যে নদীতে শুষ্ক মৌসুমে একসময় লঞ্চ, স্টিমার, ছোটবড় অসংখ্য নৌযান চলাচল করতো আজ সেই নদীর উপরে দিয়ে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যান প্রতিক।
পলি পড়া নদীর বুক এখন বিস্তৃর্ণ ধান ক্ষেত। খরস্রোতা নদী প্রাণ হারিয়ে বিরূপ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে তা সুনামগঞ্জের মরা সুরমা নদী না দেখলে বুঝা যাবে না।
উজান থেকে আসা পলিমাটি শত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীটিতে চর জেগে ভরাট হয়েছে। নদীর কোনো স্থানে বোরো ধানের রোপণ করেছেন স্থানীয়রা। ধানের বিস্তৃর্ণ জমি রূপকথাকেও হার মানায়। মাইলের পর মাইল নদীতে এখন ধান ফলে।
শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বন্ধ রয়েছে অভ্যন্তরীন নৌযান চলাচল। নৌ চলাচল না করতে পারায় পরিবহন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভোগান্তিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার মানুষ। এদিকে নদী শুকানোর ফলে দেশীয় প্রজাতির মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। প্রজননের অভাবে বিলুপ্তির পথে বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ। এছাড়াও সেচ কাজে পানির সংকটে পড়েছেন কৃষকরা। ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ কার্যক্রম। প্রকৃতির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে মরা সুরমাসহ জেলার বিভিন্ন নদীর তলদেশ খননের দাবি করেছেন ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষসহ হাওর সংশ্লিষ্ট সংগঠন।
উল্লেখ্য, সুনামগঞ্জের প্রধান নদী সুরমা মেঘালয় থেকে এসে পূর্ব-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। সুরমার শাখা নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মরা সুরমা বা পুরাতন সুরমা, ধনু, বৌলাই, রক্তি, পান্ডার খাল, গোয়ারাইর খাল, মহাসিং, কালনী, মাছুখালী ইত্যাদি। পলি জমে ভরাট হতে হতে বদলে গেছে একসময়ের স্রোতস্বিনী মরা সুরমা নদীটির দৃশ্যপট। বর্ষায় কোনোমতে নাব্যতা টিকে থাকলেও হেমন্তে নদীটি হয়ে পড়ে মৃতপ্রায়, যে কারণে সুরমার মূলধারা এখন সাধারণ মানুষের কাছে ‘মরা সুরমা’ হিসেবে পরিচিত।
দিরাইর রাজানগর ইউনিয়নের গচিয়া থেকে নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষ্ণপুর পর্যন্ত নদীর অনেক জায়গায় পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার নারায়ণপুর গ্রাম থেকে দিরাই উপজেলার শরিফপুর পর্যন্ত ১০-১২ কিলোমিটার নদী পলিতে ভরাট রয়েছে। পাহাড়ি ঢলে পলি জমে পুরাতন সুরমা নদী নাব্যতা হারিয়ে এখন মরণ দশায় পরিণত হয়েছে। একসময় এই নদীগুলো উত্তাল যৌবনা ছিল, এখন নদীর অনেক অংশ শুকিয়ে হেমন্তে গোচারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনোটি হারিয়ে গেছে হাওরের বোরো জমিতে। নদী ভরাট ও সঙ্কুচিত হওয়ার কারণে নদীকে কেন্দ্র করে আবহমান কাল থেকে হাওরাঞ্চলে গড়ে ওঠা নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। এতে মানুষের ভোগান্তির পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গিয়ে হাওরের ওপর দিয়ে অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট নির্মাণ হচ্ছে। ফলে হাওরের পরিবেশ, প্রতিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এতে মাছের উৎপাদন ও বংশবিস্তার ধ্বংসের পথে। হেমন্তে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় ধান চাষেও সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছের স্থানীয় কৃষক ।
উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের জামলাবাদের ৭০ ঊর্ধ্ব বয়সী সমরাজ আলী বলেন, আমি যখন যুবক ছিলাম শীত মৌসুমে তখন এই নদী দিয়ে বড় বড় জাহাজ চলাচল করতো। নদীতে বড়শী ও জাল দিয়ে বড় বড় মাছ শিকার করেছি আমরা।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মহিবুর রহমান বলেন, পাহাড় থেকে নেমে আসা পলিতে নদীর তল ভরাট হয়ে গেছে। উজানে কয়েকটি স্থান বাঁধ হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে নদী মরে যায়। ফলে নানা কারণে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। নদীর বৈচিত্র রক্ষায় নদী খননের দাবি করেন তিনি।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় বেশির ভাগ নদী ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়েছে। শীতের মৌসুমে অনেক নদী মরে যায়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে জেলার সকল নদীর তলদেশ খননের দাবি করে আসছে হাওর বাঁচাও আন্দোলন। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করার তাগাদা দেন তিনি।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, মরা সুরমাসহ সুনামগঞ্জের ১৩ নদীর ৩০০ কিলোমিটার ড্রেজিং কাজের জন্য একটি প্রস্তাবনা দাখিল করা হয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে। প্রকল্পগুলো অনুমোদন হলে নদীর খনন কাজ শুরুর কথা জানান তিনি।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন