'গত দুই দশক আগে প্রতি বৃহস্পতিবার বিতর্ক প্রতিযোগীতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। রচনা প্রতিযোগিতা হতো স্কুলে। প্রতি সোমবার লাইব্রেরী থেকে নানা ধরনের বই নিয়ে যেতাম। বইটি পড়ে এক সপ্তাহ পর আবার জমা দিয়ে নতুন বই নিয়ে যেতাম। সপ্তাহের একদিন শ্রেণীগত ফুটবল বা ভলিবল প্রতিযোগিতা হতো। উপস্থিত বক্তৃতার আসর বসতো। এসব আয়োজনে শিক্ষকেরা আমাদের উৎসাহ দিতেন। আমরা শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন অনুষ্ঠান করার দাবিতে আন্দোলন করতাম। এখন এসব হয়না। এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অবিভাবক সবাই দৌড়াচ্ছেন জিপিএ ৫ এর দিকে।' এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন পঞ্চগড়ের ভজনপুর দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র আব্দুল জলিল।
এইসব দিনগুলো ফিরে পেতে চায় পঞ্চগড়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অবিভাবক ও সুশিল সমাজ। তারা চায় আগের মতোই স্কুলগুলোতে প্রতিদিনই পড়াশোনার পাশাপাশি খেলা ধুলা, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা আর সাংস্কৃতিক বিনোদনের উদ্যোগ নেয়া হোক। ক্যাম্পাসে স্বেচ্ছাসেবি সংগঠনগুলো চালু হোক। শিল্প সাহিত্যসহ নানা আড্ডায় জমে উঠুক ক্যাম্পাস। তারা বলছেন, জ্ঞান বিজ্ঞান বা সাংস্কৃতিক চর্চা অপ্রতুল হওয়ার কারণে এই জেলার তরুণ ও যুবসমাজ মাদকাসক্তের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বাড়ছে বুদ্ধিবৃত্তিক সন্ত্রাস ও নারী নির্যাতন মামলাবাজী। বাড়ছে জুয়া খেলা। অপরদিকে মানষিকভাবে হতাশ হয়ে পড়ছে তারা। এদিকে অনেকেই ধারনা করছেন, সহজ সরল জীবন যাপনের জেলা হিসেবে পরিচিত হলেও সাংস্কৃতিক চর্চার অভাবে জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদেরও উত্থান হতে পারে এই জেলায়। পঞ্চগড় সদর হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের তথ্যমতে প্রতিবছরই এই জেলায় নারী নির্যাতনের হার বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে নানা ধরনের সত্য-মিথ্যার মামলা।
অনেকে অভিযোগ করে বলেন, পঞ্চগড়ের প্রাথমিক বা উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবছর একদিন ‘বার্ষিক ক্রিড়া ও সাংস্কৃতিক’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাৎসরিক একবার করে বনভোজনে নিয়ে যাওয়া হয় শিশুদের। সকালের এসেম্বলী ক্লাসে বেসুরো করে গাওয়া হয় জাতীয় সঙ্গীত । অধিকাংশ স্কুলে লাইব্রেরী থাকলেও বই পড়েনা শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকেরাও এ নিয়ে উদ্যোগী নয়। অধিকাংশ শিক্ষকই ক্লাস রুটিন কোনমতে ঠিক রেখে ব্যাচ পড়ানো নিয়েই ব্যাস্ত। সংস্কৃতি, সাহিত্য বা বিজ্ঞান চর্চা নিয়ে আগ্রহ নেই তাদের ।
সরকারি বেসরকারি কলেজগুলোতেও একই চিত্র। কলেজগুলোর ক্যাম্পাসে গড়ে উঠছেনা কোন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বছরে একবার খেলাধুলা আর নবীন বরণ ছাড়া কোন অনুষ্ঠান বা সংস্কৃতি চর্চার কোন উদ্যোগও নেই। এ ব্যাপারে মকবুলার রহমান সরকারি কলেজের উপাধক্ষ্য দেলোয়ার হোসেন প্রধান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের এ ব্যাপারে আগ্রহ কম। তারা ক্যারিয়ারের দিকে ঝুকছে বেশী।’
এসব বিষয়ে শিক্ষক, অবিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে পড়ালেখার অতিরিক্ত চাপে শিক্ষার্থীরা সময় পাচ্ছেনা। পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী নাসরিন আক্তার জানায়, ‘পাঁচটি বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে হচ্ছে। এর পেছনেই চলে যায় ৫ ঘন্টা। ক্লাস করতে হয়। বাসায় পড়তে হয়। এরপর নিজের ব্যাক্তিগত কাজ তো আছেই। সময় পাওয়া যায়না। এরপর অবিভাবক ও শিক্ষকদের চাপ তো আছেই।
শিক্ষক ও গবেষক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সময়ে স্কুল কলেজে নানা সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করতাম। কবিতা, গানের আসর বসতো। নিয়মিত খেলাধুলা হতো। আমাদের শিক্ষকেরা মানুষ হতে বলতেন। কলেজগুলোতে নানা ধরনের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির সংগঠন ছিল। চা না খেয়ে চাঁদা দিয়ে এসব সংগঠন চলতো। বন্যা বা শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতো এসব সংগঠন। সেই সব দিনগুলো ফিরিয়ে আনা জুররী। এ ব্যাপারে সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।’
বিডি প্রতিদিন/১৭ আগস্ট ২০১৬/হিমেল-১৫