রেড কোরাল কুকরি। বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিরল প্রজাতির একটি সাপ। ধারণা করা হচ্ছিল এই প্রজাতির সাপ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে এমনই একটি সাপ উদ্ধার করা হয়েছে দেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড় থেকে। এর নাম রেড কোরাল কুকরি হলেও স্থানীয়ভাবে তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘কমলবতি’।
বিরল প্রজাতির এই সাপটি ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যে কদাচিৎ দেখা মিললেও দেশে এবারই প্রথম এমন সাপের দেখা পেয়েছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, যেহেতু সাপটি বিরল প্রজাতির তাই এটি নিয়ে গবেষণা খুব একটা বেশি হয়নি। স্বল্প মাত্রার বিষাক্ত বলা হলেও এ নিয়ে বিশদ গবেষণার প্রয়োজন আছে বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ঝালইশালসিরি ইউনিয়নের কালিয়াগঞ্জ বাজারের পাশে গত সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি) যন্ত্র দিয়ে নির্মাণাধীন একটি বাড়ির মাটি খোঁড়ার সময় নিচ থেকে বেরিয়ে আসে বেশ কয়েকটি সাপ। তখনও কারও ধারণা ছিল না এখানেই মিলবে সারা বিশ্বের বিরল প্রজাতির গবেষণাময় প্রাণী রেড কোরাল কুকরি সাপ।
মাটির নিচ থেকে উদ্ধারের পর দেখা যায় সাপটি যন্ত্রের আঘাতে মারাত্মক আহত হয়েছে। এ অবস্থায় সেটিকে চিকিৎসা ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্য রাজশাহী পাঠানো হয়েছে। সাপটি বর্তমানে রাজশাহীর পবা উপজেলার সাপ উদ্ধার ও সংরক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। সেখানেই রেখে চলছে চিকিৎসা ও সেবা শুশ্রুষা।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের প্রধান প্রশিক্ষক রাজশাহীর বোরহান বিশ্বাস জানান, এ যাবৎকালে দেশের শুধু পঞ্চগড় জেলাতেই গবেষকরা মাত্র দু’টি এ প্রজাতির সাপের দেখা পেয়েছেন। ফলে সাপের তালিকায় নতুন একটি নাম যুক্ত হবে এতে। গবেষণাতেও আসবে নতুন মোড়। এই সাপটির নাম হচ্ছে রেড কোরাল কুকরি। বাংলায় এর কোনো নাম নেই।
তবে গবেষক হিসেবে তিনি এর নাম দিয়েছেন ‘কমলাবতি’। স্থানীয়রা সাপটিকে এই নামেই এখন ডাকছেন। ১৯৩৬ সালে প্রথম ভারতের উতরখণ্ডে দেখা যায়। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া এই সাপটি হলো ২২তম। এর আগে আর কোথাও এমন সাপ দেখা যায়নি। এখান থেকেই বোঝা যায় এই প্রজাতির সাপ কতটা বিরল।
বাংলাদেশের পঞ্চগড়ের বোদা এবং তেঁতুলিয়ায় এই সাপটি দেখা গেছে। এটি বাংলাদেশের সাপের তালিকায় যুক্ত হবে এবং গবেষণাময় হবে। এটা অবশ্যই একটা ভালো খবর। এই সাপটিকে অল্প বিষধর বলা হয়। তবে এটা থেকে যদি আমরা ভেনম সংগ্রহ করতে পারি তাহলে গবেষণা করে বুঝতে পারবো এটা কতটা বিষধর। যোগ করেন রাজশাহীর বোরহান বিশ্বাস।
বোরহান বিশ্বাস বলেন, এই সাপটা দেখতেও যেমন সুন্দর তেমন এর জীবন প্রাণালীও চমৎকার এবং অন্য সাপের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এটা মাটির নিচে থাকতে পছন্দ করে। দিনের বেলায় একদমই বের হয় না। যেখান থেকে সাপটি উদ্ধার করা হয়েছে সেখানকার মানুষরা জানিয়েছেন এটিকে দেখা যেত কিন্তু খুবই কম।
আর আমি যতদূর গবেষণা করে দেখেছি-পঞ্চগড় ছাড়া অন্য কোনো জেলায় এই সাপ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এটা দেশের তালিকায় ১০৩তম সাপ হবে। বিরল প্রজাতির এই সাপ মূলত হিমালয় অববাহিকায় থাকে। পাথর বা মাটির নিচে এদের বসবাস। সাধারণত সব সময়ই তারা লুকায়িত অবস্থায় থাকতে পছন্দ করে।
এদিকে, গবেষকরা বলছেন, এ ঘটনা থেকেই প্রমাণ হয় বিরল প্রজাতির সাপ দেশে এখনও বিদ্যমান। শুধু তাদের আবাস চিহ্নিত করে সেটি বিনষ্ট হওয়া থেকে বিরত থাকতে পারলে হয়তো এদের বিলুপ্ত হওয়া থেকে বাঁচানো যাবে।
সাপটি দেখতে রাজশাহী গিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল খান। তিনি জানান, সারাবিশ্বে এই সাপ উদ্ধারের মধ্যদিয়ে বিশ্বে মাত্র ২২টি এ প্রজাতির সাপের দেখা পেলেন গবেষকরা। উদ্ধারকৃত সাপ কিছুটা সুস্থ হলে সেটিকে চট্টগ্রামে নিয়ে ভেনম রিসার্স সেন্টারে রাখা হবে।
সেখানেই সাপটিকে নিয়ে বিশদ গবেষণা হবে। আর আমরা ভেবেছিলাম এই সাপটি বিলুপ্ত। তবে যেহেতু দেশের পঞ্চগড়ে এই বিরল প্রজাতির সাপের দেখা মিলেছে, সেহেতু বলা যায় সেখানে এমন প্রজাতির সাপ আরও থাকতে পারে। এছাড়া এটি একটি সাইন যে, বাংলাদেশে এমন বিলুপ্ত বা বিরল প্রজাতির আরও অনেক সাপ আছে। শুধু তাদের আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে এরা বিলুপ্ত হয়েছে। তাই আমাদের মনযোগ দিতে হবে যাতে গবেষণা করে এই সাপগুলো কোথায় থাকে সেই জায়গাগুলো নষ্ট না করা হয়।
অধ্যাপক মনিরুল খান আরও বলেন, এই রেড কোরাল কুকরি সাপ সাধারণত লালচে উজ্জ্বল কমলা রঙের হয়। এই প্রজাতির সাপ নিশাচর এবং বেশির ভাগ সময় মাটির নিচেই থাকে। যে সাপটি পাওয়া গেছে, তার দৈর্ঘ্য দেখে বোঝা যায় এটি একটি পূর্ণ বয়স্ক সাপ। সাধারণত এটি খুব বেশি লম্বা হয় না, মাঝারি আকৃতির হয়ে থাকে।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন