চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের গুলি করা অস্ত্রধারীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রকাশ্যে সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা করেন পুলিশ। বরং প্রকাশ্যে তারা ঘুরে বেড়ালেও ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর আত্মগোপনে রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে না পারার কারণে উদ্ধার করা যায়নি অবৈধ অস্ত্রও। যার কারণে চলমান পরিস্থিতিতে অবৈধ অস্ত্রগুলো ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে সন্ত্রাসীরা-এমন আশঙ্কা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, অস্ত্রধারীদের আইনেও আওতায় আনার জন্য পুলিশের যা যা করণীয় তার সবকিছু করা হবে। আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। আমাদের সবকিছু ঢেলে সাজানো হচ্ছে। কোন অস্ত্রধারী ছাড় পাবে না। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত সকল ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, ছবিসহ সমস্ত কিছু আমরাও পেয়েছি, তদন্ত চলছে। দ্রুত তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। এসব ঘটনায় ভিকটিমের পরিবারগুলো মামলা করেছে। আমাদের কমিশনার মহোদয়ের স্পষ্ট নির্দেশনা কোন অপরাধীকে ছাড় দেওয়া হবে না।সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনা দেখেছি। এগুলোর ছবি ও ভিডিও দেখে অস্ত্র উদ্ধার করা দরকার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি করার জন্য এবং জানমালের নিরাপত্তার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এগুলো উদ্ধার করা দরকার। না হলে এগুলো হাতবদল হতে পারে। আবার অপরাধমূলক কাজে অবৈধ এসব অস্ত্রের ব্যবহার হতে পারে।
এদিকে ১৮ জুলাই বহদ্দারহাটে গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী তানভীর ছিদ্দিকীর চাচা মোহাম্মদ পারভেজ বাদী হয়ে চা›গাঁও থানায় একটি মামলা করেন। গত ১৭ আগষ্ট থানায় এ মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মহিউদ্দিন ফরহা, আওয়ামী লীগ কর্মী মো: জালাল, যুবলীগ কর্মী মো: ফরিদ, এইম এম মিঠু, মো: ফিরোজ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মো: দেলোয়ার এবং যুবলীগ কর্মী মো: জাফরকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন, চান্দগাঁও ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো: এসরারুল হককেও আসামি করা হয়েছে।
জানা যায়, চলতি বছরের ১৬ জুলাই নগরীর মুরাদপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর প্রকাশ্যে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে মুরাদপুর এলাকার যুবলীগ ক্যাডার ফিরোজ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ক্যাডার দেলোয়ার, যুবলীগের এইচএম মিঠু ও জাফর উল্লাহকে। ওই সময় আরও একজনকে গুলি করতে দেখা গেলেও তার পরিচয় পাওয়া যায়নি। এরপর ১৮ জুলাই বহদ্দারহাট এলাকায় শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিলে সেখানে শিক্ষার্থীদের গুলি ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে চান্দগাঁও থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মহিউদ্দিন ফরহাদ। তার হাতে ছিল রিভারভার। এছাড়াও তার সঙ্গে রিভারভার হাতে আওয়ামী লীগের কর্মী মো: জালাল ও শর্টগান হাতে ছিলেন তৌহিদ। এছাড়া একজনকে শর্টগান দিয়ে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে। শেখ হাসিনার পতনের একদিন আগে ৪ আগষ্ট নগরীর নিউ মার্কেট, তিনপুলের মাথা, স্টেশন রোড ও আসকারদিঘী এলাকায় কমপক্ষে ছয়জন অস্ত্রধারীকে ছাত্র-জনতার উপর গুলি করতে দেখা গেছে। তারমধ্যে জামালখান ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের নেতৃত্বেথাকা এক যুবককে শর্টগান হাতে দেখা গেছে। একটি ভিডিওতে দেখা যায় কাউন্সিলর সুমন ঐ যুবককে সামনে এগুতে বলছেন। এই সময় কয়েকটি গুলির শব্দ শোনা যায়। নিউ মার্কেট এলাকায় সিটি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মো. ফয়সালকে রিভলবার নিয়ে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে। ওই ঘটনায় আহত ১৬ জন শিক্ষার্থী। একই সময়ে মোগলটুলি ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা মোস্তফা কামাল টিপু ও মো. ইকবালকে অস্ত্র হাতে দেখা যায়। পরে ওই স্থান আওয়ামী লীগরে র্কমীরা দখলে নেন। বিকেল ৫টা র্পযন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষের পর ফের ওই এলাকার দখল নেয় ছাত্রজনতা। নিউমার্কেট ছাড়াও শহরের জিইসি মোড়, ২ নম্বর গেটও দখলে রেখেছে তারা। ওই দিন বিকেল ৫টা র্পযন্ত বিভিন্ন জায়গায় সংর্ঘষে ২৫ জন গুলবিদ্ধি হয়েছেন। আহত ৭৫ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমকে) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পৃথক এ তিনটি ঘটনায় চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াসিম আকরাম, কাঠমিস্ত্রি ফারুক (পথচারী), ওমরগণি এমইএস কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ফয়সাল আহমেদ শান্ত, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তরুয়া, তানভীর আহমেদ (১৯) ও বহদ্দারহাটে মুদি দোকানের কর্মচারী সাইমন হোসেন (১৯) নিহত হয়েছে। এছাড়াও আহত হয়েছে প্রায় আড়াই শতাধিক, যাদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অনেকে এখনো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। তিন দিনে কমপক্ষে ১৫ জন অস্ত্রধারী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে।
বিডি প্রতিদিন/এএম