নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা জানান দিতে গোপালগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের ৩টি ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ করেছে সরকার। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় ওই ৩ স্থানে ২টি স্মৃতিসৌধ ও একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করেছে।
গোপালগঞ্জের ৫ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের গণকবর, বধ্যভূমি, যুদ্ধক্ষেত্রসহ মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ পর্যায়ক্রমে গোপালগঞ্জ এলজিইডি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নতুন প্রজম্ম মুক্তিযুদ্ধে জাতির সূর্য সন্তানদের অবদানসহ সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গোপালগঞ্জ এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী এহসানুল হক বলেন, প্রায় ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় কোটালীপাড়ায় হেমায়েত বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাদুঘর, গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার মানিকহার গ্রামে গণহত্যার স্মৃতি রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ ও কাশিয়ানী উপজেলার ফুকরা লঞ্চঘাট যুদ্ধক্ষেত্রে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছি। পর্যায়ক্রমে জেলার ৫ উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের সব ঐতিহাসিক স্থানসমূহ সংরক্ষণ করা হবে।
কোটালীপাড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার শেখ লুৎফর রহমান বলেন, গোপালগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জম্মস্থান। ৭১-এ বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ি। হানাদার বাহিনীকে হটাতে এ দেশে পৃথক পৃথক বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। ফরিদপুর ও বরিশাল অঞ্চল নিয়ে ‘হেমায়েত বাহিনী’ গঠন করা হয়। আমরা হেমায়েত বাহিনীর অধীনে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর ও বরিশাল অঞ্চলে যুদ্ধ করেছি। মুক্তিযুদ্ধে এ বাহিনীর সাহসিকতা ও জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করার কথা জানান দিতে সরকার হেমায়েত বাহিনী স্মৃতি জাদুঘর করে দিয়েছে। এটি আমাদের পরম পাওয়া। এজন্য আমরা সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ।
কাশিয়ানী উপজেলার ফুকরা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী বলেন, ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর ৩টি লঞ্চে করে হানাদার বাহিনী কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্পে যায়। তারা সেখান থেকে এই পথেই ফিরবে বলে আমরা জানতে পারি। তাদের লঞ্চে আক্রমণ করতে আমরা পরিকল্পনা করি। ৩১ অক্টোবর হানাদার বাহিনীর ৩টি লঞ্চ ফুকরা লঞ্চঘাট অতিক্রম করার সময় আমরা লঞ্চে আক্রমণ করি। এখানে হানাদার বাহিনীর সাথে আমাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর একটি লঞ্চ মধুমতি নদীতে ডুবিয়ে দেয়। এতে ১৫০ জন হানাদার বাহিনীর সদস্যের সলিল সমাধি ঘটে। খবর পেয়ে ফের এক লঞ্চে হানাদার বাহিনী এসে আমাদের পেছন দিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। ৫ ঘণ্টাব্যাপী চলা এই যুদ্ধে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। হানাদার বাহিনীর ১৫-২০ জনের মতো মারা যায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হানাদার বাহিনী গ্রামে ঢুকে ৫০ জন নীরিহ মানুষকে হত্যা করে। এখানে আমরা স্মৃতিসৌধ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করি। সরকার সে আবেদনে সাড়া দিয়ে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে দিয়েছে। এতে করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথার সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
গোপালগঞ্জের মানিকহার গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা বলরাম ভদ্র বলেন, সদর উপজেলার মানিহার গ্রামে ৩০ এপ্রিল হানাদার বাহিনী নীরিহ গ্রামবাসীর ওপর বর্বরোচিত হামলা করে। তারা সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের (সাবেক কায়েদে আজম মেমোরিয়াল কলেজ) দর্শন বিভাগের অধ্যাপক সন্তোস কুমার দাসসহ সাড়ে ৪০০ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। গণহত্যার শিকার এসব মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ওই গ্রামের অনিল করের বাড়ি সংলগ্ন জমিতে সরকার একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছে। এটি শহীদের স্মৃতি চির অম্লান করে রাখবে।
কাশিয়ানী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার আবুল কালাম উজির বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করে স্বাধীনতা সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। এ সরকার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন সংরক্ষণ করছে। এতে করে নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথার সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
বিডি প্রতিদিন/এমআই