মাছ না তিমি মাছ তা নিয়ে একটা শোরগোল ছিল। মাছটির বিশাল মাথা, হা করা মুখের চারপাশ দিয়ে বের হয়েছে সুচালো দাঁতগুলো। মাথাটা বেশ কালো। তা দেখে শিশুদের ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু তারপরও বগুড়ার পোড়াদহ মেলায় এই মাছটি দেখতে ভিড় করেছিলেন সব বয়সী মানুষ।
৭২ কেজির বাঘাইড় মাছটি দেখতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে। ৭২ এর পর ছিল ৫২ কেজির বাঘাইড় মাছ। ১০ কেজির কাতল, ব্লাডকার্প ১৯ কেজি, ৬ কেজির রুই, ১৮ কেজির সিলভারকাপ, ২২ কেজির বোয়ালও। হরেক রকমের মাছের মধ্যে মেলায় এবার স্থান পেয়েছে তিন কেজির মিষ্টি মাছ। এই মিষ্টি মাছ খেতে সুস্বাদু এবং খুবই মিষ্টি।
বগুড়ার পোড়াদহ মেলা কমিটির সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ৪’শ বছর পূর্ব থেকে স্থানীয় সন্ন্যাসী পূজা উপলক্ষে গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের গোলাবাড়ী বন্দরের ঐতিহ্যবাহী এই পোড়াদহ মেলা বসে। তবে গত দু’বছর আগে থেকে মেলাটি স্থান পরিবর্তন হয়েছে। মেলা বসার পূর্বের স্থান থেকে আরেকটু পূর্বধারে এই পোড়াদহ মেলা বসছে। প্রতি বছর বাংলা সনের মাঘ মাসের শেষ বুধবার মেলাটি হয়।
বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার পূর্বে ইছামতি নদীর তীরে পোড়াদহ এলাকায় এ মেলা বসে। ফলে মেলাটি সবার কাছে পোড়াদহ মেলা নামেই পরিচিত। কথিত আছে প্রায় চারশো বছর আগে থেকে এই মেলা হয়ে আসছে। মেলাস্থলে ইছামতি নদীর তীরে একটি বিশাল বটবৃক্ষ ছিল। সেখানে একদিন হঠাৎ এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে। পরে সেখানে আশ্রম তৈরি করেন সন্ন্যাসীরা। এক পর্যায়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে স্থানটি পূণ্যস্থানে পরিণত হয়। প্রতিবছর মাঘের শেষ বুধবার ওই স্থানে সন্ন্যাসী পূজার আয়োজন করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। সমাগত হন দূর-দূরান্তের ভক্তরা। কালের আবর্তে স্থানটিতে লোকজনের উপস্থিতি বাড়তেই থাকে। এভাবে গোড়াপত্তন ঘটে পোড়াদহ মেলার। বর্তমানে ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে সবধর্মের মানুষের মেলবন্ধনে পরিণত হয় এ মেলা। এ মেলাকে ঘিরে উৎসবের আমেজে মেতে উঠে মেলার আশপাশ গ্রামের সব বর্ণের মানুষ। তবে মেলাটি একদিনের হলেও চলে দু’থেকে তিনদিন পর্যন্ত। এ মেলায় অনেক লোকজনের সমাগম ঘটে। ঈদ বা অন্য কোনো উৎসবে জামাই মেয়েদের কিংবা নিকট আত্মীয়দের দাওয়াত না দিলেও চলে কিন্তু পোড়াদহ মেলায় সবাইকে দাওয়াত দিয়ে ধুমধাম করে খাওয়াতে হয়-যা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
মেলা উপলক্ষে ওই এলাকার গৃহবধূরা আগেই ঘর-দুয়ার পরিষ্কার করা, মুড়ি-খৈ ভাজা, নাড়কেলের নাড়– তৈরি শুরু করে। মেয়েজামাই থেকে শুরু করে সকলেই তার নিজেদের স্বজনদের দাওয়াত করে খাওয়ান। বগুড়া সদর, গাবতলী, ধুনট, সোনাতলা ও সারিয়াকান্দি উপজেলাসহ ৪ উপজেলার মানুষ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে।
মাছ ব্যবসায়ী বিপ্লব জানান, তিনি যমুনা নদী থেকে ৭২ কেজি এবং ৫২ কেজি ওজনের দুটি মাছ নিয়ে এসেছেন। এই মাছটি কয়েকদিন আগে ধরেছেন। ৭২ কেজির মাছ তিনি ১৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করবেন। আর ৫২ কেজির মাছ ৮৩ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম হাঁকানো হয়। এছাড়া বিভিন্ন আকারের মাছ উঠেছে মেলায়। সেগুলো ১ থেকে ৩০ কেজির মধ্যে রয়েছে অসংখ্য মাছ।
মিষ্টি বিক্রেতা আলমগীর হোসেন জানান, তিনি মাছ আকৃতির ৩ কেজি মিষ্টি তৈরি করেছেন। এছাড়া তিনি আধা কেজি থেকে শুরু করে বিভিন্ন আকারের মাছ আকৃতির মিষ্টি বিক্রি করছেন। মেলায় প্রচার পেয়েছে যে মিষ্টি মাছ হিসেবে। মিষ্টি তিনি বিক্রি করছেন ৩০০ টাকা কেজি।
মেলার স্থান পোড়াদহ এলাকায় হলেও মেলাটি ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্নস্থানে। পোড়াদহ মেলাকে ঘিড়ে মেলা বসে সুবোধ বাজার, দূর্গাহাটা, বাইগুনী, দাঁড়াইল, তরনীহাট, পেরীহাটসহ আশপাশের বিভিন্নস্থানে। প্রতিবছরের মতো এবারের মেলারও মূল আকর্ষণ হলো দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় মাছ, মিষ্টি আর কাঠের তৈরি ফার্নিচার। ফার্ণিচার কেনা-বেচা মেলার দিনে চললেও মূলত মেলার পরের দুইদিনেও পুরোদমে কেনাবেচা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন আসবাবপত্র, বড়ই, কৃষি সামগ্রী ও খাদ্য দ্রব্য হাট-বাজারের মতোই ক্রয়বিক্রয় হয়।
বগুড়ার গাবতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাবের রেজা আহমেদ বলেন, পোড়াদহ মেলাটি সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দূর-দুরান্ত থেকে মানুষজন আসছে। তাদের ভিড়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে নিরাপত্তাকর্মীদের।
বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম