বুধবার, ১৮ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া প্রতারক চক্রের দুজন গ্রেফতার

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘কিউআর কোড জেনারেটর’ সফটওয়্যারের মাধ্যমে চাকরি প্রার্থীর নাম-ঠিকানা সংবলিত একটি ‘কিউআর কোড’ তৈরি করে ভুয়া নিয়োগপত্রে সেটি স্থাপন করে একটি প্রতারক চক্র। এরপর প্রার্থীকে বলা হয়, ‘কিউআর কোড স্ক্যানার’ দিয়ে আপনার নিয়োগপত্রটি সঠিক কি-না যাচাই করুন। প্রার্থী যখন তার মোবাইলের কিউআর কোড স্ক্যানার দিয়ে চেক করে তখন সেখানে নিজের তথ্য দেখায় এবং প্রার্থী চুক্তি অনুযায়ী সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করেন। পরবর্তীতে এই নিয়োগপত্র নিয়ে চাকরিপ্রত্যাশীরা সংশ্লিষ্ট দফতরে গেলে জানতে পারেন নিয়োগপত্রটি ভুয়া। এর মধ্যে প্রতারকরা তাদের ব্যবহৃত ফোনগুলো বন্ধ করে ফেলত। এভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া একটি প্রতারক চক্রের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। সোমবার রাতে রাজধানীর দারুস সালাম থানার আনন্দ নগর এলাকা থেকে এই চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন- মূলহোতা মো. মোশারফ হোসেন ও তার সহযোগী মো. জিয়া উদ্দিন।

এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত তিনটি মোবাইল ফোন, সাতটি সিম কার্ড, বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার বেশ কিছু ভুয়া প্রশ্ন, প্রবেশপত্র ও কিউআর কোড সংবলিত নিয়োগপত্র জব্দ করা হয়েছে। ডিবি বলছে, নিয়োগপত্রে কিউআর কোড যুক্ত করে চাকরি প্রত্যাশীদের বোকা বানিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া এ চক্র প্রতি সপ্তাহে ৬০ জন চাকরি প্রত্যাশীকে টার্গেট করত।

এদিকে, গতকাল বনানী থানায় দায়ের করা মামলায় তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠানো হলে আদালত এক দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা বিপুল সংখ্যক মানুষের সঙ্গে এ ধরনের প্রতারণা করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতানোর কথা শিকার করেছেন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরও অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে। তাদের সঙ্গে আর কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে বলে ডিবি সূত্র জানায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গার্মেন্টসে চাকরি করার সময় এক প্রতারকের মাধ্যমে চাকরিতে নিয়োগের নামে প্রতারণা করার বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে মোশারফ হোসেন। দুই বছর ধরে সহযোগী জিয়া উদ্দিনকে নিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন। প্রতারণার কৌশল হিসেবে সব সময় বিভিন্ন দফতরের ছোট ছোট পোস্টে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখাতেন। তাদের ফাঁদে যে চাকরি প্রত্যাশীরা পা দিত, প্রথমে তাদের কাছ থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে জীবনবৃত্তান্ত, পাসপোর্ট সাইজ ছবি, স্বাক্ষরের স্ক্যান কপি ও অন্যান্য সব ডকুমেন্ট নিত। পরে এসব তথ্যের মাধ্যমে একটি ভুয়া প্রবেশপত্র তৈরি করে প্রার্থীর ই-মেইলে পাঠাত। এরপর বিকাশ/রকেটের মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করে ভাইভার জন্য মনোনীত হয়েছেন বলে জানাত। কিছুদিন পরে ভুয়া নিবন্ধিত সিম কার্ডের মাধ্যমে অপর এক ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে পুনরায় কল করে মেডিকেল ও অন্যান্য খরচ বাবদ কিছু টাকা বিকাশ/রকেটের মাধ্যমে দিতে বলে। সেই টাকা পাওয়ার পর প্রতারক চক্রটি একটি কিউআর কোড সংবলিত ভুয়া নিয়োগপত্র তৈরি করে।

একই কৌশলে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটে কর্মরত আনসার সদস্য মো. এছাহাক আলীর ছেলে ও ভাগিনাকে সেনাবাহিনীর স্টোরকিপার পদে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিকাশের মাধ্যমে ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। প্রতারণার শিকার হয়েছেন বুঝতে পেরে গত ৫ মে বনানী থানায় মামলা করেন এছাহাক আলী। মামলায় উল্লেখ করা হয়, চাকরি পাইয়ে দিতে ৩ লাখ টাকা দাবি করা হয়। প্রথমে বিকাশের মাধ্যমে ২০ হাজার টাকা পাঠানোর পর ধাপে ধাপে আরও টাকা চাওয়া হয়। একপর্যায়ে কিউআর কোড দেওয়া নিয়োগপত্র পাঠিয়ে টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। তখন সেনাবাহিনীর একজন মেজরকে ওই নিয়োগপত্র দেখিয়ে, জানতে পারেন জালিয়াতির শিকার হয়েছেন।

ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের এডিসি মো. নাজমুল হক বলেন, রিকশাচালক, বাসের হেল্পার, নিরাপত্তাকর্মীসহ নিম্ন আয়ের মানুষের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলত চক্রের সদস্যরা। একপর্যায়ে নিজেদের বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে, ওই নিম্ন আয়ের মানুষদের কোনো স্বজন সরকারি চাকরি নিতে চাইলে যোগাযোগ করতে বলে। পরে কোনো দফতরে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে, চক্রের সদস্যরা ওই মানুষদের ফোন করে, চাকরি প্রত্যাশী থাকলে দ্রুত যোগাযোগ করতে বলে।

তাদের ফাঁদে কেউ পা দিলে, চাকরি প্রত্যাশীকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন সরবরাহ, মেডিকেল করা, দফতরের অন্য কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করা এবং কিউআর কোড সংবলিত ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে ধাপে ধাপে টাকা আত্মসাৎ করত। একপর্যায়ে ভিকটিম চাকরিতে যোগদানের কথা বললে লাপাত্তা হয়ে যেত প্রতারক চক্রটি। চাকরি প্রত্যাশীরা নিজেরা অনৈতিক পথ অবলম্বন করে প্রতারণার শিকার হওয়ায় কেউ আইনগত ব্যবস্থা নিত না। ফলে দীর্ঘদিন ধরে চক্রটি মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করার সুযোগ পেয়ে আসছিল।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর