নরসিংদীর সাবেক পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের মৃত্যুর আট বছর পেরিয়ে গেলেও কবরের মাটিও ছুঁয়ে দেখতে পারেনি ছেলে শাহহাম হোসেন। দূর থেকে পিতার কবরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস আর দু'ফোঁটা অশ্রু ঝরানোই শেষ। বাবার কবরের পাশে ছুটে গেলেও ভয় আর শঙ্কায় ফিরে আসতে হয়েছে।
এমনটাই দাবি করেছেন সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত লোকমান হোসেনের প্রথম স্ত্রীর ছেলে শাহহাম হোসেন। শাহহামের মা তাজমহল বেগমেরও একই অবস্থা। দাফনের পরে কখনই যেতে পারেননি স্বামীর কবরের পাশে। তাদের অভিযোগ, লোকমান হোসেনের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ও সম্পদ থেকে বঞ্চিত করতেই এমন কৌশল।
এ বিষয়ে তাজমহল বেগম বলেন, লোকমানের মৃত্যুর শোক না কাটতেই নিজের ও সন্তানদের নামে ওয়ারিশনামা উঠিয়ে নেন বুবলী। মেয়র লোকমানের হত্যার বিচার, সন্তানের অধিকার ও জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদনও করেন তাজমহল। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে সাধারণ ডায়েরি করেন ঢাকার দক্ষিণ খান থানায়।
১৯৯৭ সালে নরসিংদীর সাবেক পৌর মেয়র লোকমান হোসেন ভালোবেসে বিয়ে করেন ফুফাতো বোন তাজমহল বেগমকে। প্রথম দিকে এ বিয়ে মেনে নেয়নি লোকমানের পরিবার। তবে সন্তান শাহহামের জন্মের পর পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতেন রাজধানীর উত্তরায়। লোকমান রাজনীতি করতেন নরসিংদীতে। সময়ের পরিক্রমায় সেখানে আবার তামান্না নুসরাত বুবলীকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরেও জন্ম নেয় এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের। বুবলী থাকতেন নরসিংদী ও মমতাজ উত্তরায়। কারও বিরুদ্ধেই কারও কোনো অভিযোগ ছিল না।
২০১১ সালের ১ নভেম্বর সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত হওয়ার পর থেকে সমস্যা শুরু হয়। খুন হওয়ার পর বিভিন্ন মিডিয়া ও রাজনৈতিক লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন দ্বিতীয় স্ত্রী বুবলী। আড়ালে চলে যান তাজমহল বেগম। লোকমানের পরিবারও চাচ্ছিল যেহেতু বুবলী সব জায়গায় কথা বলছে তাই তাজমহল যেন চুপ থাকে। মিডিয়ায় দুই স্ত্রীর সংবাদ প্রকাশিত হলে ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকেই পরিবারের চাওয়া ছিল এটি।
তাজমহল বেগম অভিযোগ করেন, দুই স্ত্রীর বিষয়টি প্রকাশ হলে বা রাজনৈতিক নেতারা জানলে মেয়র নির্বাচনে মনোনয়ন ও দলীয় রাজনীতিতে সমস্যার সৃষ্টি হবে এমন কথা বলে তাকে চুপ থাকতে বলা হয়।
লোকমানকে দাফনের কিছুদিন পরে ঢাকায় ফিরে আসেন তাজমহল বেগম। ঢাকায় আসার পর থেকেই তাকে ভয়ভীতি দেখানো শুরু হয় বলে অভিযোগ করেন তাজমহল বেগম। নরসিংদী শহরে যেতেও তাকে নিষেধ করা হয়।
তাজমহল বেগম বলেন, তার একমাত্র সন্তান শাহহাম পড়াশোনা করতো ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজে। পারিবারিক সিদ্ধান্তে সন্তানের পড়াশোনার খরচ প্রথমদিকে মেয়র লোকমানের ছোট ভাই ও বর্তমান নরসিংদী পৌরসভার মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল চালাতেন। পাশাপাশি সহযোগিতা করতেন অপর ছোট ভাই শামীম নেওয়াজও। কিছুদিন পরে এসব বন্ধ হয়ে যায়। অবস্থায় সন্তানের ব্যয় নির্বাহ কঠিন হয়ে যায়। অনন্যোপায় তাজমহল বেগম আর্থিক টানাপড়েনে ক্যামব্রিয়ান স্কুল থেকে ছেলে শাহহামকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভর্তি করেন উত্তরার একটি স্কুলে। বর্তমানে শাহহাম একটি সরকারি কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে।
তাজমহল বেগম বলেন, আট বছরেও স্বামীর কবরের পাশে যেতে পারিনি। প্রতি বছর লোকমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে নরসিংদীতে গেলেও কবরের পাশে যেতে পারি না। সারাক্ষণ পাহারা বসিয়ে রাখা হয়। আমাদের একমাত্র ছেলে শাহহামও বাবার কবরের পাশে যেতে পারেন না। একবার বাবার কবর জিয়ারত করতে গেলে মোটরসাইকেলে করে শাহহামকে কিছু লোক তুলে নিয়ে যায়। পরে তাকে নরসিংদী যেতে নিষেধ করা হয়।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার স্বামীর মৃত্যু শোক না কাটতেই মাত্র ১২ দিনের মাথায় আমাদের বঞ্চিত করে ওয়ারিশনামা উঠিয়ে আনে বুবলী।
মেয়র লোকমানের ছেলে শাহহাম হোসেন অভিযোগ করেন, তাদের সঙ্গে জালিয়াতি করা হয়েছে। আমার চাচারা কোনো খোঁজখবরই রাখেননি।
এ বিষয়ে নরসিংদী পৌরসভার বর্তমান মেয়র ও প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের ছোট ভাই কামরুজ্জামান কামরুল গণমাধ্যমকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। তিনি এ বিষয়ে এমপি তামান্না নুসরাত বুবলীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ও প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের দ্বিতীয় স্ত্রী তামান্না নুসরাত বুবলী জানান, আমার বিয়ের কাবিননামায় লোকমান অবিবাহিত লেখা ছিল। এতে তার পরিবারের সদস্যদের সাক্ষরও ছিল। আমি অন্য কাউকে দেখিনি কখনো। এখন যদি ওনারা আইনগতভাবে কোনো কিছু প্রত্যাশা করেন তবে সেখানে লোকমান হোসেনের ভাই, মা আছেন তারা জানেন।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন