (অধ্যাপক ফরিদ) সাথেও অসদাচরণ করা হয়েছে। কিন্তু কি অসদাচরণ করেছি তার বিষয়ে কোন তথ্য নাই। এ থেকে বুঝা যায় উনি আমার প্রতি বিদ্বেষ থেকে এসব অভিযোগ করেছেন।
মূলত, অধ্যাপক ফরিদ নিজেই নানা অনিয়মের সাথে জড়িত বলে দাবি করেছেন অধ্যাপক তারেক চৌধুরী। তিনি বলেন, অধ্যাপক ফরিদ ৭ বছরের শিক্ষা ছুটি নিয়ে বিনানুমতিতে ১১ বছর কাটিয়েছেন। বিদেশ থেকে একাধিক মাস্টার্স ও পিএইচডি করেছেন কিন্তু বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরি, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি কোথাও কোন থিসিস জমা দেননি। অনেকে সন্দেহ করেন যে তার থিসিসগুলো চেক করলে ব্যাপক জালিয়াতি বেরিয়ে পড়তে পারে এজন্য জমা দেন না। আজ পর্যন্ত তিনি সুপারভাইজার হিসেবে এম এ, এম ফিল বা পিএইচ ডি পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থীরও দায়িত্ব পালন করেননি। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসও নেন না তিনি। বিভাগ থেকে তার বিরুদ্ধে প্রশাসন বরাবর একাধিকবার অভিযোগ দেওয়া হলেও ক্ষমতা ব্যবহার করে পার পেয়ে যান তিনি।
এদিকে, গত ১ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ এক সিন্ডিকেট সভায় অধ্যাপক তারেক চৌধুরীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ আমলে নিয়ে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জাবি কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানকে সভাপতি করে গঠিত এ কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক মো. শাহেদুর রশীদ ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ কাহিলি। এছাড়া, কমিটিতে সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ২) এ বি এম আজিজুর রহমান। ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে এ কমিটিকে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ ঘটনায় আমাকে তদন্ত কমিটির সভাপতি করা হয়েছে এখন মাত্র আপনার কাছ থেকে শুনলাম। আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। এ বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার পর বিস্তারিত বলতে পারবো।
জাবির দর্শন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, ঘটনাটি শুনেছি, তবে বিভাগের সভাপতি হিসেবে এসব বিষয়ে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না। এটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দেখবে।
বিডি প্রতিদিন/এমআই