মঙ্গলবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বর্জ্যে দূষণের শিকার ধলেশ্বরী

নাজমুল হুদা, সাভার

বর্জ্যে দূষণের শিকার ধলেশ্বরী

ধলেশ্বরী নদী ধ্বংসের মহোৎসব চলছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলেমিশে নদীটির ধ্বংসযজ্ঞে মেতেছে। এর নেতৃত্বে রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক)। বিসিকের অধীনে পরিচালিত সাভারের হেমায়েতপুরের ‘চামড়া শিল্পনগরী’র সব ধরনের বিষাক্ত বর্জ্য ফেলা হয় ধলেশ্বরীতে। আর হেমায়েতপুরের পদ্মা মোড় থেকে শুরু করে হরিণধরা গ্রাম পর্যন্ত দেড় শতাধিক গার্মেন্ট, টেক্সটাইল, ব্যাটারিসহ বিভিন্ন কারখানার কেমিক্যাল-মিশ্রিত পানি সরাসরি গড়িয়ে পড়ে ধলেশ্বরীতে। সাভার চামড়া শিল্পনগরীর চারপাশে ঘুরে ধলেশ্বরী দূষণের চিত্র চোখে পড়ে। এ দূষণের ফলে নদীটি এখন মৃতপ্রায়। যে নদীতে একসময় ডলফিন, শুশুকসহ হাজার রকমের মাছ পাওয়া যেত, যে নদীর পানি দিয়ে আশপাশ গ্রামের মানুষ ভাত-তরকারি রান্না করত, যে নদীর দুই পাড়ে ধানসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ হতো সে নদীর পানি এখন স্পর্শ করাই কঠিন। দুর্গন্ধে ধলেশ্বরীর পাড়ে যাওয়াই দুষ্কর। অন্যদিকে সাভার চামড়া শিল্পনগরীর কঠিন ও তরল বর্জ্য ধলেশ্বরী দূষণের পাশাপাশি আশপাশ গ্রামের পরিবেশও নষ্ট করছে। শিল্পনগরীর ট্যানারি বর্জ্য ঘিরে হরিণধরা গ্রামে গড়ে উঠেছে অসংখ্য খামার। এসব খামারে ট্যানারির বর্জ্য থেকে তৈরি করা হয় পোলট্রি ও মাছের খাবার এবং মশার কয়েলের কাঁচামাল। সেই সঙ্গে মানুষের প্রতিদিনের ব্যবহৃত সাবানের চর্বিও ট্যানারির বর্জ্য জ্বালিয়ে তৈরি করা হয়। এ ছাড়া চামড়া শিল্পনগরীর ভিতরে ১৫৫টি ট্যানারি কারখানার মালিককে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত ২৩টির বেশি কারখানা চালু করা যায়নি। চামড়া শিল্পনগরীর ভিতরের রাস্তাসহ অন্যান্য অবকাঠামো এখনো পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় চামড়া শিল্পনগরীতে মহাবিপর্যয় নেমে আসবে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের। এদিকে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ ট্যানারি শিল্প ঘিরে ধলেশ্বরী ও আশপাশের পরিবেশ দূষণের সব দায় চাপালেন বিসিকের ওপর।

বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘বিসিক আমাদের জায়গা দিয়েছে, আমরা কারখানা করেছি। মালিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সব নিয়ম-কানুন মেনে কারখানা পরিচালনা করা। ট্যানারির বর্জ্য কোথায় ফেলা হবে, কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) কীভাবে সঠিকভাবে পরিচালনা করা হবে এসব দেখার দায়িত্ব বিসিকের। কিন্তু বিসিক সে কাজটি ঠিকমতো করছে না। তাদের কারণেই ট্যানারি শিল্পের বর্জ্যে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে।’

বিস্ময়কর হচ্ছে ট্যানারির বর্জ্য যে সরাসরি ধলেশ্বরীতে ফেলা হয় তা জানেনই না চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী জিতেন্দ্রনাথ পাল। কঠিন ও তরল বর্জ্য কেন সরাসরি নদীতে ফেলা হয় জানতে চাইলে তিনি অনেকটা অবাক হয়েই বলেন, ‘তাই নাকি! আমার তো জানা নেই। আপনি অভিযোগ দিলেন, আমি এখনই খোঁজ নিচ্ছি। আমি নিজে গিয়ে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে দেখব।’

