মৌলভীবাজারের হাওর অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষক ও বর্গা চাষিদের জীবন-জীবিকা নির্বাহের একমাত্র সম্বল হাওরে উৎপাদিত এক ফসলি বোরো ধান। ওই ফসলের আয় দিয়েই তাদের পুরো বছরের সাংসারিক খরচ এবং ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া সহ সকল ব্যয় চলে। কৃষকরা ধার দেনাও মিটান ধান বিক্রি’র টাকা থেকে।
কিন্তু এবছর বোরো মৌসুমে দীর্ঘ মেয়াদী খরা, স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের তদারকির অভাব ও পানি সেচের সুবিধা না থাকায় জেলার হওর গুলোতে কৃষকের রোপণকৃত ব্রি-২৮ জাতের ধানে চিটা ধরায় চরম লোকসানে পড়েছেন হাওর পারের প্রান্তিক কৃষক ও বর্গা চাষিরা। সেই সাথে আসন্ন ঈদ-উল ফিতরের আনন্দ বিলীন হয়ে গেছে হাওর এলাকার দরিদ্র কৃষকদের। ঈদ আনন্দ উপভোগের চেয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন মহাজনের দাদন, এনজিও কিস্তি ও ক্ষুদ্র ব্যাংক ঋণ পরিশোধ নিয়ে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৬ হাজার ৫৭০ হেক্টর। চাষাবাদ হয়েছে ৫৭ হাজার ৩৪৫ হেক্টর। এর মধ্যে ব্রি-২৮ জাতীয় আগাম ধান চাষাবাদ হয়েছে ১৩ হাজার ৯২৫ হেক্টর জমিতে। এদিকে জেলার সচেতন মহল ও কৃষকরা মন্তব্য করছেন ব্রি-২৮ ধানে বড় ধরনের ক্ষতির পরেও জেলা কৃষি বিভাগ বলছে এবারও তারা লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। তাদের এ জরিপ মাঠের বাস্তব চিত্রের সাথে ভিন্ন।
জানা যায়, বোরো চাষের জন্য মাঘ মাসে স্থানীয় মহাজনরে কাছ থেকে ১ হাজার টাকা ঋণ নিলে ঘরে ধান তোলার পর ওই ১ হাজার টাকায় সুদ হিসেবে দিতে হয় দেড় মণ ধান। এছাড়াও এনজিও এবং জেলা সমবায় অফিস থেকে নিবন্ধনকৃত সমিতি থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করেন। এদিকে গত বছর হাওরের যে এলাকায় (মৌজায়) ব্রি-২৮ জাতীয় ধান প্রতি বিঘাতে ১৫ থেকে ২০ মন ধান পেয়েছেন কৃষকরা। এ বছর ওই এলাকায় (মৌজায়) ব্রি-২৮ ধান প্রতি বিঘাতে কৃষকরা পাচ্ছেন ৪ থেকে ৫ মন।
জেলার রাজনগর উপজেলার কান্দি গ্রামের বর্গাচাষি নেপুর মিয়া বলেন, আমরা দিনমজুর। দৈনন্দিন মজুরি দিয়ে কোনো রকম চলে আমাদের সংসার। সাংসারিক খরচ পরে আমাদের কাছে কোন দিন অবশিষ্ট টাকা থাকেনা। তাই বাধ্য হয়ে মহাজনদের কাছ থেকে দাদন এনে বোরো চাষাবাদ করি। বোরো ক্ষেত আমাদের প্রাণ। বোরো চাষাবাদ করতে আনন্দ পাই। ভালোভাবে ধান হলে অন্তত সারা বছর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ডাল ভাত খেতে পারতাম।
তিনি আরও বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে ২ বিঘা জমিতে ধান পেয়েছি ৮ মন। এই জমি আবাদ করতে স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে গত পৌষ মাসে দাদনে ১০ হাজার টাকা এনে ছিলাম। দাদন হিসাবে বৈশাখ মাসে ১০ মণ ধান ও জ্যৈষ্ঠ মাসে ১০ হাজার টাকা ফেরত দেয়ার শর্ত ছিল। কিন্তু এবার ধান পেয়েছি মাত্র ৮ মন। এর মধ্য থেকে জমির মালিককে খাজনা হিসেবে দিতে হবে ৪ মন। মহাজনের দেনা পরিশোধ ও পুরো বছর ছেলে মেয়েদের নিয়ে কিভাবে সংসার চালাই এই চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটছে। ঈদ আনন্দতো অনেক দূরে।
হাকালুকি হাওরের কৃষক আব্দুল হান্নান বলেন, ২ বিঘা জমিতে ব্রি ২৮ ধান চাষ করেছিলাম। পুরো দুই বিঘা জমির ফসলে চিটা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, কৃষি বিভাগ থেকে কোন ধরনের সহযোগিতা পাননি। কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের কৃষক রিয়াজুর রহমান বলেন, কৃষি বিভাগ কাগুজে কলমে ফলন বাড়িয়ে দেখাতে ব্যস্ত। কৃষকের সমস্যাগুলো সমাধানে এগিয়ে আসেনি।
মৌলভীবাজার কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কাজী লুৎফুল বারী বলেন, খরার কারণে কিছু কিছু এলাকায় জমিতে ধানে চিটা ধরেছে, এটা আমাদের চোখে পড়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কোনো তালিকা করা হয়নি।
বিডি প্রতিদিন/আবু জাফর