বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিদেশে যাচ্ছে তিস্তা চরের মিষ্টি কুমড়া

লালমনিরহাট প্রতিনিধি

বিদেশে যাচ্ছে তিস্তা চরের মিষ্টি কুমড়া

মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে তিস্তা চরাঞ্চলের মিষ্টি কুমড়া যাওয়ায় খুশির আমেজ বইছে চাষিদের মধ্যে। তাদের অভিব্যক্তি, ‘হামার তিস্তার চরের মিষ্টি কুমড়া বিদেশত যাবার নাংছে, হামরা লাভবানও হচ্ছি, এর চেয়ে খুশি আর কি হবার পায়। এবার আবাদ কম হইলেও বাজারোত কুমড়ার দাম ভালো। চরের য্যাটে যাইবেন কুমড়া আর কুমড়া দেখবার পাইমেন। সারা চরত বাদাম, ভুট্টা, শসা, স্কোয়াশ, শাক-সবজির আবাদও চোকোত পড়বে বাহে। অ্যালা আগের মতো চরোত তাংকুর (তামাক) আবাদ নাই। বেশি লাভ হওয়াতে কমবেশি সগায় মিষ্টি কুমড়ার আবাদ করচে।’ এই কথাগুলো বলছিলেন সত্তরোর্ধŸ বয়সী কৃষক রহমত মিয়া। তিনি জেলার কালিগঞ্জের ভোটমারি ইউনিয়নের তিস্তা নদীবেষ্টিত চরের বাসিন্দা। প্রতি বছর বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে তিস্তাপাড়ের রহমতদের লড়তে হয় নদী ভাঙনের সঙ্গে। কখনো নদীগর্ভে বিলীন হয় তাদের বসতভিটে। কখনো চাপা পড়ে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন। তারপরও হাড়ভাঙা পরিশ্রমে থেমে থাকে না তাদের জীবনযুদ্ধ। এবার মিষ্টি কুমড়া ঘিরে দেখা স্বপ্ন পূরণে খুশি তারা। শুধু তিস্তার চরেই নয়, ধরলার বিস্তীর্ণ চরজুড়ে চাষ হয়েছে মিষ্টি কুমড়া। সেখানকার মিষ্টি কুমড়া যাচ্ছে বিদেশে। প্রায় আট বছর পর আবারও তিস্তা-ধরলার দুর্গম চরাঞ্চলে চাষ করা হাইব্রিড জাতের মিষ্টি কুমড়া। রপ্তানি হচ্ছে মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুরে। বিস্তীর্ণ চরের মিষ্টি কুমড়া দেশ ছাড়িয়ে বিদেশিদের রান্নায় পড়বে এই আনন্দে ভাসছেন চাষিরা। জানা গেছে, লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলার তিস্তা নদীর দুর্গম চরাঞ্চলে উৎপাদিত হাইব্রিড জাতের মিষ্টি কুমড়া রপ্তানি হচ্ছে মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুরে। এর আগে ২০১৪ সালে বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থা প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন বাংলাদেশের উদ্যোগে চরে চাষ করা মিষ্টি কুমড়া পৌঁছেছিল বিদেশের ভোক্তাদের পাতে।

আর এবার কৃষি বিভাগের দিকনির্দেশনা ও এমফোরসি প্রকল্পের সহায়তায় দুটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কৃষকদের খেত থেকে সরাসরি মিষ্টি কুমড়া কিনে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে পাঠাচ্ছেন। ইতোমধ্যে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ২৪ কোটি টাকার মিষ্টি কুমড়ার অর্ডার পেয়েছেন। এ কারণে চাষিদের কাছ থেকে তারা সরাসরি মিষ্টি কুমড়া কিনে প্যাকেটজাত করছে। তবে শুধু বিদেশেই নয়, স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে চরে আবাদ করা মিষ্টি কুমড়া দেশের ২১টি জেলাতেও পাঠানো হচ্ছে বলে চাষিরা জানিয়েছেন। সরেজমিন তিস্তা নদীবেষ্টিত সদরের রাজপুর ইউনিয়নের চর রাজপুর ও কালিগঞ্জের কাকিনা ইউনিয়নের চর রুদ্রেশ্বর  ঘুরে দেখা গেছে, ধু-ধু বালুচরে বিস্তীর্ণ সবুজের সমারোহ। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে চরাঞ্চলে এক সময়ের পতিত জমিগুলোতে সবুজের বিপ্লব ঘটাতে জুড়ি নেই। চর রুদ্রেশ্বর গ্রামে প্রায় ৮০০ কৃষক পরিবারের বসবাস। জনসংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৮১৯ জন। যাদের ৯০ ভাগ কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। ভূমিহীন, গৃহহীন ও নিম্নআয়ের এসব পরিবার এখন চরজুড়ে মিষ্টি কুমড়া, আলু, ভুট্টা, বাদাম, পিঁয়াজ, ধান চাষ করছেন। পাশাপাশি তাদের রয়েছে গবাদি পশু ও ছাগল পালন। তবে গেল কয়েক বছর ধরে লাভ বেশি হওয়াতে মিষ্টি কুমড়ায় ঝুঁকেছেন চাষিরা। সত্তরোর্ধŸ বয়সী এই কৃষক জানান, এবার ৮০ শতাংশ জমিতে তিনি মিষ্টি কুমড়ার চাষ করেছেন। বীজ, সার, জমি তৈরি ও সেচ দেওয়াসহ তার খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে রপ্তানিকারকরা তার খেত থেকে ১৯ টাকা কেজি মূল্যে ২০ বস্তা মিষ্টি কুমড়া কিনে নিয়েছেন। ফলন কম হলেও চাহিদা বেশি হওয়ায় ভালো দাম পাচ্ছেন তিনি। এতে তার ৫০ হাজার টাকার বেশি লাভ হবে বলে মনে করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চরাঞ্চলের ভূমিহীন ও কৃষিনির্ভর পরিবারের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে এসেছে বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থা এমজেএসকেএস, পাম্পকিং প্লাস, এমফোরসি ও বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন একাডেমি। বিশেষ করে এমফোরসি তিস্তা-ধরলা চরে মিষ্টি কুমড়া চাষে উন্নত প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি কৃষকদের প্রয়োজনীয় কারিগরি পরামর্শ ও উপকরণ সরবরাহ করে যাচ্ছে। মিষ্টি কুমড়া রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান রংপুর এগ্রোর কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান রতন জানান, তারা চাষিদের কাছ থেকে ১৬-১৯ টাকা কেজি দরে সরাসরি খেত থেকে মিষ্টি কুমড়া কিনছেন। এরপর প্যাকেজজাত করে বস্তায় ভরে ট্রাকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছেন। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চরাঞ্চলের মিষ্টি কুমড়ার চাহিদা রয়েছে। ইতোমধ্যে ৩ কোটি টাকার মিষ্টি কুমড়া বিদেশে পাঠানো হয়েছে। দুই দেশে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার মিষ্টি কুমড়া রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ হামিদুর রহমান বলেন, আপাতত দুই দেশে রপ্তানি হলেও চরাঞ্চলের উৎপাদিত মিষ্টি কুমড়ার চাহিদা দেশের বিভিন্ন জেলায় রয়েছে। এতে চাষিরাও লাভবান হচ্ছে। চরাঞ্চলে টেকসই ফসল উৎপাদনও সম্ভব হচ্ছে। তবে সে দিন বেশি দূরে নয়, যে দিন মিষ্টি কুমড়া বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর