স্ত্রী মাদ্রাসার শিক্ষক। স্ত্রীর আয়ের পাশাপাশি নিজে ক্ষুদ্র ব্যবসা করে সংসার চালাতেন বরিশাল নগরীর রূপাতলীর মো. পান্না মিয়া। ওমানে থাকা-খাওয়া ফ্রি, মাসিক বেতন ৪০ হাজার টাকা, দূরসম্পর্কের এক আত্মিয়ের এমন প্রস্তাবে বিদেশে গিয়ে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখেন তিনি। ভাগ্য বদলের আশায় গত বছরের ২৪ মে নগরীর কাশীপুরের ফিশারী রোডের বাসিন্দা ওমান প্রবাসী শহীদুল ইসলামকে নগদ ৫ লাখ টাকা দেন তিনি।
মধ্য জুনে ভিসা আসে পান্নার। শহীদুল তাকে একটা বিমান টিকেটও দেন। মেডিকেল করতে হবে না পান্নার, সেটা ওমান থেকেই ম্যানেজ করবে শহীদুল। উড়াল দেয়ার আগে শুধু ঢাকায় নিয়ে ৩ দিনের একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে শহীদুল ও তার ভগ্নিপতি হাইকোর্টে কর্মরত জাহাঙ্গীর সরদার। সবকিছু ঠিকঠাক। ১৯ সেপ্টেম্বর ভোরে ওমানের ফ্লাইট। তার আগে পরিবার-পরিজন ছেড়ে ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় লঞ্চ যোগে বরিশাল ত্যাগ করেন পান্না। লঞ্চ ঘাটে বিদায়ের মুহূর্তে পান্নার স্বজনরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ওমান প্রবাসী শহীদুলও।
১৯ সেপ্টেম্বর সকালে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রা.) বিমান বন্দরে ফাস্ট ইমিগ্রেশন গেটে প্রবেশের সময় কর্মকর্তারা চ্যালেঞ্জ করেন পান্নাকে। ভিসা ও টিকেট ডকুমেন্ট দেখে দুটোই জাল বলে সনাক্ত করেন তারা। ওই ভিসা ও টিকেট নিয়ে ওমানতো দূরের কথা, বিমানবন্দরের মধ্যেও ঢুকতে পারবে না বলে পান্নাকে জানায় ইমিগ্রেশমন কর্মকর্তারা। শেষ মুহূর্তে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন তিনি।
সেখানেই পান্নার সাথে পরিচয় হয় শহীদের প্রতারনার শিকার বরিশাল নগরীর কাশীপুরের আরেক যুবক আমিনুল ইসলামের। প্রবাস জীবনের স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার পর ওইদিন বিকেলেই বরিশাল ফিরে ভিসাদাতা শহীদের কাছে টাকা ফেরত চান পান্না। এবার আগের ভিসা জাল স্বীকার করে পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে নতুন ভিসা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন শহীদ। কিছুদিন পর ওমানের আরেকটি ভিসা দিলেও সেটিও জাল বলে সনাক্ত হয়। এরপর টাকা ফেরত দেয়ার কথা বলে স্বপরিবারে ওমান পালিয়ে যায় শহীদ।
প্রতারনার বিচার এবং টাকা ফেরত পাওয়ার দাবিতে অভিযুক্ত শহীদুল ইসলাম, তার স্ত্রী ফাতেমা আক্তার এবং তাদের ভগ্নিপতি জাহাঙ্গীর সরদারের বিরুদ্ধে গত ৩০ ডিসেম্বর বরিশাল চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে মামলা করেন পান্না। আদালতের নির্দেশে বর্তমানে ওই মামলা তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই কবির বলেন, বাদী পান্নার অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। ভিসা দুটো প্রকৃত অর্থে জাল কিনা তা চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কাজ চলছে।
শুধু পান্না একা নন, ওমান প্রবাসী শহীদের প্রতারনা শিকার হয়ে সব হারিয়েছেন শহীদের আত্মীয় নগরীর ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের ফিশারী রোডের আমিনুল ইসলাম, একই ওয়ার্ডের দিয়াপাড়ার মাহমুদ হোসেন ও মো. মুন্না, নগরীর আমানতগঞ্জের মিজানুর রহমান এবং নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালের ফল বিক্রেতা মো. হাফিজ। তাদের বিদেশ নেওয়ার বিষয়ে সহযোগীতা করার অভিযোগ রয়েছে শহীদের ভগ্নিপতি বরিশাল সদর উপজেরার দুর্গাপুরের বাসিন্দা সুপ্রীম কোর্টের বেঞ্চ অফিসার পরিচয়দানকারী জাহাঙ্গীর সরদারের বিরুদ্ধে।
প্রতারণায় সহযোগীতার বিষয়ে গতকাল সোমবার বিকেল ৩টায় মুঠোফোনে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর সরদার নিজেকে সুপ্রীম কোর্টের বেঞ্চ অফিসার পরিচয় দিয়ে বলেন, কোর্ট চলছে। এ বিষয়ে পরে কথা বলবেন। তবে ওই ঘটনায় নিজেকে নির্দোষ দাবি করেননি তিনি।
প্রতারিতদের আরেকজন নগরীর আমানতগঞ্জের মিজানুর রহমান বলেন, শহীদুল ইসলাম তাকে একবার একটা ভিসার ফটোকপি দিয়েছিলো। কিন্তু ওই ফটোকপি দিয়ে তাকে ওমান নিতে পারেননি শহীদ। বলেছে ওমানে ভিসায় সমস্যা হয়েছে। ওমান নেওয়ার বিষয়ে শহীদের সাথে তার (মিজান) জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তি রয়েছে বলেও দাবী মিজানের।
৫ মাস আগে প্রায় ৪ লাখ টাকা দিয়েও ওমান যেতে না পাড়া নগরীর নথুল্লাবদ বাস টার্মিনালের ভাসমান ফল ব্যবসায়ী মো. হাফিজ বলেন, শহীদুল ইসলাম বারবার শুধু সময় চাইছে। তারপরও তাকে বিদেশ নেবে সেই আশায় রয়েছেন তিনি।
প্রতারনায় অভিযুক্ত শহীদুলের মা লাইলী বেগম বলেন, শহীদ ১২জনকে ওমান নেওয়ার কথা বলেছিল। সে কয়েকজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে, কয়েকজনের টাকা এখনও নেয়নি। এদের মধ্যে ২জনকে ওমান নিতে পেরেছে সে। শহীদ ওমানে প্রতারণার শিকার হয়েছে। এ কারণে সমস্যা হয়ে গেছে। তারপরও সবাইকে ওমান নেওয়ার চেষ্টা করছে। পান্না ওমান যাওয়ার জন্য শহীদকে টাকা দিয়েছে বলে স্বীকার করেন লাইলী বেগম।
বিডি-প্রতিদিন/ সিফাত আব্দুল্লাহ