মাদারীপুরের ৭ যুবককে লিবিয়ায় আটকে রেখে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করার অভিযোগ উঠেছে। ৫ মাস আগে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে লিবিয়ায় পাড়ি জমান মাদারীপুরের সাত যুবক। লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর থেকে তাদের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ পরিবারের।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা জানান, লিবিয়ায় ওই যুবকদের জিম্মি করে তাদের ভিডিও কল দিয়ে মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছে। টাকা না দিলে তাদের নির্যাতনের হুমকি দিয়েছে জিম্মিকারীরা।
নিখোঁজ সাত যুবক হলেন-মাদারীপুর সদর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের আবুল হোসেন হাওলাদারের ছেলে রকিব হাওলাদার, আবদুল হাকিম খলিফার ছেলে এলেম খলিফা, শিরখাড়া ইউনিয়নের রব সিকদারের ছেলে রবিন সিকদার, বাহাদুরপুর ইউনিয়নের মিঠাপুর গ্রামের ফুকু বেপারীর ছেলে জসিম বেপারী, মিঠাপুর গ্রামের আসমত আলী মোল্লার ছেলে ইব্রাহীম মোল্লা, রাজৈরের রুবেল ও ইশিবপুর গ্রামের হায়দার হোসেন। তাদের বয়স ১৯ থেকে ২১ বছরের মধ্যে।
এসব পরিবারের দাবি, মুক্তিপণের টাকা দেওয়ার সমর্থ তাদের কারও নেই। এ অবস্থায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। সন্তানদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আকুতি জানিয়েছেন তারা।
সরেজমিন জানা গেছে, কয়েক মাস আগে ইতালির উদ্দেশে পাড়ি জমান রবিন সিকদার। তাকে লিবিয়ার দালাল চক্র জিম্মি করে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।
তার মা নুরজাহার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলেকে জিম্মি করে ১০ লাখ টাকা দাবি করছে দালাল হারুন। এখন আমি এতো টাকা কোথায় পাবো? হারুন দালালের মাধ্যমে লিবিয়া দিয়ে ইতালিতে পাঠানোর কথা হয়েছিল ৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকায়। সেই টাকা দিয়েছি একবার। বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন করে। সেই দৃশ্য মোবাইল ফোনে পাঠায়। এরপরে আমরা তাকে জমি ঘর বাড়ি বিক্রি করে ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিলে কয়েক দিন যোগাযোগ করতে পারি। কিছুদিন যোগাযোগ বন্ধ ছিল। হঠাৎ করে আবারও ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। আবারও আমার ছেলেকে মারধর করে মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করে ইমোতে কল দিয়ে তা আমাদের দেখায়। আমরা এখন নিরুপায়। টাকা না দেওয়ার কারণে ছেলের সাথে যোগাযোগ এখন বিচ্ছিন্ন। এখন আমার ছেলেকে ফেরত আনার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই। আমার ছেলেকে ফেরত চাই।’
লিবিয়ায় বন্দী রবিন সিকদারের মামা ইব্রাহীম মোল্লা বলেন, হারুন দালালের মারফত লিবিয়া পৌঁছানোর কয়েকদিন পর গত ২৬ মে রবিন সিকদার ফোন করে জানায় দালাল হারুন তাকেসহ আরো কয়েকজনকে অন্য মাফিয়ার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এখন যদি আরও ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা এই মুহূর্তে না দেওয়া হয়, তাহলে মাফিয়ারা তাকে মেরে ফেলবে। এখন নিরুপায় হয়ে আমরা সরকারের সাহায্য সহযোগিতা চাচ্ছি।
নিখোঁজদের পরিবারের দাবি, ইতালি যেতে সদর উপজেলার চন্ডিবর্দি এলাকার হারুন দালালের সঙ্গে কথা হয় তাদের। আলোচনায় ঠিক হয় তাদের লিবিয়া হয়ে ইতালি নিয়ে যাওয়া হবে। জনপ্রতি সাড়ে ৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা করে চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, হারুনের কাছে সাড়ে ৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা করে পরিশোধ করে ওই সাত যুবকের পরিবার। এরপর লিবিয়ার উদ্দেশে তারা দেশ ছাড়েন। এরই মধ্যে তারা লিবিয়ায় গিয়ে পৌঁছায়। সেখান থেকে গত ২৬ মে ইতালি যেতে সাগর পাড়ি দেওিয়ার কথা বলে নিয়ে তাদের জিম্মি করা হয়।
ইতালির উদ্দেশে পাড়ি জমানো এলেম খলিফার বাবা আবদুল হাকিম খলিফা বলেন, ‘আমার ছেলেকে জিম্মি করে ৯ লাখ টাকা দাবি করছে। এখন আমি এতো টাকা কোথায় পাবো? যে দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় পাঠিয়েছি, তাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। ইউনুস শেখের বাবা সিরাজ শেখ বলেন, ‘ধার-দেনা করে পোলারে বিদেশ পাঠাইলাম। এখন আর টাকা দেয়ার মতো সাধ্য আমার নেই।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মাদারীপুর সদর উপজেলার চন্ডিবর্দি এলাকার দালাল হারুনের ইমো ও হোয়াটসআপ নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। ম্যাসেজ দিয়েও তার সাড়া মেলেনি। তার গ্রামের বাড়িতে যোগাযোগ করলে, কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। অপরদিকে দালাল হারুন গ্রামের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানান, তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে মাদারীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘ভুক্তভোগী পরিবারগুলো মানবপাচারের ঘটনায় মামলা করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
বিডি প্রতিদিন/এমআই