রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

সীমান্ত অঞ্চলে হেরোইন ব্যবসায় জামায়াত

রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সীমান্ত অঞ্চলে মাদক ব্যবসার নেপথ্যে রয়েছে জামায়াত। প্রায় তিন দশক ধরে এ অঞ্চল ফেনসিডিল পাচারের রুট হিসেবে গড়ে উঠেছে। ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠনের পর সীমান্ত অঞ্চলে হেরোইন ব্যবসায় সম্পৃক্ত হয় জামায়াত। সংগঠনটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তাদের যোগাযোগ রক্ষা করে। তবে প্রত্যক্ষভাবে তারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যানুযায়ী, জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সাবেক আমির সাইদুর রহমান ২০০৬ সালের পর এই সীমান্তেই হেরোইন ব্যবসায় অর্থলগি্ন করেন। ১৯৮৯ সালে জামায়াত হবিগঞ্জ জেলা আমিরের পদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হলেও গোদাগাড়ীতে ব্যবসায় তার অর্থলগি্ন করা হয় জামায়াত চ্যানেলেই। ব্যবসায় অর্জিত অর্থ মূলত অস্ত্র ও বিস্ফোরকের মজুদ বাড়াতে ব্যবহার করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, নদীয়া ও মালদহ জেলায় সাইদুরের সময়েই জেএমবির তৎপরতা শুরু হয়। জামায়াত-জেএমবি যৌথ সিন্ডিকেটের হেরোইন ব্যবসার টাকায় সোহেল মাহফুজ ওই অঞ্চলে জঙ্গিদের সংগঠিত করতে কাজ শুরু করে।

২০০৪ সালে ওই সিন্ডিকেটের সঙ্গে হেরোইন ব্যবসায় সক্রিয় ছিলেন এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সাইদুরের পরিচয়ে বেশ কয়েকজন নারী নিয়মিত ওপার যেতেন, আবার আসতেন। তবে কাউকে কখনো বোরখাপরা অবস্থায় দেখেননি তিনি। অবৈধ এ ব্যবসার সূত্র ধরে দুই দেশের জঙ্গিদের এপার-ওপার যাতায়াতের সুবিধা হয়। গোদাগাড়ী উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ হেরোইন ব্যবসার মূল ঘাঁটি। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের রানীনগর থানার সীমান্তবর্তী ডাঁড়াকাটি গ্রাম থেকে সম্প্রতি অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেফতার আঙ্গুর শেখ (৪৩) এ এলাকারই বাসিন্দা। প্রথমে হেরোইন ও পরে অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আঙ্গুর। চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা জানান, ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে আঙ্গুর পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। আঙ্গুরের ঘনিষ্ঠ ছিল শফিকুল ইসলাম। ২০০৮ সালে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয় মালদহে। এর পরই চর আষাড়িয়াদহ থেকে বিস্ফোরক ও ডেটোনেটরের একটি চালান উদ্ধার করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোদাগাড়ীর এক হেরোইন ব্যবসায়ী জানান, জামায়াতের স্থানীয় কর্মীদের এক বড় অংশ এ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে বড় নেতারা থাকেন আড়ালে। তিনি বলেন, সীমান্তে তাদের প্রভাবও অনেক বেশি। এ কারণে ওই সিন্ডিকেটের বাইরে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি জানান, হেরোইনের বিপুল টাকা থেকে ভাগ যায় পুলিশের কাছে। হেরোইনের টাকার ভাগ পুলিশের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত যায় গোদাগাড়ী থানার উপপরিদর্শক মেহেদীর মাধ্যমে। রাজশাহীর তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আবদুল হান্নান এ ব্যবসার টাকার ভাগ পুলিশের মধ্যে বাটোয়ারা করে দেন। তবে তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল হান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, পুলিশের মধ্যে ভাগবাটোয়ারার প্রশ্নই ওঠে না। গোদাগাড়ী থানার উপপরিদর্শক মেহেদীর সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এদিকে, গোদাগাড়ী পৌর মেয়র ও জেলা জামায়াতের প্রশাসনিক সেক্রেটারি আমিনুল ইসলাম জানান, হেরোইন ব্যবসার সঙ্গে জামায়াতের কেউ জড়িত নন। হেরোইন ব্যবসায়ীরা তাদের স্বার্থে যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তার আশ্রয়ে চলে যায়। 'আমরা হেরোইন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে জর্জরিত। আমাদের জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠে না।' জানা যায়, গোদাগাড়ীর মহিশালবাড়ী থেকে ২০০১ সালের পর হেরোইন ব্যবসায় জামায়াতের সম্পৃক্ততা তৈরি হয় এখানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুজিবুর রহমানের মাধ্যমে। পুরো এলাকায় জামায়াত সদস্যদের বাড়িতে বাড়িতে হেরোইন ব্যবসা চলে। পাশের রেলবাজার ও কোদালকাটি এলাকার চিত্রও অভিন্ন। সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী এবং বাংলাভাইয়ের আশ্রয়দাতাদের অন্যতম ব্যারিস্টার আমিনুল হকের প্রশ্রয় পেত এই হেরোইন ব্যবসা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর সংসদ সদস্য ও সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী হেরোইন ব্যবসা বন্ধের উদ্যোগ নিলে জামায়াত কৌশল বদল করে। তারা ওই নেতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন দলের কয়েকজন নেতাকর্মীকে। ফলাফল মেলে জামায়াতের সাবেক নেতা ওয়াজিউদ্দিন বিশ্বাস হন পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি। এরপর এলাকায় কোনো সমস্যা হয়নি জামায়াতের। গোদাগাড়ীর মাদক ব্যবসায়ী জহুরুল, সেলিম, আশরাফ, হুমায়ুন, মোফাজ্জল ও তোফাজ্জল গত বছর উপজেলায় সাঈদীর রায়ের পর নাশকতা ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় টাকার জোগান দেন। লোক সরবরাহ করে মাদক ব্যবসায়ী ডলার, শহীদুলসহ সিন্ডিকেটের একটি দল। তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন জামায়াত নেতা ও পৌর মেয়র আমিনুল ইসলাম। ২০১১ সালের ১০ আগস্ট হেরোইনসহ রাজশাহী মহানগরীর বোয়ালিয়া থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন গোদাগাড়ী পৌর এলাকার মাদারপুর গ্রামের আশরাফুল ইসলামের স্ত্রী জাহেদা বেগম। তাকে জামিনে ছাড়াতে পৌর মেয়র আমিনুল ইসলাম ২০ আগস্ট আদালতে একটি মিথ্যা সনদ দাখিল করেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেন, আটক জাহেদার সাত বছরের শিশুকন্যা পিয়া পানিতে ডুবে মারা গেছে। পরে আদালত জানতে পারেন, পৌর মেয়রের দেওয়া মৃত্যু সনদটি জাল ও ভুয়া। প্রকৃতপক্ষে শিশু পিয়া মারা যায়নি।

 

 

সর্বশেষ খবর