আসলে তিনি সবই জানেন, জেনেও না জানার ভান করেন। কারণ চামড়া শিল্পনগরীর একেবারে দক্ষিণ পাশে জমজম সিটির কোলঘেঁষে প্রায় ১৭ বিঘার মতো বড় পুকুরসদৃশ খোলা জায়গায় শুরু থেকেই ফেলা হয় ট্যানারির কঠিন বর্জ্য। এসব বর্জ্যে থাকে টোটাল ক্রোমিয়াম, টিডিএস, ক্লোরাইডসহ বিভিন্ন বিষাক্ত কেমিক্যালের উপাদান। পুকুরটিও এখন বর্জ্যে সম্পূর্ণভাবে ভরে গেছে। পুকুর উপচে তরল ট্যানারির বর্জ্য আশপাশে ছড়িয়ে পড়লে প্রকল্প কর্মকর্তারা পুকুরটির এক পাশ কেটে সরাসরি নদীতে ফেলার ব্যবস্থা করেছেন। এতে পাশের জমজম সিটির জমিতে বিশাল গর্তের সৃষ্টি হলে এবং সীমানাপ্রাচীর ভেঙে গেলে জমির মালিকরা প্রতিবাদ জানান। পরে বিসিক কর্মকর্তারা বাঁধ দিয়ে আটকে দেন। সর্বশেষ ডিসেম্বরে সে বাঁধ ভেঙে আবারও বর্জ্য ঢুকে যায় আশপাশের বাড়িঘরে, সেই সঙ্গে টন টন বর্জ্য গড়িয়ে পড়ে ধলেশ্বরীতে। আবারও শক্ত করে বাঁধ দেওয়া হয়। কিন্তু বর্জ্য তো আটকে রাখা যাবে না। কোথায় ফেলা হবে। বিকল্প কোনো উপায়ও নেই। এবার একটু চতুরতার আশ্রয় নেন চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পের কর্মকর্তারা। পুকুরটির যে পাশ ভেঙে গিয়েছিল সে পাশের মাটির নিচ দিয়ে প্রায় দেড় ফুট চওড়া কালো রঙের মোটা পাইপ দিয়ে বর্জ্য ফেলা শুরু করেন। মাটির নিচ দিয়ে ফেলার কারণ, যাতে কেউ বুঝতে না পারেন এ বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে ফেলছে বিসিক। বর্জ্যরে সঙ্গে চামড়ার টুকরো থাকায় পাইপটি বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য শ্রমিক রাজীব, শহীদ ও পলাশ সে পাইপটি মেরামত করেন। পাইপ মেরামতে তাদের কে পাঠিয়েছেন জানতে চাইলে তিনজনই জবাব দেন, বিসিকের লোকেরা তাদের এ কাজ করতে পাঠিয়েছেন। সুতরাং বিসিকের অধীন চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পের কর্মকর্তাদের নির্দেশেই এবং তারা জেনেবুঝেই প্রতিদিন ট্যানারির হাজার হাজার টন বিষাক্ত বর্জ্য ফেলছেন ধলেশ্বরীতে। একইভাবে ট্যানারির তরল বর্জ্য সিইটিপিতে শোধন করে যে পানি ধলেশ্বরীতে ফেলা হয় সে ক্ষেত্রেও গোপনীয়তার আশ্রয় নেওয়া হয়। সিইটিপি নির্মাণ থেকে শুরু করে এখন পরিচালনা করছেন চীনা প্রতিষ্ঠান জিনসু লিংঝি এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন কোম্পানির কর্মকর্তারা। কিন্তু এ সিইটিপিতে ট্যানারির তরল বর্জ্য শতভাগ শোধন হয় না। প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী জিতেন্দ্রনাথ পাল নিজেই বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চীনা প্রতিষ্ঠানটি সিইটিপি নির্মাণ করলেও পিজিএস সল্ট শোধনের মতো সক্ষমতা তাদের নেই। এ কারণে ৮০ শতাংশ শোধন করেই পানি ফেলা হয় ধলেশ্বরীতে। কিন্তু এ পানি ফেলার ক্ষেত্রে চতুরতার আশ্রয় নেওয়া হয়। কারণ চামড়া শিল্পনগরীর একেবারে পশ্চিম সীমানা ঘেঁষে যে বাঁধ দেওয়া হয়েছে তার মাটির নিচ দিয়ে পাইপ দিয়ে অনেকটা গোপনেই ফেলা হয় বিষাক্ত পানি। পাইপ দিয়ে গড়িয়ে পানি নদীতে পড়ার দৃশ্য যাতে দেখা না যায় সেজন্য পাইপের শেষ মাথার অনেকখানি পানির মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু পাইপে কান পাতলেই বোঝা যায় হড়হড় করে গড়িয়ে পড়ছে পানি। তা ছাড়া যে সোজা পাইপ থেকে পানি নদীতে পড়ছে সেখানকার পানিতে সব সময় বুদ্বুদ উঠছে। তাহলে কি বিসিক সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়েও এভাবে গোপনে ধলেশ্বরী ধ্বংসে মেতে উঠেছে? পরিবেশবিদরা তেমনই মনে করছেন।

এ বিষয়ে সাভার নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ট্যানারির অপরিশোধিত তরল বর্জ্যে ধলেশ্বরী নদী ও ডিইপিজেডের বর্জ্যে ধলাই বিল আর বংশী নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। দখল হয়ে গেছে বংশী নদীর দুই তীর।’ তিনি বলেন, ‘সাভারবাসীকে বাঁচাতে তরল বর্জ্য শোধন নিশ্চিত করতে হবে। আর নদী বাঁচাতে সিএস ম্যাপ ধরে নদীর সীমানা নির্ধারণ করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর